ভুট্টোর কল্পিত ইসলামিক রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ ও অন্ধকারের একশো বছরের শঙ্কা
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ভাস্কর্যের সঙ্গে যে মূর্তিপূজার দূর-দূরান্তের কোন সম্পর্ক নেই, সেটা এদের কে বোঝাবে? ইট-সিমেন্ট-রড দিয়ে গড়া বোবা কিছু ভাস্কর্যকে যারা এতটা ঘৃণা করতে পারে, তাদের অন্তরে মানুষের প্রতি কতটা ঘৃণা লুকিয়ে আছে তাহলে?
দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষজন একটা বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন। যেহেতু সৌদি আরব পাকিস্তানের মিত্র, তারা বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে সরাসরি যাতায়াতেরও কোন ব্যবস্থা ছিল না। বাংলাদেশ থেকে যারা হজ করতে চাইতেন, তাদেরকে যেতে হতো কলকাতা বা দিল্লি হয়ে, ভারতীয় নাগরিক পরিচয়ে।
আরব দেশগুলোর এক সম্মেলনে সৌদি বাদশাকে সামনে পেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দেশের মানুষের এই ভোগান্তির কথা জানালেন। বঙ্গবন্ধুকে সৌদি আরবের বাদশাহ শর্ত দিয়েছিলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম বদলে ইসলামিল রিপাবলিক অব্লফ বাংলাদেশ নাম রাখতে। তাহলে নাকি সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। বাংলাদেশের হাজীরা সরাসরি বাংলাদেশী পরিচয়েই সৌদি আরবে হজ করার অনুমতি পাবে। বঙ্গবন্ধু সেদিন এই ন্যাক্কারজনক শর্তে রাজী হননি। যে চারটি নীতির ওপর মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। সৌদি আরবের অন্যায় দাবীর মুখে সেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিসর্জন দেননি বঙ্গবন্ধু, বরং তিনি সৌদি বাদশা'র মুখের ওপর জবাব দিয়েছিলেন-
"ইয়োর এক্সিলেন্সি, বেয়াদবি মাফ করবেন। আপনাদের দেশের নামও তো ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক সৌদি আরব না। এই মহান দেশের নাম আরব জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী ও রাজনীতিবিদ মরহুম বাদশাহ ইবনে সউদের সম্মানে ‘কিংডম অব সৌদি অ্যারাবিয়া’। কই আমরা কেউই তো এ নামে আপত্তি করিনি।"
পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে কিন্ত সৌদি আরব ঠিকই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ১৬ই আগস্ট টুঙ্গিপাড়ায় যখন বঙ্গবন্ধুর জানাজা পড়ানো হচ্ছে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে, তখন এসে হাজির হয়েছিল সৌদি আরবের সেই স্বীকৃতি। পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে খন্দকার মোশতাকের সরকারের উদ্দেশ্যে পাঠানো এক তারবার্তায় বাংলাদেশকে উল্লেখ করেছিলেন 'ইসলামিক রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ' হিসেবে। ভাবছেন, এত ইতিহাস কেন ঘাঁটছি? কারন আছে। ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে দেশকে যখন পেছনের দিকে হাঁটতে দেখি, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ঘৃণা আর রেষারেষির বীজ স্থাপন করা হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকত্র বিষবাস্পে ছেয়ে যাচ্ছে বাতাস- তখন শঙ্কা জাগে, তথাকথিত সেই ইসলামিক রিপাবলিক অফ বাংলাদেশের পথেই হাঁটছি না তো আমরা?
ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে আবারও মাঠে নামার পাঁয়তারা করছে ধর্মভিত্তিক কয়েকটা সংগঠন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, তৌহিদি জনতা ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস সহ বেশ কয়েকটা সংগঠনের নেতারা আলাদা আলাদাভাবে হুমকি দিয়েছেন, ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপনের চক্রান্ত নাকি তৌহিদি জনতা রুখে দেবে। ভাস্কর্যকে 'মূর্তি' হিসেবে উল্লেখ করে ধোলাইখালে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন না করে সেখানে বঙ্গবন্ধুর রূহের মাগফিরাত কামনায় আল্লাহর ৯৯ নাম অঙ্কিত স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের দাবি জানিয়েছে এদের মধ্যে একাংশ। আরেক দল বলেছে, ভাস্কর্য স্থাপন নাকি বঙ্গবন্ধুর আত্মার সঙ্গে গাদ্দারি করার শামিল। 'মূর্তি স্থাপন' বন্ধ করা না হলে তৌহিদি জনতা নিয়ে শাপলা চত্ত্বর কায়েম হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে।
ভাস্কর্য আর মূর্তির পার্থক্য যারা বোঝে না, তাদের কাছ থেকে এমন বয়ান আসবে- তাতে অবাক হবার কিছু নেই। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য হোক বা অন্য কারো- সেটাকে যতক্ষণ পূজা করা না হচ্ছে, ততক্ষণ কারো অসুবিধা হবার কথা নয়। অথচ এই লোকগুলো ভাস্কর্য স্থাপনের আগে থেকেই বিরোধিতা শুরু করেছে, কারন তাদের একটা ইস্যু দরকার কেবল, আন্দোলনের জুজু দেখিয়ে একদল একসময় রেলওয়ের জমি সহ আরও নানা ধরনের সুবিধা বাগিয়ে নিয়েছে সরকারের কাছ থেকে। অন্য দলগুলোই বা বসে থাকবে কেন? অতএব ধর্মের কাঁঠাল মানুষের মাথায় ভেঙে নিজের আখের গোছাও- এই হচ্ছে ফর্মূলা।
এর আগেও লেডি থেমিসের ভাস্কর্য সুপ্রীম কোর্টের সামনে থেকে সরানো নিয়ে বিরাট ইস্যু বানানো হলো, যেন ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা ওই একটা ভাস্কর্য সেখান থেকে না সরালে জাত-কুল-ধর্ম সব পদ্মা-মেঘনায় ভেসে যাবে! তারও আগে লালন ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে, মতিঝিলের বলাকা ভাস্কর্যে ভাংচুর চালানো হয়েছে, কারন ধর্ম মূর্তিপূজা সমর্থন করে না। অথচ ভাস্কর্যের সঙ্গে যে মূর্তিপূজার দূর-দূরান্তের কোন সম্পর্ক নেই, সেটা এই নির্বোধদের কে বোঝাবে? ইট-সিমেন্ট-রড দিয়ে গড়া বোবা কিছু ভাস্কর্যকে যারা এতটা ঘৃণা করতে পারে, এতখানি আক্রোশ নিয়ে ভাস্কর্যে হামলা চালাতে পারে- তাদের অন্তরে মানুষের প্রতি কতটা ঘৃণা লুকিয়ে আছে তাহলে?
এই লোকগুলোর ভাস্কর্যে সমস্যা, নারীর ক্ষমতায়নে সমস্যা, নারীরা বাইরে চাকরি বা ব্যবসা করলে সমস্যা, মেয়েরা ক্রিকেট-ফুটবল খেললেও তাদের সমস্যা হয়, টুর্নামেন্ট বন্ধের জন্য তারা মিছিল-মিটিং পর্যন্ত করে। সিনেমা বন্ধের জন্য তারা হুমকি দেয়, তাদের হুমকির কারনে হলে সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় মালিকেরা। এদের কর্মকাণ্ড দেখলে আনিসুল হকের 'অন্ধকারের একশো বছর' বইটার কথা মনে পড়ে, আর শঙ্কা জাগে, এরা আমাদের সেই অন্ধকারের দিকে টেনে নিচ্ছে না তো? এদের হুমকিতে ভয় পেয়ে তাদের অন্যায় আবদারগুলো মেনে নিতে নিতে সেই অন্ধকারকে আমরাই কি টেনে আনছি সামনের দিকে? তালেবান অধ্যুষিত আফগানিস্তান আর ইসলামিক বিপ্লবের পর শিয়া মিলিশিয়াদের হাতে থাকা ইরানের অবস্থা দেখে অজানা আতঙ্ক গ্রাস করে মনকে। এই আতঙ্ক থেকে মুক্তির কোন উপায় আছে কী?
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন