বিনা অপরাধে কারাদণ্ড ভোগ করা মানুষজনের তালিকা করতে বসলে, সে তালিকা দীর্ঘ হবে ক্রমশই। কোনো দোষ নেই, কোনো অপরাধ নেই, তাও বছরের পর বছর ধরে শাস্তি ভোগ করে গিয়েছেন তারা। কেন?
আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থার ওপরে খুব কম মানুষেরই আস্থা আছে। অবশ্য এর পেছনে সঙ্গত কারণও আছে। বছরের পর বছর ধরে মামলার মীমাংসা না হওয়া, টাকাপয়সা-পেশি-ক্ষমতা দিয়ে মিটমাট করিয়ে নেওয়া সহ অনেক কারণই বলা যাবে একে একে। এগুলোতে আমরা অভ্যস্তও হয়ে গিয়েছি। গা সওয়া হয়েছে পুরো বিষয়টাই। কিন্তু তাও মাঝেমধ্যে এমন দুয়েকটা খবর চোখে পড়ে, আমাদের ভোঁতা হয়ে যাওয়া মস্তিষ্কও তখন অবাক হয়ে যায়। আমাদের আক্ষেপ আরেকটুখানি বেড়েও যায় কেন যেন।
এই যেমন গতকালকেই জানা গেলো, বিশ বছর কনডেম সেলে থাকার পর মুক্তি পেতে যাচ্ছে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া এক আসামী। ভাবতে পারেন? ফাঁসির আসামী ছিলো সে। বিশটা বছর জেল খেটেছে। বিশ বছর একেবারে নাই হয়ে গিয়েছে জীবন থেকে। এখন এসে জানা গেলো, তার কোনো দোষই নেই। কী অদ্ভুত না! ফাঁসির আসামী হয়ে জীবন কাটিয়েছেন কনডেম সেলে। যে সেলে প্রত্যেক মানুষের সকালে ঘুম ভাঙ্গে মাথার উপর এই চাপ নিয়ে যে, পরদিনের সকালটা তার হয়তো দেখা হবে না। এখানে যারা থাকে, তারা বলতে গেলে একরকম 'জীবন্ত লাশ'ই। ২০০০ সালে ফাঁসির আদেশ দেয়ার পর থেকে তিনি এখানেই জেল খাটছেন! অপরাধ? কোনো অপরাধ নেই।
ধরলাম তিনি এখন মুক্ত হয়েছেন। তিনি এখন করবেন কী? কোথায় কী কাজ তিনি করবেন? জীবন থেকে যে বিশটা বছর চলে গেলো, সেগুলো কে ফেরত দেবে? এলাকার মানুষ, যারা তাকে চিনতো, তারা যে তার নামের পাশে 'ফাঁসির আসামী' 'খুনী' ট্যাগগুলো দিয়েছিলো, তারা কি তা ভুলে যাবে? জীবন থেকে এতগুলো বছর যে স্রেফ 'হাওয়া' হয়ে গেলো, তাও অন্য মানুষের ভুলে, এর ক্ষতিপূরণ সরকার দেবে? কেউ কী দেবে? সময়ের ক্ষতি কীভাবেই বা পূরণ করা সম্ভব?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলে না। জীবন থেকে দুই যুগ হারিয়ে ফেলা মানুষটির জন্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আমাদের করার কিছুই নেই আসলে। করার কিছু থাকেওনা কখনো।
এই হতভাগা মানুষটির নাম শেখ জাহিদ। কিন্তু শেখ জাহিদই কিন্তু এই তালিকায় প্রথম বা শেষ নাম নয়। জাহালমের ঘটনা নিশ্চয়ই মনে আছে সবার। বিনা অপরাধে ১০৯২ দিন জেল খাটার পর মুক্ত হয়েছেন যিনি। অপরাধ? নেই। যাকে মুক্ত করতে পুরো পরিবার হয়েছে সর্বস্বান্ত। কিন্তু জাহালম কী সেই ১০৯২ দিন আর ফেরত পাবে? যে চাকরী ছিলো, সেটি চলে গিয়েছে। সে চাকরী তো আর ফেরত আসবে না। কী করবে জাহালম?
জজ মিয়ার গল্পও তো আমরা সবাই জানি। ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার সাজানো অপরাধী এই মানুষটিকে নিয়ে কিছু নাই বলি বরং। বিনা অপরাধে বছরের পর বছর জেল কাটিয়েছেন, পরিবার পথে বসেছে। এ গল্প কাকে বলা যায়? কে শুনবে? কে বুঝবে?
অপরাধ না করেও পুলিশ ও আইনজীবীর ভুলে বাবলু শেখ নামে এক নিরপরাধ শ্রমজীবীকে ১৮ বছর ধরে আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছিলো। হাজত খাটতে হয়েছিলো দুই মাসেরও বেশি।
এরকম জাহিদ, জাহালম, জজ মিয়া, বাবলু শেখ এর সংখ্যা মোটেও কম না। খুঁজতে বসলে এ তালিকার নাম শুধু বাড়বেই। মোটেও কমবে না। আদালতের চৌহদ্দিতে এরকম কত নিষ্পাপ মানুষজন প্রতিনিয়ত অন্যের ভুলে ভোগ করে যাচ্ছেন শাস্তি, তার খবর কে রাখে? কেউ কী রাখে? আমাদের এই আক্ষেপও তো সাময়িক। সামনে আরেক ইস্যু আসবে। আমরা সেই ইস্যুতে ব্যস্ত হবো, ভুলে যাবো তাদের।
এদিকে প্রতিদিন বাড়তেই থাকবে ভুল বিচারে দণ্ডপ্রাপ্ত দুর্ভাগাদের সংখ্যা। এ তালিকা কখনোই ছোট হবে না। কখনোই না। আমাদের কী করার আছে? জানি না। সরকার কী করছে এরকম হতভাগ্য মানুষদের জন্যে? তাও আমরা জানি না।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন