আমরা ইতালির ভেনিস শহরের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হওয়ার পর আক্ষেপ করা মানুষ। কিন্তু, আমাদেরও একটা 'ভেনিস' আছে। প্রকৃতির মধ্যেই জীবনের বিচিত্রতা মুগ্ধ আপনাকে করবেই।

অনেকদিন ধরেই বাংলার ভেনিস বলে খ্যাত বরিশালের ভাসমান পেয়ারা বাজারে যাওয়ার ব্যাপারটা মাথায় ঘুরছিল। বছরের কয়েকটা মাস এই বাজার বেশ জমজমাট থাকে। বিস্তৃত জলরাশি ধারণ করে যেনো পেয়ারা রঙ্গ, পেয়ারা পাতার সবুজে সবুজে চেয়ে যায় চারদিক। নৌকায় করে চলতে থাকে পেয়ারার বেঁচাকেনা।

থাইল্যান্ডের ফ্লোটিং মার্কেট সম্পর্কে আমাদের জানা আছে, আমরা ইতালির ভেনিস শহরের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হওয়ার পর আক্ষেপ করা মানুষ। কিন্তু, আমাদেরও একটা 'ভেনিস' আছে। বাংলার এই ভেনিস প্রকৃতির এক উপহার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ভাসমান বাজার রীতি চালু আছে। এসব ভাসমান বাজার দেখতে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়ও লক্ষ্য করা যায়। কেউ কাশ্মীরে গেলে সে অবশ্যই ডাল লেকের ভাসমান বাজার না দেখে ফিরতে চায় না। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ায় কেউ গেলে পর্যটকরা কিছুটা সময় কাটিয়ে আসেন বিশেষায়িত ভাসমান বাজারে। আমাদের দেশেও এমন একটি ভাসমান বাজার আছে।

বরিশালকে এমনিতেই মানুষ বাংলার ভেনিস বলে জানেন। এই জেলা জুড়ে জলের অবিরাম বয়ে চলা৷ আর এই বাংলার ভেনিস বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি, পিরোজপুর, স্বরুপকাঠির হাজার হাজার একর জুড়ে আছে পেয়ারার বাগান। পেয়ারার সিজনে এই অঞ্চলগুলো গমগম করতে থাকে পেয়ারায়। এই পেয়ারাগুলোর বেচাকেনা চলে ছোট ছোট নৌকায়। এক বিস্তৃত জনপদের মানুষের জীবিকার মূলে এই ভাসমান পেয়ারা বাজার। এজন্যেই এই জায়গাটি একটু বেশিই স্পেশাল। কারণ, অন্যান্য দেশের মতো এই ভাসমান পেয়ারা বাজারটি কৃত্তিমতায় ভরপুর না, এখানে জীবন বাস্তবতা মেনে চলে। এখানে যা কিছু আছে সবটাই আদি অকৃত্রিম। আর এই জন্যেই এই ভাসমান পেয়ারা বাজারে গিয়ে দেখে আসা যায়, জলঘেরা অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন, তাদের সহজতা। আর প্রকৃতির মধ্যেই এই জীবনের বিচিত্রতা মুগ্ধ আপনাকে করবেই। 

প্রকৃতির মধ্যে জীবনের বিচিত্রতা আপনাকে মুগ্ধ করবে 

এই জলের জীবনের সৌন্দর্য দেখতে এই উইকেন্ডেই চলে যেতে পারেন পেয়ারা বাজারে, বাংলার ভেনিস আপনার অপেক্ষায়। আগে থেকে জেনেছিলাম, বাংলাদেশে উৎপাদিত পেয়ারার ৮০ ভাগই আসে এই অঞ্চলের ২৪ হাজার একর পেয়ারার বাগানগুলো থেকে। এই বাগানগুলো ঘিরে ছোট ছোট খাল বয়ে গেছে। বর্ষার সময়ে তাই বাগানদের মানুষদের প্রধান আশ্রয় নৌকা। নৌকায় করে পেয়ারা বিকিকিনি হয়ে বাংলার ভেনিসের পেয়ারা চলে যায় দেশের নানা প্রান্তে।

বিক্রেতারা এখানে নৌকায় করে পেয়ারা বোঝাই নিয়ে খোঁজেন ক্রেতাকে। পেয়ারা ভীষণ রকম স্বস্তা এই অঞ্চলে। পেয়ারার আকারভেদে এক মন পেয়ারা বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে! ভাসমান বাজার সারাবছরই থাকে। বরিশালের বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীতে প্রতি শনি এবং মঙ্গলবার বসে বিশাল ধান আর চালের ভাসমান বাজার। আছে ভাসমান সবজি বাজারও! তবে সবচেয়ে বেশি জমজমাট থাকে পেয়ারার সিজনে। এই সময় সপ্তাহে সাত দিনই জমজমাট এই অঞ্চল। 

এই উইকেন্ডেই চলে যেতে পারেন ভাসমান পেয়ারা বাজারের উদ্দেশ্যে। সপ্তাহের ক্লান্ত ব্যস্ত দিনগুলোর পরে একদম রিল্যাক্স মুডে একটু হাওয়া বদলে আসার জন্যে এই জায়গাটি বেশ ভাল। কিছুই করতে হবে না, তেমন কোনো আয়োজনেরও দরকার নেই। বৃহস্পতিবার বিকেলের দিকে সদরঘাটের দিকে চলে যান। দুই ভাবে লঞ্চ যায়। রাত আটটা থেকে নয়টায় যায় বরিশালের বিশাল বিশাল সুন্দর লঞ্চগুলো। এগুলো দিয়েও যেতে পারেন, সেক্ষেত্রে একটু সময় বেশি লাগবে মূল পেয়ারা বাজারে পৌঁছাতে। আমরা গিয়েছিলাম হুলারহাটের লঞ্চে। সন্ধ্যে ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে এই লঞ্চগুলো ছেড়ে যায়। ভাড়াও স্বস্তা, ডেকে মাত্র দুইশ টাকা। সিঙ্গেল কেবিন হাজার টাকা। রাতের নদীর মোহনীয়তা চুপ করে উপভোগ করতে পারেন লঞ্চের রেলিং ধরে। কখনো এক দুই কাপ চা হাতে দেখতে পাবেন রাতের জীবন। মন হঠাৎই বেশ শান্ত হয়ে আসবে। সারা সপ্তাহের ক্লান্তি ধীরে ধীরে ঝরে যাবে। আর আপনার মনকে একেবারেই চনমনে করে দেবে সকাল বেলার ভাসমান পেয়ারা বাজার। 

সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে লঞ্চ থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে নাশতা করে নিলাম। এবার ভাড়া করতে হবে ভাসমান পেয়ারা বাজারে ঘুরার নৌকা। নৌকা ভাড়া দরাদরি করে নিতে হয়। মোটামুটি হাজার বারোশোর মধ্যে নৌকা পেয়ে যাবেন। গ্রুপ একটু বড় হলে এই ভাড়া একদমই গায়ে লাগবে না। নৌকার মাঝি পুরো ভাসমান পেয়ারা বাজারটাই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবে।

জীবন এখানে জলে ভাসে। মানুষের জীবিকার কতরকম ভাবে ব্যবস্থা হয় জগতে। এখানে খাল বিলের ফাঁকে ফাঁকে যেতে যেতে আপনার মনে হবে সবুজ গালিচার মধ্যে নৌকা ভেসে যাচ্ছে। পেয়ারা পাতা জলে ভেসে সবকিছু সবুজ রঙ ধারণ করেছে। দুপুরের খাবারটা আটঘর কুড়িয়ানার সকাল সন্ধ্যা হোটেলে খেয়ে নিয়েছিলাম। নদীর মাছ তাজা পাওয়া যায় এখানে। খাবারটা বেশ ভাল। খাবারের পর আবার কিছুক্ষণ চললো, বাংলার ভেনিসে ভেসে বেড়ানো। 

সন্ধ্যে নামার মুখে আপনি আবার চলে আসবেন লঞ্চ ঘাটে। দেহমনে তখন অদ্ভুত প্রশান্তি আর চোখজুড়ে প্রকৃতি দেখার মুগ্ধতা নিয়ে আবার ফেরার যাত্রা। মাত্র একহাজার টাকার মধ্যে কয়েকজন বন্ধু নিয়ে এরকম একটা উইকেন্ড ট্যুর জীবনকে হালকা করার পক্ষে বেশ দরকার। ক্লান্তিগুলো পেছনে ফেলে নতুনভাবে সব কিছু শুরু করার উদ্যম পাওয়া যায়। আর এর জন্যে দরকার একটু পাগলামি, হুটহাট একটা সিদ্ধান্ত আর অতঃপর বেরিয়ে পড়া। উল্লেখ্য, পেয়ারা বাজারের সিজন শেষের পথে। আগামী দুই সপ্তাহের যেকোনো একটা উইকেন্ডে বেরিয়ে পড়ুন, কাটিয়ে আসুন বাংলার ভেনিসে একদিন। 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা