সেই মুজিবের রক্তে ভেজা স্বাধীন বাঙলার বুকে দাঁড়িয়ে আজ নতুন প্রজন্মের সন্তানেরা ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই অধ্যাপক গোলাম আজমকে ভাষা সৈনিক হিসেবে কেন সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করা হয় না, সেটা নিয়ে আফসোস করে!
জকাল অনেকেই দেখি শেখ মুজিবরে ভাষা সৈনিক দাবি করে। শুনে বড়ই মজা পাই, ফেব্রুয়ারি আর মার্চ আসলেই চেতনাবাজ প্রজন্মের চেতনার জোয়ারে ভাইসা যাওয়ার দশা আরকি। মুজিব ছিল একটা কুখ্যাত গুন্ডা, দেশভাগের আগে কলকাতার রাস্তায় মাস্তানি কইরা বেড়াইত। মালাউনের ঘরে জন্মানো এই ইন্ডিয়ার দালালরে আজকে মানুষ ভাষা সৈনিক উপাধি দেয়, বুঝ অবস্থাটা। অথচ ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক অধ্যাপক গোলাম আজম যে ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছিলেন, পাকিস্তান কায়েম রাখার জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করছেন, সেইসব এই প্রজন্ম কোনোদিন জানতেও চায় না। সাধে তো আর মুসলমান রাষ্ট্র পাকিস্তান ভাইঙ্গা ইন্ডিয়ার অঙ্গরাজ্য হয় নাই।
ওপরের কথাগুলো ২০১৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি এক তরুণীর ফেসবুক ওয়ালে দেখেছিলাম। উচ্চশিক্ষিত, স্মার্ট, স্টাইলিশ ওই তরুণীর স্ট্যাটাসে এই কথাগুলো দেখে কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। তারপর তার ওয়ালের পুরনো স্ট্যাটাসগুলো ঘেঁটে দেখলাম, অনলাইন-অফলাইনে মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজাকারের ফাঁসী সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনায় তিনি বড়ই বিরক্ত, বাঁশেরকেল্লার পোস্ট নিয়মিত শেয়ার দেন এবং ৪৭' সালেই আমরা স্বাধীন হয়েছি বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন।
তাকে ইনবক্সে নক দিলাম, কিছুক্ষণ কথা হতে না হতেই উনি আম্বালিগের দালাল, মুজিবের মুরিদ, ভারতের পা চাটা কুকুর ইত্যাদি গালাগাল দিয়ে আমাকে ব্লক করে দিলেন। খুব হতাশ লাগলো হঠাৎ, মাত্র ৪৪ বছরেই গৌরবের ইতিহাসগুলো, বাঙ্গালী জাতির সুর্যসন্তানদের ভূমিকা কি অদ্ভুতভাবেই না বদলে গেছে, আহারে।
ফেব্রুয়ারির শুরু, ১৯৫২ সাল। পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাঙলার দাবিতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের বিশাল মিছিল যাচ্ছে। মিছিলের দাবি “রাষ্ট্রভাষা, রাষ্ট্রভাষা, বাঙলা চাই, বাঙলা চাই” শ্লোগানে শুরু হয়ে শেষ হচ্ছে “শেখ মুজিবের মুক্তি চাই” শ্লোগানে। যার মুক্তি দাবি করা হচ্ছে, সেই মানুষটা একসময় মুসলিম লীগের রাজপথ কাঁপানো ছাত্রনেতা ছিলেন, পাকিস্তান তৈরি হবার পরে ১৯৪৮ সালেই রাষ্ট্রভাষা বাঙলার দাবিতে রক্ষণশীল কট্টরপন্থী নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন ছেড়ে তৈরি করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ।
এরপর ১৯৪৯ সালে কট্টরপন্থী গোঁড়া ধর্মান্ধ মুসলিম লীগ ছেড়ে মাওলানা ভাসানিকে সভাপতি বানিয়ে গঠন করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। কট্টরপন্থী মুসলিম লীগ ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের অনুগত, তারা মনে করতো বাঙলা হল হিন্দুদের ভাষা, মুসলমানের ভাষা হচ্ছে উর্দু। এই ভয়ংকর ধর্মান্ধতা সহ্য করতে পারেননি মুজিব, রাজপথ কাঁপিয়েছেন রাষ্ট্রভাষা বাঙলার দাবিতে। ভয় পেয়ে তাকে জেলে আটকে পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করেছিল মুসলিম লীগ সরকার, ফলাফল হয়েছে উল্টো। পূর্ব পাকিস্তানকে সবসময় পূর্ব বাঙলা উচ্চারণ করতেন মানুষটা, সেই শেখ মুজিব বাঙলা ভাষার স্বাধিকারের দাবিতে প্রথম মিছিল থেকেই গ্রেফতার হয়েছিলেন, খুবই বিপদজনক নেতা হিসেবে চিহ্নিত মুজিবকে আজ টানা দুই বছর জেলে আটকে রাখা হয়েছে কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই, আন্দোলন তাতে বরং দ্বিগুণ বেগবান হয়েছে, একবিন্দু স্তিমিত হয়নি।
কয়েকদিন আগেই মুজিব ছিলেন ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি, সেখানে হাসপাতালের বেডেই ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বের সাথে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালিত হবে মুজিবের নেতৃত্বে। যদি মুজিবকে ১৫ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে মুক্তি দেওয়া না হয়, তবে মুজিব আমরণ অনশনে যাবেন, জেল থেকেই সংহতি জানাবেন, কিন্তু আন্দোলন হতে হবে দুর্বার। খাজা নাজিমের সরকার মুজিবের সিদ্ধান্তে বিচলিত হয়ে পড়লো। এমনিতেই ছাত্ররা ক্ষেপে আছে, তার ওপর আমরন অনশনরত মুজিবকে ঢাকায় রাখা খুবই রিস্কি, ছাত্ররা কখন কি করে বসে ঠিক নাই। সুতরাং মুজিবকে গোপনে ফরিদপুর জেলে পাঠায়ে দেওয়া হবে। মুজিবও নাই, দিকনির্দেশনাও নাই।
সমস্যা হল, খাজা নাজিমের সরকার তখনো মুজিবররে ঠিকঠাক চিনে উঠতে পারে নাই, এদিকে ২১ তারিখের আন্দোলনে দেশ কাঁপাতে হবে, সংবাদটা সবার কাছে পৌঁছানো দরকার। তাকে কোথায় নেয়া হচ্ছে, সেটাও সবাইকে জানানো দরকার। মুজিব হঠাৎ আলসে হয়ে পড়লেন। তখন ফরিদপুর যাবার জন্য নারায়ণগঞ্জ থেকে ষ্টীমারে আগে গোয়ালন্দ যেতে হত, মুজিবের গড়িমসিতে পুলিশ তাকে যতক্ষণে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে আসতে পারল, ততক্ষণে গোয়ালন্দের স্টিমার বহুদুর চলে গেছে। মুজিব নারায়ণগঞ্জে শুনে থানায় মানুষের ঢল নামলো, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে মুজিব ঠিকই জায়গামত আন্দোলনের ঠিকঠাক ডিরেকশন পোঁছে দিলেন।
তীব্র আন্দোলন হবে, জনজীবন একেবারে অচল করে দেওয়া হবে, কিন্তু জনগনের জানমালের যেন বিন্দুমাত্র ক্ষয়ক্ষতি না হয়। একেবারে কড়া আদেশ মুজিবের, রাত ১১টার ষ্টীমারে মুজিবকে ফরিদপুর নিয়ে যাওয়া হবে, অসংখ্য মানুষ ষ্টীমারের উপরে, বাইরে দাঁড়ায়ে, স্টিমার ছাড়া যাচ্ছে না। মুজিব খালি কণ্ঠে বললেন, আপনারা আমাকে বিদায় দেন। ফরিদপুরের জেলে থাকলেও রাজপথে আমি আপনাদের সাথে একাত্ম হয়েই থাকবো। জীবনে আর কোনদিন দেখা হবে কিনা জানি না, কিন্তু মায়ের জবানের ভাষার দাবিতে মরনেও দুঃখ নাই। ন্যায়ের পথের অধিকার আদায়ে মৃত্যুও অনেক গৌরবের, জনতা কাঁদতে কাঁদতে পথ ছাড়লো।
মুজিবের হার্টে অসুখ, চোখের সমস্যা সেই ছোটবেলা থেকে। নাকের ভেতরে একটা ক্ষত ছিল, জানটা বাঁচায়ে রাখতে নাকের ভেতর নল ঢুকিয়ে তরল খাবার খাওয়াতে গিয়ে অবস্থা আরও খারাপ হল। দু-তিন বারেই নলের ঘষায় ক্ষতটা তাজা হয়ে গিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করলো ঝরঝর করে। একে তো অনশনে অসম্ভব ক্লান্ত, তার ওপরে খাওয়াতে গিয়ে এইভাবে যন্ত্রণাদায়ক রক্তপাত— মুজিব সহ্যের শেষসীমায় পৌঁছে গেলেন। নল ঢোকাতে দেবেন না। কিন্তু পাঞ্জাব পুলিশ সেটা মানবে কেন? হাত দুইটা পিছমোড়া করে হ্যান্ডকাফে আটকানো হল, প্রত্যেকবার নাকের ভেতর নলের যাওয়া-আসায় তাজা রক্তে ভেসে যেতে থাকলো জামা।
গত পাঁচদিন একটানা অনশন করে চলেছেন মুজিব আর ছাত্রনেতা মহিউদ্দিন। একটা বড় অসুখ থেকে মাত্র উঠেছিলেন, তারপর হঠাৎ এই অনশনের মারাত্মক প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে শরীরটা। সিভিল সার্জন, জেলার, জেলের ডাক্তার— অনশন ভাঙ্গাতে স্রেফ পায়ে ধরতে বাকি রেখেছেন তারা মুজিবের,কিন্তু মুজিবর যে মচকাতে জানেন না। নাক দিয়ে রক্ত ঝরে ভিজে গেছে জামা, সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুজিব প্রিয়জনদের জীবনের শেষ চিঠি লিখতে বসলেন। এমন সময় কানে ভেসে এল, “রাষ্ট্রভাষা, রাষ্ট্রভাষা, বাঙলা চাই, বাঙলা চাই”। মুজিবের মনে পড়ে গেল, আজ একুশে ফেব্রুয়ারি, বাইরে মুক্ত থাকলে এখন তিনি থাকতেন মিছিলে, সবার সামনে।
বুকটা ভেঙ্গে যেতে লাগলো তার আক্ষেপে, সেই সাথে জেঁকে ধরলো দুশ্চিন্তা আর উৎকণ্ঠা, ঢাকায় কি হচ্ছে আজ? ওরা তো ১৪৪ ধারা জারি রেখেছে, খবরটা ফরিদপুর জেলে এসে পৌঁছালো গভীর রাতে, ঢাকায় ছাত্র-জনতার জলোচ্ছ্বাস থামাতে গুলি চালিয়েছে পুলিশ, অসংখ্য মানুষ হতাহত, প্রচুর লাশ ট্রাকে করে তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ। স্তব্ধ মুজিবের চিন্তাশক্তি লোপ পেল। কি দুঃসাহসী! কি দুর্দমনীয় এরা! মায়ের মুখের বুলির অধিকার আদায়ে বন্দুকের নলের সামনেও পিছপা হয়নি, বরং বুক পেতে তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে! এই জাতিকে ঠেকাবে কে? চোখ দুটো অজান্তেই ভিজে গেল মুজিবের।
সিভিল সার্জন সাহেব একবার নাড়ি পরীক্ষা করেই চুপসে গেলেন। হাতটা ধরে বললেন, আপনি তো মারা যাচ্ছেন। এইভাবে জীবনটা শেষ করে দিয়ে কি হবে, বলুন তো? আপনার কাজগুলো কে শেষ করবে? খুব কষ্টে কথাগুলো বের হল মুজিবের গলা দিয়ে, ”কাজ পড়ে থাকবে না, একজন না একজন দায়িত্ব নেবেই। মায়ের ভাষার জন্য, দেশের মানুষের জন্য জীবন দিতে পারলাম, এইটাই শান্তি, আর কিছুর দরকার নেই। কিছুক্ষনের মধ্যে মুজিবের হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
এক কয়েদী সরিষার তেল গরম করে হাতে পায়ে ডলে দিতে লাগলো। পাশে দাঁড়ানো এক কর্মচারীকে হাতের ইশারায় ডেকে চিঠি চারটা দিয়ে মুজিব বললেন, আমার মরার পর চিঠিগুলা আমার পরিবারের কাছে পৌঁছায়ে দিয়ো। কর্মচারীটা হাও মাও করে কেঁদে ফেললো। চোখ বন্ধ করলেন মানুষটা, আব্বার চেহারাটা ভেসে উঠলো। ওই তো পাশে আম্মা, রেনু আম্মার আঁচল ধরে দাঁড়ায়ে আছে, হাসুর কোলে কামাল। খুব অসময়ে চলে যেতে হচ্ছে, ওদের শেষবারের মত কিছু বলার সুযোগটাও পাওয়া গেল না।
তাতে কি, জনগনের মুক্তির জন্য আন্দোলনে কাউকে না কাউকে তো উৎসর্গ হতেই হবে। দেশের জন্য,মানুষের জন্য, জীবন দেওয়াটাও তো সৌভাগ্যের ব্যাপার। মানুষ যখন মরতে শেখে, তখন কেউ তারে দাবায়ে রাখতে পারে না। পাশের বেডে মহিউদ্দিনেরও সময় শেষ হয়ে আসছে। প্লুরিসিস রোগে কফের সাথে রক্ত বের হচ্ছে, আশা নেই আর। মুজিবের ইশারায় দুজন কয়েদী তাদের শোয়া অবস্থাতেই অজু করালো। মুজিব সূরা ফাতিহা, সূরা ইখলাস তিনবার আর দরূদ শরীফ পড়ে শুয়ে শুয়েই দুই হাত তুললেন পরম করুনাময়ের কাছেঃ
হে আল্লাহ, হে রহমানুর রহীম, তুমি সবাইকে মাফ করে দাও। পৃথিবীর সবাইকে ভালো রাখ। আমার বাঙলার মানুষকে ভালো রাখ। তাদের মঙ্গল করো। আব্বাকে ভালো রাখো। আম্মাকে ভালো রাখো। রেনুকে ভালো রাখো। আমার হাসুকে ভালো রাখ, ছোট্ট সোনামণি কামালকে ভালো রাখ। আমার না থাকার বিনিময়ে আমার মাতৃভূমিকে ভালো রাখো...
চোখ বন্ধ করে আপনমনে দোয়া করে চলেছেন মুজিব, কপালে হাতের স্পর্শ পেয়ে হঠাৎ চোখ খুললেন। পাশের বসা জেলার সাহেবের অদ্ভুত কোমল গলা শোনা গেলো, আপনার দাবিগুলো মেনে নিয়ে আপনাকে মুক্তি দেওয়া হলে খাবেন তো? মুজিবের জবাব শুনবার জন্য জেলার সাহেবকে কান পাততে হল, খুব ধীর কিন্তু পাথুরে অবিচল শোনাল মুজিবের গলা, “দাবী মানা হলে খাবো। তবে মুক্তি নিয়ে এখন আর চিন্তা করি না।
আমার লাশকে বন্দী রাখার ক্ষমতা আপনাদের নেই। জেলার সাহেব বাস্পরুদ্ধ গলায় বললেন, ঢাকা থেকে আপনার মুক্তির ফরমান এসে গেছে মুজিবুর রহমান। অর্ডার এসেছে রেডিওগ্রামে, ম্যাজিস্ট্রেটও অর্ডার পাঠিয়েছেন। আপনাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। মুজিবের বিশ্বাস হয় না। খাজা নাজিমের সরকার তো মুজিবকে মুক্তি দেওয়ার পাত্র নন। নিশ্চয়ই কোন চাল। অর্ডারগুলো চেক করে দেখলেন মহিউদ্দিন, দুর্বল হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটের কোনায়, “তোমার অর্ডার সত্যিই এসেছে মুজিব, তুমি মুক্ত”।
ডাবের পানি খাইয়ে মুজিবের অনশন ভাঙ্গানো হল। অন্য কিছু খাওয়ানো গেল না। কিছু মুখে নেবার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত নেই মুজিবের। পরদিন সকালে জেল হাসপাতালে এলেন বাবা শেখ লুৎফর রহমান, মৃতপ্রায় ছেলেকে বাড়ি নিয়ে যাবেন। স্ট্রেচারে তোলা হল মুজিবকে, জেলার সাহেব চোখের পানি গোপন করতে করতে বললেন, অনেক নেতা দেখছি জীবনে, কিন্তু আপনার মত নেতা দেখিনি মুজিব। একদিন আপনার নেতৃত্বে ইতিহাসটা পাল্টায়ে যাবে। স্রষ্টা আপনার মঙ্গল করুন।
কারাগারের বাইরে প্রচন্ড ভিড়, অসংখ্য মানুষ। সবাই মুজিবররে এক নজর দেখতে আসছে। কোনোমতে ফরিদপুর শহরে আনা হল তাকে, সেখানেও লোকে লোকারণ্য। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল গোপালগঞ্জগামী ষ্টীমারে তিল ধারনের জায়গা নাই, কেউ এক মুহূর্তের জন্যও মুজ্জিবকে চোখের আড়াল করতে রাজি না। গোপালগঞ্জ ঘাটে নামার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। বাবা লুৎফর রহমান কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বললেন, তোমরা কি ওরে মাইরা ফেলতে চাও নাকি?
তার অনুনয়ে কর্নপাত করবার সময় নেই বিশাল জনতার, প্রিয় মুজিব ভাইরে কোলে বিশাল আনন্দ মিছিল করতে করতে তারা চলে গেল... এই ছিলেন মুজিব। সারাটা জীবন যে মানুষটা স্রেফ বাঙলার মানুষের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করে গেছেন,সাধারন মানুষের দুঃখ-কষ্ট কিভাবে যেন তার দুঃখ-কষ্ট হয়ে গেছে, সারাজীবন আর কিছু নিয়ে ভাবেননি, ভাববার সময় পাননি, তার চিন্তা-ভাবনায় কেবলই ছিল তার দেশের জনগন, তার সন্তানসম জনগন।‘৪৮ সালের ১১ই মার্চ থেকে শুরু হল, এরপর ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার আগ পর্যন্ত তার জীবনের ২৪ বছরের মধ্যে প্রায় ১৫ বছরই কারাগারের চার দেয়ালের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে হারিয়ে গেছে।
মিছিলে, আন্দোলনে সবসময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন, শ্লোগান থেকে আগুন বেরোত, গ্রেফতার না করে পুলিশের কোন উপায়ই থাকতো না। বহুদিন পর জেল থেকে ছাড়া পেতেন, জেলগেট থেকেই আবার গ্রেফতার। কখনো দেখা গেল, বাইরে বেরিয়ে এসেছেন, এসেই মিছিলে যোগ দিয়েছেন, সেই মিছিল থেকেই আবার গ্রেফতার করে নিয়ে গেল পুলিশ। পাথর কঠিন ছিল তার মনোবল, শত হুমকি-ধামকি, মৃত্যুভীতি কিছুই বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি তাকে, মচকাননি নিজের অজান্তেও। ক্রমাগত অনশন আর অনিয়মে একসময় ব্রংকাইটিস হয়ে গেল তার, কফের সাথে টকটকে তাজা রক্ত বের হত, মাঝে মাঝেই প্রচণ্ড বুক ব্যথায় অবসন্ন হয়ে পড়েন।
আর কত? শেষপর্যন্ত মুজিব তো একজন মানুষই!! শুকিয়ে হাড় জিরজিরে হয়ে জাবার পর গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা ভিন্ন পথ ধরলেন, প্রতিদিন বণ্ড দলিল নিয়ে আসেন, দুঃখিত স্বরে বলেন, শেখ সাহেব, আর কত কষ্ট করবেন? এইখানে একটা সাইন দিয়ে দেন, আপনাকে মুক্তি দিয়ে দেই। মুজিবের মুখ কঠিন হয়ে যায়, শোনেন জনাব, আমি শেখ মুজিবুর রহমান, বণ্ড দিয়ে আমি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান সরকারের কাছে মুক্তি চাই না। আমি বাঙলার মেহনতি মানুষের জন্য সংগ্রাম করতেছি, তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করতেছি, বণ্ড সই দিলে তাদের সাথে বেইমানি করা হবে। একটা মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয় তার পরিবার।
সেই পরিবারের কথা কখনো ভাবে নাই শেখ মুজিব, সর্বক্ষণ তার ভাবনায় তার জনগন, নির্যাতিত নিষ্পেষিত জনগন, বাঙালী ছিল তার কাছে পরিবারের চেয়েও আপন। কোন সন্তানের জন্মের সময়ই পাশে থাকতে পারেন নাই, সন্তানেরা তার বাবারে কাছে পায় নাই। প্রচণ্ড একাকীত্বে সময় পার হত স্ত্রী রেনুর, চোখের জলটা কোনোদিন মুজিবরে দেখতে দেন নাই, পাছে যদি তার মন দুর্বল হয়ে পড়ে, মুজিব ত তার একার না, মুজিব যে পুরো জাতির। গোপালগঞ্জ কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে মুজিব বাড়ি ফিরছেন বহুদিন পর।
কামালটা এইদিক ওইদিক ঘুরতেছে, ফিরতেছে, হাসুর সাথে খেলতেছে, গোঁফওলা কালো ফ্রেমের চশমা পড়া মানুষটাকে ঠিক চিনতেছে না। হাসু আপা কয়েকবার আব্বা বলে ডাকলো মানুষটাকে, শুনে সে হঠাৎ হাসুর জামার খুঁট ধরে আস্তে করে বলল, “হাসু আপা, তোমার আব্বাকে একটু আব্বা বলে ডাকি?” পিতা হিসেবে এইটাই ছিল মুজিবের নিয়তি, সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর জন্য মানুষটা স্যাক্রিফাইস করছিল সব, সবকিছু।
আর সেই মুজিবের রক্তে ভেজা স্বাধীন বাঙলার বুকে দাঁড়িয়ে আজ নতুন প্রজন্মের সন্তানেরা ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই অধ্যাপক গোলাম আজমকে ভাষা সৈনিক হিসেবে কেন সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করা হয় না, সেটা নিয়ে আফসোস করে ৪৪ বছর পরের বাঙলাদেশের গল্পটায় শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রজন্ম চেনে স্রেফ মালাউনের ঘরে জন্ম নেওয়া একজন হিন্দুস্তানি দালাল হিসেবে, যার ষড়যন্ত্রে পেয়ারা পাকিস্তান ভেঙ্গে গিয়েছিল।