মন্দিরে প্রতিমা ভাংচুর দিয়ে শুরু হয়েছিল। এখন ভাস্কর্য ভাঙা হচ্ছে। কাল এরাই শিল্পচর্চা বন্ধ করতে বলবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলা অনুষদ বিলুপ্ত হবে। ছবি আঁকা বন্ধ হবে, সিনেমা-গান-নাটক সব বন্ধ হবে...

২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। আমরা তখন স্কুলের ছাত্র, দেশে জঙ্গীবাদের উত্থান, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন- অনেক কিছুই চোখের সামনেদেখেছি, পত্রিকায় পড়েছি। স্কুলের সামাজিক বিজ্ঞান বা সাধারন জ্ঞানের বইতে তখন স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম পড়তাম, সেটাই লিখতে হতো পরীক্ষার খাতায়। তখনও দেশের নানা জায়গায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ছিল, প্রতিমূর্তি ছিল। হয়তো অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকতো, কিন্ত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে সেই সময় কেউ হামলা চালিয়েছে বলে শুনিনি, কেউ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলেছে- এরকম খবরও চোখে পড়েনি।

অথচ একযুগ ধরে যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, তাদের আমলেই কিনা এই বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হলো! কুষ্টিয়া শহরের পাঁচ রাস্তার মোড় এলাকায় নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে ভাঙচুর করা হয়েছে রাতের আঁধারে। যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছে ক'দিন আগে, তাদের দোসরেরাই নিশ্চয়ই চালিয়েছে এই হামলা। বারো বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লিগের সময়ে জাতির পিতার ভাস্কর্য ভাসিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়, ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়- এরচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে?

মজার ব্যাপার কি জানেন? ১৯৬৯ সালের আজকের দিনে বঙ্গবন্ধু তার তর্জনী উঁচিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন, আজ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের নাম হবে বাংলাদেশ! ৫১ বছর পরে তার হাতে গড়া দেশটায়, তার দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়, তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হলো! যে ঘটনা বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় থাকার সময় ঘটেনি, সেটা আওয়ামী লিগের আমলে দেখতে হলো আমাদের! আরও মজার কথা শুনবেন? বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লিগের সাধারন সম্পাদক এবং দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড ওবায়দুল কাদের বলেছেন- "আমরা সরকারে আছি। সব ব্যাপারে মাথা গরম করলে চলবে না।"

কুষ্টিয়ায় ভেঙে ফেলা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য

২০০৮ সালে ভোটে জিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে, গত একযুগ ধরে তারাই আছে রাষ্ট্রক্ষমতায়। দেশে এখন একটাই রাজনৈতিক দল, বিএনপির নাম-নিশাণাও মুছে গেছে। প্রশাসন, পুলিশ, মিডিয়া- সবকিছু আওয়ামী লিগের নিয়ন্ত্রণে। এমনকি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কও অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় এখন ভালো। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় আছে, দেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়ছে, আমেরিকা বাংলাদেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, পাকিস্তান পর্যন্ত সেধে সেধে বাংলাদেশের বন্ধু হতে চাইছে- এর মাঝখানে একটা ব্যাপারই শুধু মাথায় ঢোকে না; এতকিছুর পরেও মৌলবাদী গোষ্ঠীটাকে কেন আওয়ামী লিগ এত তোয়াজ করে চলে? কেন তাদের সঙ্গে আপোষ করতে যায়?

হেফাজতের মামুনুল হক যখন হুমকি দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়ার, আওয়ামী লিগ বা ছাত্রলিগে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিল। দল হিসেবে প্রতিক্রিয়া জানাতে চৌদ্দ দিন সময় নিয়েছে তারা। এরপর স্রোত বুঝে ছাত্রলীগ হুংকার দিয়েছে, যুবলীগ মাঠে নেমেছে, মামুনুলকে প্রতহত করার ঘোষণা এসেছে, তাকে চট্টগ্রাম ঢুকতে দেয়া হয়নি, নারায়ণগঞ্জে তার সভা বাতিল করা হয়েছে- কিন্ত মাঝের ১৪ দিনের বিরতিতে যে ক্ষতিটা হয়েছে, সেই নীরবতায় ধর্মান্ধরা যে সাহসটা পেয়েছে, সেটার ফল তো হাতেনাতে পাওয়া যাচ্ছে এখন। যে হাত দিয়ে আঙুল উঁচিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, ভাস্কর্যের শরীর থেকে সেই হাতটাই তারা ভেঙে দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর নামটাকে আওয়ামী লিগ একটা রাজনৈতিক প্রোডাক্ট হিসেবে ব্যবহার করছে, নিজেদের স্বার্থে বঙ্গবন্ধুকে কুক্ষিগত করে রেখেছে- এমন অভিযোগ অনেক পুরনো। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাসিয়ে দেয়ার হুমকি আসার পরে যখন ১৪ দিন পর দলটাকে প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখি, যখন দেখি যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুরের পরেও দলটার সাধারন সম্পাদক 'মাথা গরম না করার ফর্মূলায়' অটুট থাকেন, তখন মনে প্রশ্ন জাগে, বঙ্গবন্ধুকে আসলেই তারা ভালোবাসেন তো? বঙ্গবন্ধুর এই অপমানে আমাদের গায়ে যদি আগুন ধরে যেতে পারে, তারা কী করে এত শান্ত থাকেন?

নির্মাণাধীন সেই ভাস্কর্য

ফেসবুকে একজন লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার কাজ আসলে শুরু হয়েছে অনেক আগেই। অনেক বছর আগে। ব্যাপারটা চোখে পড়েছে আজ। কথাটা মিথ্যে নয়। ক্রমাগত ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোকে লাই দিয়ে, সরকারী জমি বরাদ্দ দিয়ে চুপ করিয়ে রেখে তাদের আশকারা দেয়া হয়েছে, এরাও ভেবেছে, সরকার এদের তোয়াজ করছে, সরকারের কাছে তারা গুরুত্বপূর্ণ। তারা যা বলবে সরকার তা মানতে বাধ্য। তাই কখনও এরা শিক্ষানীতির বিরোধিতা করেছে, কখনও পাঠ্যবই থেকে গল্প-কবিতা বা ছবি সরানোর দাবী তুলেছে, সেগুলো সরকার মেনেও নিয়েছে চুপচাপ।

এরপর তাদের আবদারের সীমা ছাড়িয়ে ভাস্কর্যে গেছে, সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে সরানো হয়েছে থেমিসের ভাস্কর্য, এদের হুমকির কারনেই এয়ারপোর্টের সামনে থেকে সরেছে লালন ভাস্কর্য। আজ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে আঘাত এসেছে বলে এত আলোচনা, এই আঘাতের বীজটা কিন্ত বোনা হয়েছিল আরও আগে, বঙ্গবন্ধুর দল রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার সময়েই। যে প্রগতিশীলতা, যে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা বঙ্গবন্ধু করতেন, সেটাকে আওয়ামী লিগ পুরোপুরি বিসর্জন দিয়েছে। নইলে এই দিন দেখতে হতো না। বানরকে লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুললে পরিণতি কি হয়, দলটা এখন টের পাচ্ছে খানিকটা।

মন্দিরে প্রতিমা ভাংচুর দিয়ে শুরু হয়েছিল। এখন ভাস্কর্য ভাঙা হচ্ছে। কাল এরাই শিল্পচর্চা বন্ধ করতে বলবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলা অনুষদ বিলুপ্ত হবে। ছবি আঁকা বন্ধ হবে, সিনেমা-গান-নাটক সব বন্ধ হবে। আনিসুল হকে অন্ধকারের একশো বছর উপন্যাসে যে মৌলবাদী এক রাষ্ট্রের কথা লিখেছিলেন, সফলভাবে সেদিকেই হাঁটছি আমরা। এখনও সময় আছে, এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে তোয়াজ না করে, এদের সঙ্গে আপোষ না করে এদের সমূলে উৎপাটন করা হোক। এদের বুঝিয়ে দেয়া হোক, এটা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ, ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের দামে কেনা বাংলাদেশ, এই বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী চলবে, কোন ধর্ম ব্যবসায়ীর আঙুলের ইশারায় নয়।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা