আমাদের তো গল্পের অভাব নাই! আমাদের বারো ভূঁইয়াদের কাহিনী নিয়ে, তাদের দ্বন্দ্ব নিয়ে দুর্দান্ত সিনেমা বানানো সম্ভব। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, বারো ভূঁইয়াদের কাহিনী পেলে সঞ্জয় লীলা বানশালি আরও দুর্দান্ত কিছু সিনেমা বানিয়ে ফেলতেন।
এক
আমাদের বেশিরভাগ রিয়েল ট্যালেন্টগুলোকে মেরে ফেলা হয়েছিল ১৪ ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। জহির রায়হানকে হারাই আরও কিছু সময় পর। অনেকে বলেন- জহির রায়হান থাকলে আজকে দেখিয়ে দিতাম। আমার কেন যেন কিছুটা হাসি পায়। আসলেই কি আমরা পারতাম দেখিয়ে দিতে? স্বাধীনতার পর তো কম প্রতিভা পাইনি, তাদের দিয়ে কি আমরা দেখিয়ে দিতে পারছি দুনিয়াকে?
বিদেশী বংশোদ্ভুত আমার কাজিনকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম- হুমায়ূন ফরিদীকে চিনো? সে আমাকে ইংরেজিতে উত্তর দিল- হ্যাঁ, চিনি, ভালো বই লিখেন। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বললাম- সেটা হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ূন ফরিদী না। ভাবলেশহীনভাবে সে বলল- ও আচ্ছা। সে 'ও আচ্ছা' এই কারণেই বলতে পারে, কারণ তার কাছে উপস্থাপন করা হয়নি ফরিদী কী জিনিস। ফরিদীকে না চেনাটা যে বাংলাদেশী হিসেবে লজ্জার, সেই বোধটা তার মাঝে আসেনি।
যেহেতু সে বাংলা কম বুঝে, সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই সে ফরিদীর সিনেমা বুঝার জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল সহ দেখতে চাইবে। অথচ ইউটিউবে আমার জানামতে একমাত্র জয়যাত্রা ছাড়া ফরিদীর আর কোন সিনেমা ইংরেজি সাবসহ নাই। তাহলে স্বাধীনতার পর এতটা বছর ধরে আমরা কী করলাম? আন্তর্জাতিক লেভেলে নিজেদের সিনেমা আর আর্টিস্টদের পরিচিত করাতে হলে ইংরেজির বিকল্প নাই। সেই উদ্যোগ কতজন নিয়েছি?
দুই
৪০ বছরের বেশি হয়ে গেছে একটা দেশের স্বাধীনতার, এখনো বক্স অফিস বলতে একটা জিনিস বানাতে পারলাম না আমরা- কতটা লজ্জার একটা ব্যাপার! বেদের মেয়ে জোসনার আয়ের কথা বলতে গেলে এখনো 'প্রায় ৪০ কোটি' কথাটা বলতে হয় আমাদের? কেন এখনো আমাকে 'প্রায়' বলতে হবে? কেন আমি দঙ্গল সিনেমার নেট আয় 3,74,53,00,000 রুপির (সূত্র- বক্স অফিস ইন্ডিয়া) মতো নিজের দেশের কোন একটা সিনেমার আয় বলতে পারি না?
তিন
নিঃসন্দেহে আমাদের সবচেয়ে গর্বের ইতিহাস আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের কিছু সিনেমা দেখলে মনে হয়- মুক্তিযুদ্ধ মানে শুধুই গোলাগুলি আর নারীদের ধর্ষণ। ৭১ এর গেরিলা নামের একটি সিনেমা রিলিজ পেয়েছিল, সেই সিনেমার পোস্টার একটু মনোযোগের সাথে দেখলে বুঝতে পারবেন আমার কথা।
অথচ মুক্তিযুদ্ধ মানে শুধু গুলি আর ধর্ষণ না! ধরুন, একজন ১৯৭১ সালের পকেটমার নিজের ধান্দা ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধে নামলো- তার কাছে মুক্তিযুদ্ধ কেমন ছিল? একজন হিজড়ার ভুমিকা কী ছিল ১৯৭১ এর যুদ্ধে? আমরা কি এভাবে চিন্তা করেছি কখনও? আমাদের চিন্তার গণ্ডিটা এত সীমিত কেন? এই প্রশ্নের উত্তরেও কি সেই পুরনো 'বাজেটে'র অজুহাত দেয়া হবে?
জহির রায়হান তো কোন যুদ্ধ না দেখিয়ে জীবন থেকে নেয়াতে পূর্ব পাকিস্তানের উপরে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন- জাস্ট একটা যৌথ পরিবারের ঘটনার সাহায্যে! ছেলে ভাত খেতে চেয়েছিল মায়ের কাছে, সেই মা তাই ১৪ বছর ধরে ভাত খান নাই- মা বইয়ের এই কাহিনী নিয়ে কি মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা বানানো যায় না?
চার
পাশের দেশের সঞ্জয় লীলা বানশালি রাজা রানীদের প্রেম কাহিনী নিয়ে একের পর বিরাট সব সিনেমা বানিয়ে বক্স অফিস কাঁপিয়ে ফেলেন। সে ধরনের সিনেমা বানানোর মতো বাজেট আমাদের নাই আপাতত। কিন্তু আমাদের তো গল্পের অভাব নাই! আমাদের বারো ভূঁইয়াদের কাহিনী নিয়ে, তাদের দ্বন্দ্ব নিয়ে দুর্দান্ত সিনেমা বানানো সম্ভব। আমাদের কয়জন পরিচালকেরা জানেন সেইসব কাহিনীর কথা?
ঈশা খাঁ আর মানসিংহ এর যুদ্ধের কথা কয়জন জানেন? তারা কি বই পড়েন? শহিদুল ইসলাম খোকন বলতেন, একজন ডিরেক্টরকে নাকি প্রতিদিন ৩ ঘণ্টার মতো বই পড়তে হবে। আমাদের কয়জন পরিচালক সেটা করেন? আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, বারো ভূঁইয়াদের কাহিনী পেলে সঞ্জয় লীলা বানশালি আরও দুর্দান্ত কিছু সিনেমা বানিয়ে ফেলতেন।
পাঁচ
এত এত টিভি চ্যানেল, দেখার কেউ নাই। কীভাবে সম্ভব দেখা? সব চ্যানেলে মানসম্পন্ন প্রোগ্রাম হলেও কি একজন মানুষের পক্ষে দেখা সম্ভব? ১৯ টার মতো বেসরকারি এফ এম আছে, এত রেডিও কি শোনা সম্ভব মানুষের পক্ষে? ফলাফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে, চালু হওয়ার পাঁচ মাস পর তালা ঝুলছে বাংলা টিভির মত টিভি চ্যানেলে। এত রেডিও আর টিভি চ্যানেল না করে সমপরিমাণ সিনেমা হল বানালে কি খুব ক্ষতি হতো? বরং সেটাই তো সবার আগে দরকার!
ছয়
একটা দেশের সিনেমার উন্নয়নে খুব দরকারি ভুমিকা রাখে একটা ফিল্ম ম্যাগাজিন। আমাদের একটা ভালো ফিল্ম ম্যাগাজিন পর্যন্ত নাই! ছিল একসময়- চিত্রালি। সে কি দিনই না ছিল! আলোচনা, সিনেমা নিয়ে সমালোচনা, কোন অভিনেতা অভিনেত্রীর পারিশ্রমিক কত, কার সাথে কার প্রেমের গুঞ্জন- কি ছিল না সেখানে! পাঠকের প্রশ্নের উত্তরও থাকতো, যিনি উত্তর দিতেন, তার নাম ছিল- উত্তরদা! চিন্তা করা যায়? এতটা সৃজনশীল চিন্তা ভাবনা করা জাতির আজ এই অবস্থা কীভাবে হল সেটা কিছুতেই মাথায় আসে না!
সমালোচনা মানুষকে শুদ্ধ করে, নিজের ভুল বুঝতে সাহায্য করে। দিনদিন আমরা এত অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি যে সামান্যতম সমালোচনা আমাদের সহ্য হয় না। অথচ সিনেমা ভালো না হলে আনন্দলোক থেকে শুরু করে ফিল্মফেয়ার, ভ্যারাইটি, হলিউড রিপোর্টার যে ভাষায় সমালোচনা করে, সেগুলো আমাদের কিছু পরিচালক পড়লে হয়ত মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতেন।
আবার সমালোচনাতেও সমস্যা আছে! কিছু জায়গায় সিনেমা রিভিউ করতে গিয়ে সব স্পয়লার দিয়ে দিচ্ছেন। যেমন- প্রথম সারির একটি ইংরেজি পত্রিকা সে সময় সদ্য রিলিজ পাওয়া সিনেমা 'রাজনীতি'র রিভিউ করতে গিয়ে সেখানে সিনেমার মেইন টুইস্ট বলে দিয়েছেন- কোন ধরনের আগাম সতর্কতা ছাড়াই। এগুলো দেখার কেউ নাই? ইংরেজি সিনেমা হলে কি লেখক এটা করতেন? বাংলা সিনেমা বলেই কি এত অবহেলা?
নির্বাচনের আগে নেতারা যেমন বলেন- জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস, তেমনি আমি বলি- দর্শকই সকল ক্ষমতার উৎস। আপনি চাইলেই অনেক কিছু সম্ভব। আমরা যারা নব্বই এর বাচ্চা, তারা শুক্রবার বিকাল ৩ টা ২০ এর বাংলা সিনেমার কথা এখনো ভুলি নাই। ভোলা সম্ভব না। আমাদের সন্তানরা কিন্ত সেটা পাচ্ছে না। আমরা মহাব্যস্ত। একজনের আরেকজনের দিকে তাকানোর সময় নাই, আর টিভি পর্দায় তাকানো তো পরের ব্যাপার!
তাছাড়া বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণা তো আছেই। আপনি চাইলেই প্রতি শুক্রবার ঐ টাইমটা ফ্রি রেখে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ইউটিউব এর সামনে বসতে পারেন, ভালো একটা বাংলা সিনেমা প্লে করে নিজের সন্তানকে দেখাতে পারেন। সারা বিশ্বের ভালো অভিনেতাদের চেনানোর পাশাপাশি নিজের দেশের অভিনেতাদের চেনানোর দায়িত্ব কিন্তু আপনার।
ফুয়াদের 'তুমি এসেছিলে পরশু' শুনে আপনার বাচ্চা যেন তাকেই এই গানের গায়ক মনে না করে বসে, এই গানের মেইন গায়ক যে শচিন দেব বর্মণ- সেটা জানানোর দায়িত্ব আপনার। আপনার সন্তান বানান করে পড়া শেখার পরের মুহূর্তেই তার হাতে বই তুলে দেয়া দরকার আপনার, অথচ আপনি সবচেয়ে বড় ভুলটা করছেন তার হাতে স্মার্ট ফোনটা তুলে দিয়ে।
আপনার সন্তানকে চিন্তা করতে শেখাচ্ছেন না আপনি, সব রেডিমেড তুলে দিচ্ছেন। যার ফলাফলটা হচ্ছে ভয়াবহ। যত ব্যস্তই থাকেন না কেন, পরিবারের সবাইকে নিয়ে হলে যাওয়ার চেষ্টা করুন। আপনার প্রবল ইচ্ছা থাকলে সব সম্ভব। আমাদের সিনেমা যেন আমাদের কথা বলে, আমরা যেন আমাদের সিনেমাতে আমাদের গল্প দেখতে পাই, তারচেয়েও বড় ব্যাপার- আমরা যেন আমাদের সিনেমাতে 'মানুষের' গল্প দেখতে পাই।
কৃতজ্ঞতা- বাংলা চলচ্চিত্র ফেসবুক গ্রুপ
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন