যে দেশে ম্যানহোলের ঢাকনা/ল্যাম্পপোস্টের লাইট চুরি হয়ে যায়, সিটি কর্পোরেশনের ডাস্টবিন নিজেরাই গায়েব করে ফেলি; সেখানে কয়েকশ' কোটি টাকার প্লেন খেয়ে ফেলার লোভ সামলানো আসলেই কঠিন। খুব কঠিন।
‘সোনার তরী’ ও ‘অচিন পাখি’; বিমান বাংলাদেশ এয়ালাইনসের বহরে সর্বশেষ যুক্ত হওয়া বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির নতুন দুটি ড্রিমলাইনার। গত ২৮শে ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উদ্ভোধন করেন বিমানগুলো। মাসখানেক ধরে বোয়িং কোম্পানির সঙ্গে দর-কষাকষি করে প্রতিটি ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার কেনা হয় বর্তমান বাজারমূল্যের অর্ধেক দামে ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। ২০৬ ফুট দৈর্ঘ্যের বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এই উড়োজাহাজ ড্রিমলাইনার একটানা ১৬ ঘণ্টার বেশি উড়তে পারে। অন্য উড়োজাহাজের চেয়ে এর জ্বালানি খরচও ২০ শতাংশ কম। প্রতিটিতে আসন সংখ্যা ২৯৮টি। এর মধ্যে বিজনেস ক্লাস ৩০টি, প্রিমিয়াম ইকোনমি ক্লাস ২১টি এবং ২৪৭টি ইকোনমি ক্লাসের আসন রয়েছে।
বিমানগুলো আন্তর্জাতিক মানের হলেও, নিজেরা যে নিম্নমানের সেইটা বুঝিয়ে দিতে খুব একটা বেশি সময় নেইনি আমরা। ফ্লাইট উদ্বোধনের মাত্র তৃতীয় দিনেই সগরৌবে নিজেদের থার্ড ক্লাস প্রমাণ করে দিয়েছি। সম্প্রতি, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কেবিন ক্রু জুবায়ের রহমান তার ফেসবুক আইডিতে কিছু ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেন। তাতে দেখা যায়, বিমানের সম্মানিত বাংলাদেশি যাত্রীবৃন্দ কিভাবে সিটের উপরে দাঁড়াচ্ছে, সিটের কাপড় টেনে তুলেছে, ডিজিটাল মনিটর খুলে ফেলেছে নিয়ে যাওয়ার জন্য, টয়লেটের দরজা ভেঙ্গে ফেলেছে, প্লেনের ভেতরে ময়লা ফেলে ছোটখাটো ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলেছে। এমনকি সিটের পাশেই মলত্যাগ করার অভিযোগ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। দেখে মনে হচ্ছিলো, এটা সদরঘাটের কোনো লঞ্চ টার্মিনাল।
জানি না কোন বিশেষণে বিশেষায়িত করবো এদের। নিজ খাওয়ার পাত্রে ফুটো করবার জন্য এদের কাছে রয়েছে ‘আমাদের সম্পত্তি’ টাইপ অসাধারণ লজিক। আচ্ছা সে লজিকই মেনে নিচ্ছি। তো সম্পত্তি যদি নিজেদেরই হয়, তাহলে সেটা রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব কার? অন্য দেশের নাগরিকদের?
গত বিশ্বকাপে আমরা দেখেছিলাম, জাপানি দর্শকেরা খেলা দেখা শেষে নিজেরাই স্টেডিয়াম পরিষ্কার করে দিয়ে গিয়েছিলেন। কথায় কথায় আমরা নিজের দেশের সাথে অন্য দেশের তুলনা করি। তাহলে নাগরিকদের আচরণের তুলনা কেন আসবে না? আমরা কি আসলেই বর্তমান বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার মতো কমনসেন্স অর্জন করতে পেরেছি? এই যুগের যোগ্য উত্তরসূরি কি তৈরি করতে পারছি আমরা? বহির্বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলবার মতো দায়িত্ববান হতে আমাদের আরো কয়শ’ বছর লাগবে?
বাংলাদেশিরা শুধু বাংলাদেশ বিমানেই এমন করে তা কিন্তু না। যেকোনো এয়ারলাইনসেই দেখা যায় বাংলাদেশিদের এ তাণ্ডব। চক্ষুলজ্জা বলেও যে একটা ব্যাপার আছে সেটা আমাদের দেখলে বোঝার কোনো অবকাশ নেই। আমরা খুব গর্বের সাথে নোংরামি করতে পারি। কারণ, আমাদের আত্মসম্মানবোধ সারা বছর হানিমুনে থাকে।
যে দেশে ম্যানহোলের ঢাকনা/ল্যাম্পোস্টের লাইট চুরি হয়ে যায়, সিটি কর্পোরেশনের ডাস্টবিন নিজেরাই গায়েব করে ফেলি। সেখানে কয়েকশ' কোটি টাকার প্লেন খেয়ে ফেলার লোভ সামলানো আসলেই কঠিন। খুব কঠিন।