ফেসবুকে 'কাঁদো বাঙ্গালী কাঁদো' আর বাস্তবে বিরিয়ানি উৎসব! শোকদিবস উপলক্ষে এলাকাবাসীকে ‘শুভেচ্ছা’ জানিয়ে পোস্টার সাঁটায় কেউ কেউ। অনেকের পোস্টারে ‘শোকদিবস সফল ও সার্থক হোক’ কথাটিও দেখা যায়।

পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পরবর্তী কয়েক বছর প্রকাশ্যে তার নামোচ্চারণও অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল, তৎকালে তার জন্মদিন বা মৃত্যুবার্ষিকী পালন ছিল মহাপাপ। সে দিন আর নেই, তার মৃত্যুতে এখন শোক পালিত হয় মাস-জুড়ে। আওয়ামি লিগ যে সময়টা জুড়ে ক্ষমতায় থাকে; সে সময়টায় আগস্ট অবশ্য শোকের মাস থাকে না, হয়ে যায় মচ্ছবের মাস। এক শ্রেণির উচ্চফলনশীল নেতাকর্মীর কারণেই মুজিবের এই অবনমন। শোকদিবসকে কেন্দ্র করে শোকব্যবসার অবসান ঘটা অতি জরুরি। 

১। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায়ের রচিত দুটো পঙক্তি আগস্ট-জুড়ে প্রচুর ব্যবহৃত হয় এবং পঙক্তি দুটো যে যার মতো করে ব্যবহার করেন। এমনকি ধানমন্ডি বত্রিশে স্থাপিত মুজিবের প্রতিকৃতিতেও পঙক্তি দুটো ভুলভাবে উৎকীর্ণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। মূল পঙক্তি দুটো হচ্ছে- যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান 

২। নব্বইয়ের দশকে হঠাৎ করে পনেরোই আগস্টে জন্মদিন পালন শুরু করেন খালেদা জিয়া। এমন অনেকে আছেন, যারা আগস্টের পনেরো তারিখে মুজিবকে স্মরণ না করে খালেদাকে তুলোধুনো করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পনেরোই আগস্টে পাদপ্রদীপের পুরো আলোটা এতে খালেদার ওপরই পড়ে যায় এবং খালেদা ঠিক এটিই চেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিব- সংক্রান্ত প্রত্যেকটি তারিখকে বিতর্কিত করে জনমানুষের মনোযোগ ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা বিএনপির রাজনীতির একটা পুরোনো কৌশল, এ কৌশলে বিএনপি শতভাগ সফলও। ছাব্বিশে মার্চ এলে গণহত্যা নিয়ে আলোচনা না করে এখন আমরা লিপ্ত হয়ে পড়ি কে স্বাধীনতার ছহি ঘোষক, তা নিয়ে; পনেরোই আগস্ট এলে মুজিবের জীবন নিয়ে আলোচনা না করে এখন আমরা লিপ্ত হয়ে পড়ি খালেদাকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপে। এতে পনেরোই আগস্ট মুজিব গুরুত্বহীন হয়ে পড়েন, একদিনের জন্য খালেদা হয়ে ওঠেন প্রধান আলোচ্য। পনেরোই আগস্ট খালেদার জন্মদিন পালন নিয়ে বিদ্রূপ অপেক্ষা মুজিবের জীবন নিয়ে আলোচনাই বেশি জরুরি।

৩। আগস্টে অনলাইন-অফলাইন ছেয়ে যায় শোকের পোস্টার-ব্যানারে। সেসব পোস্টারে এক কোণে মুজিবকে নামমাত্র রাখা রেখে বিশাল করে মুদ্রিত থাকে পোস্টারের প্রচারকের ছবি, যা মুজিবের বড় ধরনের অবমাননা। আওয়ামি লিগের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে এই মর্মে নির্দেশ জারি করা জরুরি যে, মুজিব ও তার সাথে নিহত ব্যক্তিবর্গ ছাড়া আর কারো ছবি শোকের পোস্টারে ব্যবহার করা যাবে না। এক শোকদিবসে লক্ষ করা গেছে ধানমন্ডি আওয়ামি লিগের ওয়ার্ড-পর্যায়ের এক নেতা তেহারির প্যাকেটে মুজিবের ছবি ছেপেছেন, পেশোয়ারি পাজামা আর ঢলঢলে পেঙ্গুইন কোট-পরা নিজের বেঢপ দেহের ওপর ফটোশপ করে বঙ্গবন্ধুর মাথা কেটে বসিয়ে গত বছর রাস্তায় প্লাকার্ড সেঁটেছিলেন সাংসদ এমএ লতিফ। এ জাতীয় গর্হিত অপকর্ম ও মুজিব-ব্যবসা কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। 

৪। চাঁদপুর আওয়ামি লিগের এক নেতাকে গত বছর দেখা গেছে শোকদিবস উপলক্ষে এলাকাবাসীকে 'শুভেচ্ছা' জানিয়ে পোস্টার সাঁটাতে। অনেকের পোস্টারে 'শোকদিবস সফল ও সার্থক হোক' কথাটিও দেখা যায়। যারা জানে না শোকদিবস শুভেচ্ছা জানানোর কোনো উৎসব না এবং শোকদিবস সফল বা সার্থক হওয়ার মতো কোনো দিবস না, সেইসব মূর্খদেরকে আওয়ামি লিগ থেকে বিদায় করাই শ্রেয়।

৫। শোকদিবসে ছাত্রলিগের অধিকাংশ নেতাকর্মীকেই দেখা যাবে মুজিবকে নিয়ে তেমন কিছু না লিখে তার ডজন-ডজন ছবি আপলোড করতে। মুজিবের ছবি আপলোডের মাঝে কৃতিত্ব নেই, গুগলে তার হাজারো ছবি পাওয়া যায়। শোকদিবসে ছাত্রলিগের নেতাকর্মীরা মুজিবকে নিয়ে পত্রিকায়-ফেসবুকে বিশ্লেষণাত্মক মৌলিক প্রবন্ধ লিখবে— এটিই প্রত্যাশিত। 

৬। পনেরোই আগস্টে টুঙ্গিপাড়াগামী যানবাহনে আওয়ামি লিগ-ছাত্রলিগের অনেক নেতাকর্মী দন্তপাটি বিকশিত করে এমনতর ছবি আপলোড করেন, যা দেখে ঠাহর করার জো থাকে না দিনটি শোকের না সুখের; তদুপরি 'ভাইয়ের সাথে সেলফি' তো আছেই। অন্তত এই একটি দিন ছবি তোলার সময়ে দাঁতের পাটি মুখের ভেতরে রাখা এবং 'ভাইয়ের সাথে সেলফি' প্রচার থেকে বিরত থাকা সবার নৈতিক দায়িত্ব। 

৭। অনেককে দেখা যায় মুজিবের কোনো প্রতিকৃতির সামনে বা পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে। এতে গোটা ছবির সৌন্দর্যই নষ্ট হয়। ছবি আপলোড করতে চাইলে মুজিবের একার ছবি আপলোডই কাম্য, অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে আপন খোমা প্রদর্শনের লোভ সংবরণ জরুরি। মুজিবের সমাধিকে পেছনে রেখে ছবি তোলা থেকে বিরত থাকাও কর্তব্য।

৮। শোকদিবসকে কেন্দ্র করে আওয়ামি লিগ-ছাত্রলিগের আয়োজিত প্রায় সব আলোচনাসভাই নিছক বাগাড়ম্বরপূর্ণ। সেখানে মুজিবকে ছাপিয়ে ঊর্ধ্বতন নেতার স্তুতি ও বিএনপির মুণ্ডুপাতই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এসব থেকে বিরত থেকে শোকদিবসের আলোচনায় মুজিবকে নিয়ে আলোচনাই কাম্য। 

৯। ছাত্রলিগের অনেক নেতাকর্মীকে জিজ্ঞেস করলেই উত্তর দিতে পারবে না ছয়দফার দফাগুলো কী কী, মুজিব কী কী মামলায় কারাবরণ করেছেন, বাকশাল কী, রক্ষীবাহিনী কী, কেন তিনি ওআইসিতে যোগ দিয়েছিলেন, কেন ভুট্টোকে বাংলাদেশে এনেছিলেন, কেন ও কী কী শর্তে তিনি রাজাকারদেরকে সাধারণ ক্ষমা করেছিলেন। তাদের ঠিকুজি ঘাঁটলে 'ভাইয়ের সাথে' রাশি-রাশি সেলফি বৈ কিচ্ছুটি মিলবে না। লাইনে আনার জন্য এদেরকে বাধ্য করতে হবে বছরে বঙ্গবন্ধুর ওপর রচিত অন্তত চারটি বই পড়তে এবং এদের জন্য বছরে চারটি বাধ্যতামূলক কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে, কুইজে ফেল করলে দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। 

১০। আওয়ামি লিগে ধনকুবেরের অভাব নেই। মুজিবের 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' বইটির একটি করে কপি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে পৌঁছে দেওয়া আওয়ামি লিগের যেকোনো কেন্দ্রীয় নেতার পক্ষে সম্ভব এবং এটি অত্যন্ত আবশ্যক।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা