কিলো ফ্লাইট ও বীর বিক্রম শামসুল আলম: মুক্তিযুদ্ধে আকাশপথে রচিত এক অভূতপূর্ব বীরত্বগাঁথা
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
নাগাল্যান্ডের এক শ্বাপদসংকুল জনপদে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। যে বাহিনীতে জীবন বাজি রেখে যুক্ত হয়েছিলো দেশপাগল একেকজন মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে এসে এই কিলো ফ্লাইট'ই করে এমন একটি অপারেশন, পুরো যুদ্ধের সমীকরণই আমূল পালটে যায় তখন!
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরেই জীবন বাজি রেখে পাকিস্তান থেকে একে একে আসা শুরু করেছিলো পাকিস্তান সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীতে কর্মরত বাঙ্গালী অফিসারেরা। এই অফিসারেরা চাকরিসূত্রে অবস্থান করছিলেন পাকিস্তানে। তাদের আরাম-আয়েশের যে জীবন ছিলো, তা হিসেব করে মাঝেমধ্যে ভাবি, তারা খুব সহজেই পারতেন, বিপদের মধ্যে না এসে নিরাপদে পাকিস্তানে থাকতে৷ সেটা যদি তারা করতেন, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস কীরকম হতো, সেটা জানি না। তবে তাদের অবদানই যে দিনশেষে গড়ে দিয়েছিলো অনেকটা পার্থক্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই বিবেচনায় আজ পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা এমন এক মানুষকে নিয়ে কথাবার্তা হবে, যিনি যুক্ত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের প্রথম বিমান বাহিনীর সাথে, যে বাহিনীর সাংকেতিক নাম; 'কিলো ফ্লাইট।'
একাত্তরের ২৮শে সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরু করেছিলো ইউনিট কিলো ফ্লাইট। ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরের পাণ্ডববর্জিত এক জায়গায় গহীন জঙ্গলের ভেতর ছোট্ট এক রানওয়ে। যে রানওয়ের খবর জানে না কেউ। যে রানওয়ের চারপাশ চষে বেড়ায় বিষাক্ত সব জানা-অজানা শ্বাপদ। সেই রানওয়েতেই বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর উদ্বোধন করেন ইন্ডিয়ান এয়ার-চিফ-মার্শাল পি সি লাল।
তবে আপাতত ডিমাপুর, কিলো ফ্লাইট অথবা বাংলাদেশের বিমান বাহিনী'কে পেছনে রেখে আমরা বরং শুনে আসি পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের এক বাঙ্গালী অফিসারের গল্প, যিনি যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে প্রাণ হাতের মুঠোয় করে চলে এসেছিলেন বাংলাদেশে, এয়ার কমান্ডার এ.কে খন্দকারের ডাকে। অংশ হয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রথম বিমান বাহিনী- কিলো ফ্লাইটের। বলছি বীর বিক্রম শামসুল আলমের কথা। যুদ্ধকালীন সময়ে যিনি ছিলেন কিলো ফ্লাইটের বৈমানিক ও গ্রুপ ক্যাপ্টেন।
পাকিস্তান এয়ার ফোর্সে তিনি সর্বোচ্চ বেতন র্যাংকের অফিসারদের সারিতেই ছিলেন। আরাম আয়েশের জীবন ছিলো। এই সামরিক জীবনে অভিযোগের কোনো সুযোগ ছিলো না। নিরুপদ্রব কাটছিলো সব। কিন্তু সেই জীবনেই উদ্বেগ আসে, যখন তিনি সত্তর সালের প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্নিঝড়ের পরে মনপুরা দ্বীপে যান ত্রান দিতে। হেলিকপ্টারে ত্রানের চাল নিয়ে উড়তে উড়তে তিনি দেখতে পান, দ্বীপে মাইলের পর মাইল জুড়ে লাশ আর লাশের স্তুপ। তিনি বেশ বড়সড় এক ধাক্কা খান। বুঝতে পারেন- তার জীবন আর সাধারণ মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন আছে। দেশের মানুষ যে মোটেও ভালো নেই, তাও বুঝতে পারেন তিনি। তাঁর সামরিক স্বস্তির জীবনে খানিকটা বেসামরিক বেদনার কালো মেঘও যেন ঢুকে পড়ে আচমকা।
কয়দিন পরেই শুরু হয়েছে যুদ্ধ। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানেই আছেন। এপ্রিলের শেষদিকে একটা ফোনকল পান খুব কাছের এক বন্ধুর কাছ থেকে। ফোনকলের প্রেক্ষিতে ইসলামাবাদ যান। সেই বন্ধুর সাথে সরাসরি দেখা করেন। বন্ধুটি গোপনে তাঁর হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দেন। যে কাগজের অল্প একটু অংশ জুড়ে এয়ার কমান্ডার এ.কে খন্দকারের একটি ছোট্ট বার্তা-
আমরা পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেছি। বাংলাদেশের স্বপক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্যে আগরতলা চলে এসেছি। তুমি চাইলে তুমিও আসতে পারো।
অফিসার আলম দোটানায় পড়েন। নিশ্চিত, নিরাপদ, শান্তির জীবন ছেড়ে যেতে হবে যুদ্ধের ঠিক মধ্যিখানে। জীবন-মৃত্যু যেখানে এক সেকেন্ডের এপাশ-ওপাশ। কী করবেন তিনি! যাবেন, নাকি যাবেন না। মূদ্রার এপিঠ-ওপিঠ তাকে ফেলে দেয় অকুল চিন্তায়।
তবে ভাবতে বেশি সময় নিলেন না। কর্তব্য স্থির করে জুন মাসের প্রথমদিকে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। কিন্তু বিধিবাম! বিমান বন্দরে এসেই ধরা পড়েন শত্রুপক্ষের হাতে। সেখান থেকে পরবর্তীতে এক সিনিয়র অফিসারের সহায়তায় মুক্তি পেয়ে সাথে সাথে পালিয়ে চলে যান ভারতে। কোলকাতায়। সেখানে আট নম্বর থিয়েটার রোডের বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের অফিসে যান সরাসরি। এ.কে. খন্দকার তখন সেখানে ছিলেন। তিনি অফিসার আলমকে দেখে জড়িয়ে ধরেন। খুব গোপনে জানিয়ে দেন এক তথ্য- বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠিত হবে খুব তাড়াতাড়িই। সেখানে যুক্ত হতে বলেন অফিসার আলমকে। শামসুল আলমসহ মোট নয় জন বৈমানিক, দুটি বিমান আর একটি হেলিকপ্টার দিয়ে যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর। যে ঘটনা লেখার শুরুতেই বললাম। নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরের সেই শ্বাপদসংকুল রানওয়েতে পি সি লাল ফিতা কেটে উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর।
'বাংলাদেশ বিমান বাহিনী' দুটি বিমান ও একটি হেলিকপ্টার পেয়েছিলো ভারত থেকে৷ একটি বিমান ছিল যোধপুরের মহারাজার দেয়া আমেরিকায় বানানো ডিসি-৩ ডাকোটা। আরেকটি কানাডায় তৈরি ডিএইচথ্রি অটার বিমান। সাথে ছিলো ফ্রান্সে তৈরি এলুয়েট থ্রি মডেলের হেলিকপ্টার৷ তবে প্রত্যেকটি বাহনই ছিলো অনেক পুরোনো মডেলের। আধুনিক অনেক প্রযুক্তিই ছিলো সেখানে অনুপস্থিত৷ তবে এগুলো নিয়েই শুরু হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যাত্রা।
'কিলো ফ্লাইট' নামটি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সাংকেতিক নাম। এ নাম এসেছে মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকারের নামের একটি অক্ষর 'কে' থেকে। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধানও ছিলেন। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী যে গঠিত হয়েছে, তা জানতো না কেউ। খুবই গোপনে করা হচ্ছিলো সব কাজকর্ম। শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ছাড়া পুরো তথ্য ছিলো সবার কাছেই অজানা।
কিলো ফ্লাইটের প্রধান কাজ ছিলো- পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের রাডার এড়িয়ে পাকিস্তানের বিমানগুলোর গতিবিধি নজর রাখা। এবং সুযোগ পেলেই আচমকা আক্রমণ করে সরে পড়া। অনেকটা 'হিট অ্যান্ড রান' স্ট্রাটেজিতে অ্যাটাক করতো বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বিমানগুলো। এর পেছনের কারন খুবই সোজা। পাকিস্তানের যুদ্ধ-বিমানগুলোর সাথে মুখোমুখি যুদ্ধ করার সক্ষমতা বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর এই বিমানগুলোর ছিলো না। তাই গেরিলা স্টাইলেই আক্রমণ চালাতে হতো।
সেপ্টেম্বরে যাত্রা শুরুর পর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কিলো ফ্লাইট বেশ কিছু অপারেশন করে। এরমধ্যে একটি অপারেশন ছিলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যেটি তারা করে ডিসেম্বরের তিন তারিখে। ততদিনে স্থলপথে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথবাহিনী পাকিস্তানকে আটকে ফেলেছে; শ্বাস করতে দিচ্ছে না। নৌপথে 'অপারেশন জ্যাকপট' শক্ত কামড় বসিয়েছে পাকিস্তান ঘাঁটিতে। বাকি থাকে আকাশপথ। বুদ্ধি আঁটা হয়- নারায়নগঞ্জ আর চট্টগ্রামে আঘাত করা হবে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারি ও নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল তেল ডিপোতে আক্রমণ চালানো হবে। এই দুটি জায়গায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বেশ ভালো জ্বালানী রিজার্ভ ছিলো। এখানে অ্যাটাক করার সিদ্ধান্তই তাই গৃহীত হয়৷ দুই টীম রেডি হয়ে যায়। একটি টীমে ছিলেন সুলতান মাহমুদ ও বদরুল আলম। তারা হেলিকপ্টার নিয়ে চলে যান নারায়ণগঞ্জের গোদনাইন তেল ডিপোতে। আচমকা অ্যাটাক করে তেল ডিপোতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তারা খুব তাড়াতাড়িই মিশন সাকসেসফুল করে চলে আসেন আবার৷
কিন্তু সমস্যা হয় চট্টগ্রামের মিশনের বৈমানিকদের। ভারতের কৈলাস থেকে রাত সোয়া আটটায় শামসুল আলম ও তার টীম অটার বিমান নিয়ে রওয়ানা দেন পতেঙ্গার দিকে। বারোটা পাঁচ মিনিটে পাকিস্তানের রাডার এড়িয়ে তারা ঢুকে পড়েন চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারির সীমানায়৷ পরপর দুইবার রিফাইনারিতে অ্যাটাক করেন। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হন। ওদিকে আক্রমণ টের পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনীও গান ফায়ার করা শুরু করেছে। মহাবিপদ। শামসুল আলমেরা যে মান্ধাতার আমলের বিমান নিয়ে এসেছেন, এই বিমান ডানে বামে মুভ করছিলো না তখন। ঠিকঠাক ভাবে কয়েকটা গুলি লাগলেই সব শেষ। এরকমটাই ছিলো নিয়তি। তবু শঙ্কাভরা হৃদয়ে শামসুল আলম সাহস আনার চেষ্টা করলেন। ভাবলেন- শেষ চেষ্টা করেই দেখি।
দানে দান তিন দান। তৃতীয়বারে অ্যাটাকের জন্যে একেবারে কাছ থেকে রকেট চার্জ করলেন শামসুল আলম। দুম করে একটা শব্দ হলো। হাজার আতশবাজির রোশনাইয়ে ধাঁধিয়ে গেলো সব। কমলা আলোতে ভরে গেলো চারপাশ। দিনের মত উজ্জ্বল হয়ে গেলো সবকিছু। আগুনের লেলিহান শিখায় তখন জ্বলছে পাকিস্তানিদের রসদের এক বড়সড় ভান্ডার। ওদিকে শামসুল আলম তখন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছতে মুছতে হাসছেন আর বিড়বিড় করছেন- মিশন সাকসেসফুল।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারির এ কমলা আগুন জ্বলেছিলো সারারাত৷ ওদিকে সফল অপারেশন শেষে শামসুল আলম তখন ফিরছেন বেস ক্যাম্পের দিকে। এরমধ্যেই রেডিওতে ঘড়ঘড়। ঘড়িতে রাত বারোটা বিশ। ইন্দিরা গান্ধী যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন পাকিস্তানের বিপক্ষে।
এরপরের গল্প আমরা জানি। ষোলোই ডিসেম্বর। তিরানব্বই হাজার জানোয়ার। নাকে খত দিয়ে বিদায়। বিজয়। বাংলাদেশ। লাল সবুজ। তবে এসবের ভীড়েও মনে রাখতে হবে বীর বিক্রম শামসুল আলমদের মত মানুষদের কথা। মৃত্যু'কে নিয়তি মেনেই যারা ফিরে এসেছিলেন দেশের টানে, মানচিত্রের টানে, অক্ষরের টানে। এই বিজয়ের মাসে তাই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি- কিলো ফ্লাইটের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। অতল শ্রদ্ধা রইলো বীর বিক্রম শামসুল আলম সহ 'মুক্তিযুদ্ধ'কে বাস্তব করার পেছনে অবদান রাখা প্রত্যেক মানুষের প্রতি। তাদের অবদান ভোলা তো দূরে থাক, বাংলাদেশ যতদিন টিকে থাকবে, তাদের নাম থাকবে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারির সেই কমলা-রঙের মতন উজ্জ্বল। অম্লান। অমলিন।
তাদের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা৷
তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা- বিবিসি বাংলা
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন