কোন সমস্যায় পড়লে কুয়েতের জালালবাদ সমিতি যতোটা পাশে থাকে অ্যাম্বাসি ততোটাও থাকে না? অথচ দেখেন বাকি সব দূতাবাস তাদের নাগরিকদের পাশে আছে। আমি জানি না তাদের কী উত্তর দেব?
"অহনো এয়ারপোর্টে। আরও ৩০ মিনিট লাগবো"- টেলিফোনে অপরপ্রান্তে থাকা কাউকে কথাটা বলছিলেন বিমানে আমার পাশে বসা সহযাত্রী। তার চোখেমুখে বেশ উত্তেজনা। অনেকদিন পর দেশে আসার সেই উত্তেজনা চোখে পড়বে যে কারও।
ঢাকা থেকে যাচ্ছি সিলেট। বিমানের ৭৩৭-৮০০ ডোমেস্টিক ফ্লাইট। টেলিফোনে পরিবারকে খবর দেয়া সহযাত্রী ভাই তার নাম জানালেন এনামুর। কুয়েত থেকে ঢাকায় এসেছেন। সেখান থেকে কানেকটিং ফ্লাইটে সিলেটে। তার পাশে বসা আরেকযাত্রী জিয়াউরও কুয়েত থেকে একই ফ্লাইটে এসেছেন। তিনিও সিলেট যাবেন।
কুয়েতের অবস্থা এখন কেমন জানতে চাইলে তারা জানালেন, মিডিল ইষ্টে কুয়েতটাই অর্থনৈতিকভাবে ভালো আছে। একেকজন বাংলাদেশি এখনো গড়ে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা আয় করেন। বাংলাদেশিরা কোন কোন খাতে কাজ করে জানতে চাইলে বললেন, ক্লিনিং কোম্পানিগুলোতে এখন সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি। কোন এলাকার লোকজন বেশি জানতে চাইলে বলেলন, চট্রগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লার। তাদের অনেক ব্যবসা বানিজ্যও আছে।
কুয়েতে বাংলাদেশিদের সমস্যা কী জানতে চাইলে তারা বলেন, যাওয়ার খরচ খুব বেশি। ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকুরি করা জিয়া বললেন, দেখেন একজন ইন্ডিয়ান, কুয়েত আসে আশি হাজার থেকে এক লাখ বাংলা টাকায়। শ্রীলঙ্কানদেরও তাই। নেপালিদের এক থেকে দেড়লাখ টাকা লাগে। কিন্তু একজন বাংলাদেশির কুয়েতে আসতে ছয় থেকে সাত লাখ টাকা লাগে। কেন এতো খরচ?
কুয়েতের শ্রমবাজার নিয়ে প্রথম আলোয় থাকতে অনেকবার লিখেছি। তখনই শুনেছি খরচের কথা। তবে বাংলাদেশের অন্যতম এই শ্রমবাজারটি ২০০৬ থেকে ২০১৩ এই সাত বছর বন্ধ ছিল। বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত গড়ে প্রতিবছর ১০ হাজার লোক কুয়েতে গেছেন।
১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে কুয়েতের পক্ষে অবস্থানের কারণে দেশটিতে বাংলাদেশের সুনাম বেড়ে যায়। এরপর ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গড়ে ২৫ হাজার লোক দেশটিতে গেছেন। ২০০১ সালের পর তা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে এবং প্রতিবছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার লোক কুয়েতে যেতে থাকেন। কিন্তু ২০০৭ সালের শেষে বাজারটি বন্ধ হয়ে যায়।
কেন বন্ধ হলো বাজারটা? কুয়েতের বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) আলী রেজা ভাই আমাকে তখন বলেছিলেন, ২০০৬ সালের শেষে হঠাৎ করেই কিছু বাংলাদেশি হত্যা, ধর্ষণসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৬ সালের অক্টোবরে কুয়েত সরকার বাংলাদেশ থেকে লোক নেওয়া বন্ধ করে দেয়।
জিয়া ও এনাম আজ আমাকে বলছিলেন, কুয়েতে যেই অপরাধ করুক দায় বাংলাদেশিদের। কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যখন বাংলাদেশিরা করে তার দায় বাংলাদেশের। যখন পাকিস্তানি বা ভারতীয়রা করে তখন লেখা হয় এশিয়ান। কুয়েতিরা ধরে নেয় এটাও তাহলে বাংলাদেশি।
২০১৪ সালে বাজারটা আবার চালু হলে গত ৫ বছরে নতুন করে দেড়লাখের মতো কর্মী গেছেন। তবে ২০১৭ সালে যেখানে ৫০ হাজার গেছেন ২০১৮ সালে সেখানে ২৭ হাজার আর গত বছর তার অর্ধেক গেছে। বোঝাই যাচ্ছে বাজারটা আবার সংকুচিত হচ্ছে।
বিমানে ক্ষনিকের আড্ডায় এই প্রবাসীরা আমার আপন হয়ে যান। কিছুক্ষণ পরেই তারা জানতে চায়, আমার বাড়ি সিলেট কী না? না শুনে একটু মন খারাপ করে বলে কেন যাচ্ছি? একটা মিটিং শুনে জানতে চায় আমি কী করি? বললাম প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করি। সাংবাদিকতা করতাম। এখন লেখালেখি আর ব্র্যাকে। সিলেটের স্যার আবেদের ব্র্যাক শুনলে সবসময়ই দেখেছি সিলেটিদের আগ্রহ বেশি।
প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করি শুনে তারা বললেন, বাংলাদেশ দূতাবাসটা আপনারা ঠিক করতে পারেন না? সেজন্য কেন লেখেন না? ঠিকমতো সেবা পাই না। দালালদের উৎপাত। আগে পাসপোর্ট পাওয়া যেতো একমাসে। এখন চারমাস লাগে। এসব কে দেখবে?
কোন সমস্যায় পড়লে কুয়েতের জালালবাদ সমিতি যতোটা পাশে থাকে অ্যাম্বাসি ততোটাও থাকে না। অথচ দেখেন বাকি সব দূতাবাস তাদের নাগরিকদের পাশে আছে। আমি জানি না তাদের কী উত্তর দেব? এই দেশে নাগরিকদের সেবা পাওয়াটাই তো সবচেয়ে বড় সংকট।
ততোক্ষণে কেবিন ক্রুর ঘোষণা আসে ক্যাপ্টেন ইমরান ও ক্রুদের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা। তিন হাজার ফুট উঁচু দিয়ে ৩০ মিনিটে আমরা পৌঁছে যাবো সিলেট। প্লেন আকাশে উড়ে। আমি জানালা দিয়ে ঢাকা শহরটা দেখার চেষ্টা করি। প্রচণ্ড ধুলো আর কুয়াশার কারণে অষ্পষ্ট সব। এলোমেলো ভবনগুলো দেখলেই বোঝা যায় পরিকল্পনাহীম এক রাজধানী শহর যেখানে নাগরিকের জীবন মানেই দুর্ভোগ।সেইসব দুর্ভোগ দূর করার মধুর সব প্রতিশ্রুতি দিয়ে এইদেশে একের পর এক নির্বাচন হয়। কিন্তু সমস্যার সমাধানের বদলে আরও বাড়ে।
আর নাগরিক সেবা? জিয়া ও এনামুরের প্রশ্ন ঘুরপাক খায় আমার মাথায়। ক্রমেই অষ্পষ্ট থেকে আরও অষ্পষ্ট হয়ে ওঠে শহরটা। দূরের হয়ে যায় সবকিছু। আরও দূরের।