বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের পরের দিনই কেন সৌদি আরব বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিলো? কেন এর আগে নয়?

সৌদি আরব সারা পৃথিবীর মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে পবিত্র তীর্থস্থান। মক্কা-মদিনার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা এই মুসলিম দেশটিকে অনেকেই শান্তির ধর্ম ইসলামের অন্যতম প্রধান ধারকবাহক হিসেবে মানেন। কিন্তু খুব অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ১৯৭১ সালের সেই ভয়ংকর নয় মাস জুড়ে ইসলামের নাম ব্যবহার করে সারা বাংলাদেশ জুড়ে সভ্যতার যে বর্বরতম পৈশাচিক গণহত্যা চালিয়েছিল, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করছিল, লাখো মা-বোন ধর্ষণ করছিল, ঠিক সেই সময়ে সৌদি আরব ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। তখনও তারা মুসলিম দেশ বিবেচনায় সর্বাত্মক সহায়তা করে গেছে নরপিশাচ পাকিস্তানীদের। এমনকি পাকিস্তানকে নাকে খত দিয়ে কানে ধরিয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করবার পরেও তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। 

কারণ তারা মনে করতো ভারতের ষড়যন্ত্রের জন্যই পাকিস্তান ভেঙ্গেছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের এই বাংলাদেশে নাকি সবাই 'হিন্দুস্তানী মালাউন'। এবং এটা যে তাদের নির্লজ্জ জোচ্চুরি এবং নরপিশাচ পাকিস্তানীদের পশ্চাৎদেশ বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা ছিল, সেটা পরিষ্কার হয়ে যায় ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সপরিবারে পৈশাচিক বর্বরতা হত্যা করবার পর। যে বাংলাদেশের বাঙ্গালীরা তাদের কাছে ছিল হিন্দুস্তানী মালাউন, যাদের হজ্জটা পর্যন্ত করতে দিতে চায়নি সৌদি আরব, সেই বাংলাদেশ রাতারাতি তাদের চোখে লাখো কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানে ভরে ওঠে। ফলে ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। 

একটা ছোট্ট বাচ্চাও বুঝতে পারবে, পাকিস্তানী নিষ্পেষণ আর বর্বরতম অত্যাচার থেকে বাঙ্গালী জাতিকে স্বাধীনতা এবং মুক্তি এনে দেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন সৌদিদের মূল মাথা ব্যথা। কারণ ছয় ফুট উঁচু এই ঋজু মানুষটা অঙ্গুলি হেলনে বাঙ্গালীর হাজার বছরের শোষিত আর বঞ্চিত হবার ইতিহাসটা পাল্টে মুক্তি আর স্বাধীনতার বার্তা না এনে দিলে কখনোই পাকিস্তান ভাগ হতো না, বর্বর লম্পট পাকিস্তানীরা চিরকালই ইচ্ছেমত বাঙ্গালীদের শোষণ করতে পারতো। ৩০ লাখ নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে যে পাকিস্তানীরা মেরে ফেললো, যাদের সিংহভাগ ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলিম, এটা সৌদি আরবের অন্ধ বর্বর শাসকদের জন্য বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথার কারণ ছিল না।

১৯৭১ সালে স্রেফ পাকিস্তানই হারেনি, হেরেছিল তাদের দোসর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, হেরেছিল চীন, হেরেছিল তথাকথিত মুসলিম উম্মাহ'র নেতা হিসেবে বাগাড়ম্বর করা সৌদি আরবও। সেই হারের জ্বালা এই দেশগুলো ভুলতে পারেনি, এক সেকেন্ডের জন্যও না। তাই এদের প্রত্যেকেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল তাদের প্রধান এবং একমাত্র শত্রু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নির্মম ষড়যন্ত্রে সপরিবারে মেরে ফেলার পর। সৌদি আরবকে ১৯৭১ সালের পরাজয় কি ভয়ংকরভাবে পোড়াতো এবং সে জন্য সৌদিরা বঙ্গবন্ধুকে কি ভয়ংকর ঘৃণা করতো এবং ভয় পেত, সেটা একেবারে দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৯৭৩ সালে (৫-৯ সেপ্টেম্বর) আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে, চতুর্থ জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে (ন্যাম)।  বৈঠক চলাকালীন সময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সৌদি বাদশাহ ফয়সালের একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

* দুই নেতা পাশাপাশি সোফায় বসলেন। বাদশা ফয়সালের দোভাষী বসলেন পাশের একটি চেয়ারে। পারস্পরিক স্বাস্থ্য ও কুশল বিনিময়ের পর কথপোকথন শুরু হলো- 

বাদশা ফয়সাল: ইউর এক্সেলেন্সী। আমি শুনেছি যে, বাংলাদেশে আমাদের কাছে কিছু সাহায্য আশা করছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি আসলে কী ধরনের সাহায্য চাচ্ছেন। আর হ্যাঁ, যে কোন ধরনের সাহায্য দেওয়ার আগে আমাদের কিছু পূর্বশর্ত আছে। 

মুজিব: ইউর এক্সেলেন্সী। আশা করি আমার দুর্বিনীত ব্যবহার ক্ষমা করবেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমার মনে হয় না- বাংলাদেশ ভিক্ষার জন্য আপনার কাছে হাত বাড়িয়েছে। 

ফয়সাল: তাহলে আপনি কিংডম অব সৌদি আরবের কাছে কী আশা করছেন?

মুজিব: বাংলাদেশের পরহেজগার মুসলমানরা পবিত্র কাবায় গিয়ে ইবাদত পালনের অধিকার দাবী করছে। ইউর এক্সেলেন্সী, যদি ইবাদত পালনের জন্য আপনার কোন শর্ত থেকে থাকে তাহলে আপনি তা বলতে পারেন। আপনি পবিত্র কাবা শরীফের তত্বাবধানে । আপনি মহান ব্যক্তি এবং বাঙালী মুসলানদের কাছে আপনার স্থান অনেক উচুতে। একথা নিশ্চয় স্বীকার করবেন, সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদেরই সেখানে ইবাদত করার অধিকার রয়েছে। সেখানে ইবাদত পালন করার কোন প্রকার শর্ত আরোপ করা কি ন্যায়সঙ্গত? ইউর এক্সেলেন্সী, আমরা সমঅধিকারের ভিত্তিতে আপনার সাথে ভ্রাতৃত্বপূর্ন সম্পর্ক চাই। 

ফয়সাল: কিন্তু এটা তো কোন রাজনৈতিক আলোচনা হলো না। ইউর এক্সেলেন্সী। দয়া করে আমাকে বলুন আপনি কিংডম অব সৌদি আরবের কাছে আসলেই কী আশা করছেন? 

মুজিব: ইউর এক্সেলেন্সী। আপনি জানেন যে, ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশ দ্বিতীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। আমি জানতে চাই, কেন সৌদী আরব স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে আজ পর্যন্ত স্বীকৃতি দেয়নি? 

ফয়সাল: আমি অসীম ক্ষমতাবান আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে প্রশ্নের জবাব দিই না। যেহেতু আপনি একজন মুসলিম, তাই আপনাকে বলছি- আপনি সৌদি আরবের স্বীকৃতি পেতে হলে বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে “Islamic Republic of Bangladesh” করতে হবে। 

মুজিব: এই শর্ত বাংলাদেশে প্রযোজ্য হবে না। বাংলাদেশের জনগনের প্রায় অধিকাংশই মুসলিম। আমাদের প্রায় এক কোটি অমুসলিমও রয়েছে। সবাই একসাথে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে বা যুদ্ধের ভোগান্তিতে পড়েছে। তাছাড়া সর্বশক্তিমান আল্লাহ শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্যই নন। তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা। ইউর এক্সেলেন্সী, ক্ষমা করবেন, তাছাড়া আপনার দেশের নামও তো “Islamic Republic of Saudi Arabia” নয়। আরব বিশ্বের একজন গুনী ও খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ প্রয়াত বাদশা ইবনে সৌদের নামে নাম রাখা হয়েছে “Kingdom of Saudi Arabia”। আমরা কেউই এই নামে আপত্তি করিনি।

ফয়সাল: ইউর এক্সেলেন্সী। এটার পাশাপাশি আমাদের আরো একটা শর্ত আছে। সেটা হলো পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেওয়া। 

মুজিব: এটা বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বিষয়। দুই দেশের বহু অমীমাংসিত বিষয় আছে। এগুলোর মধ্যে আছে; কয়েক হাজার আটকেপড়া পাকিস্তানীদের ফেরত নেওয়া এবং বাংলাদেশ প্রাপ্য ন্যায্য সম্পত্তির হিস্যা বুঝিয়ে দেওয়া। এই ব্যাপারগুলো সমাধা হতে কিছু সময় লাগতে পারে। তাই পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের বিনাশর্তে মুক্তির বিষয়টি নিয়ে এককভাবে কাজ করা যাবে না। তাছাড়া এটা নিয়ে সৌদি আরবের এত উৎকন্ঠার কারণ কী? 

ফয়সাল: দয়া করে এটা জেনে রাখুন যে, সৌদি আরব এবং পাকিস্তান কার্যতঃ এক এবং একই জিনিস। পাকিস্তান আমাদের নিকটতম বন্ধু। ইউর এক্সেলেন্সী, এখন আমাদের আর আলোচনার কিছুই নেই। আমাদের কন্ডিশন দুটি ভেবে দেখুন; এক. ইসলাম প্রজাতন্ত্র ঘোষনা এবং অন্যটি হলো পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তিদান। 

মুজিব: ইউর এক্সেলেন্সী, আপনি কি দয়া করে একটি বিষয় বুঝিয়ে বলবেন।

ফয়সাল: ইউর এক্সেলেন্সী, দয়া করে বলুন- বিষয়টি কি? 

মুজিব: বাংলাদেশকে সৌদি আরব স্বীকৃতি না দেওয়ার কারণে গত দুবছর ধরে বাংলাদেশের পরহেজগার মুসলমানরা হজ্বে যেতে পারছে না। ইউর এক্সেলেন্সী আপনি এ বিষয়ে অবগত আছেন? এমন বাধা সৃষ্টি করা কি জায়েজ? সারা বিশ্বের মুসলমানদেরই অধিকার রয়েছে পবিত্র কাবায় ইবাদত করার। তাহলে কেন এমন প্রতিবন্ধকরা সৃষ্টি করা হলো। কেন হাজার হাজার মুসলমানকে হজ্ব করার জন্য ইন্ডিয়ার পাসপোর্ট করে হজ্বে যেতে হয়? 

এ সময় অনাকাঙ্খিতভাবে শেষ হয় আলোচনা। উঠে পড়েন বাদশা ফয়সাল। দু নেতা বেরিয়ে যান। যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন তার এক কালের নেতা মাওলানা ভাসানীর উচ্চারিত একটা আয়াত- "লা-কুম দ্বীন-কুম ওয়াল-ইয়া দ্বীন" (তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার)। *

কী পাঠক, ধাক্কা খেলেন? পুরো একাত্তরের সময়টায় লাখো বাঙ্গালী ভাইদের পৈশাচিক হত্যাকান্ডে সমর্থন দেবার জন্য দুঃখ প্রকাশ কিংবা ক্ষমা চাওয়া তো বহু দূরে থাক, সৌদি আরবের বাদশাহ দু'বছর পরও "পাকিস্তান এবং সৌদি আরব মূলত একই" সিদ্ধান্ত জানিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গণহত্যা চালানো পাকিস্তানী নরপিশাচদের মুক্তি চাচ্ছে। এবং এর জন্য সে শর্ত দিচ্ছে বাংলাদেশের নাম পাল্টাতে হবে, অথচ সৌদি আরবের নাম কিন্তু ইসলামিক রিপাবলিক অফ সৌদি আরব নয়। কত বড় হিপোক্রেট তারা, ভাবা যায়?

আর সৌদি আরবের এমন ভয়ংকর ধৃষ্টতাপূর্ণ স্পর্ধার সমুচিত জবাব কেবল একজনই দিতে পারতেন, সেই বঙ্গবন্ধুকে আমরা  হত্যা করেছি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে প্ররোচিত হয়ে। সেই সৌদি আরব কিন্তু আজও তাদের চরিত্র পাল্টায়নি, তাদের প্রাণের সহচর পাকিস্তানের গণহত্যা চোখ বন্ধ করে সমর্থন করেছিল যারা একসময়, তারা আজ ইয়েমেনে হাজার হাজার নিরীহ নিরপরাধ মুসলিমকে নির্বিচার বোমাবর্ষণে হত্যা করছে, স্বার্থের জন্য মুসলিম দেশগুলোর ভেতর বিবাদ উস্কে নিজের ফায়দা লুটছে।

আফসোস, সেদিন যদি বঙ্গবন্ধু তার নিজের 'সন্তান'দের হাতেই নির্মমভাবে নিহত না হতেন, যদি তিনি আজও বেঁচে থাকতেন, দেশকে অসাধারণ পরিকল্পনা আর দুরদর্শী নেতৃত্বে পরিণত করতেন সত্যিকারের সমৃদ্ধ সোনার বাংলায়। তাহলে হয়তো আজ আমাদের মা-বোনদের লম্পট লোলুপ সৌদিদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হতো না, হয়তো সৌদিরাই সমৃদ্ধ উন্নত বাংলাদেশের কাছে তাদের কৃতকর্ম আর স্পর্ধার জন্য ক্ষমা চাইতে বাধ্য হত। আজ যদি শুধু অসামান্য ব্যক্তিত্বে সৌদি বাদশাহের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস দেখানো বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন! আফসোস! 

তথ্যসূত্র:  'মুজিবের রক্ত লাল' - এম আর আখতার মুকুল

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

​​​​​


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা