চৌদ্দ বছর বয়স থেকে গ্রাফিতি আঁকছেন, প্রতিবাদী গ্রাফিতির কারণে বেশ কয়েকবার গেছেন জেলে। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারকে স্রেফ অবজ্ঞা করে এঁকেছেন অমূল্য সব ছবি। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি ফ্যান তাঁর, অথচ কেউ তাকে স্বচক্ষে দেখেনি কোনোদিন!

তখন তার বয়স কত হবে? এই ধরুণ আঠারো। কয়েকজন বন্ধুর সাথে মিলে ব্রিটেনের এক দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকতে গেলেন। আঁকাআঁকির মাঝামাঝি সময় তখন। সবাই দেয়ালের দিকে মগ্ন। হুট করে সাইরেন বাজিয়ে চলে এলো ব্রিটেন ট্রান্সপোর্ট পুলিশ। পুলিশকে আসতে দেখে বাকি সবাই পালিয়ে গেলেও আঠারো বছরের ছেলেটি পালাতে পারলো না। সে আশ্রয় নিলো একটা ট্রাকের ইঞ্জিনের নীচে। ঘন্টাখানেক সেখানেই থাকতে হলো। দুর্ভাগ্যবশত ট্রাকের ইঞ্জিনেও ছিলো ফুটো। যতক্ষণ তিনি ট্রাকের ইঞ্জিনের নীচে আত্মগোপন করে রইলেন, পুরো সময়টাতেই নিয়মিত বেগে ইঞ্জিনের জ্বালানী তেল এসে ভেজাতে লাগলো তাকে। তেল-মাটি-ঘামে মাখামাখি হয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন-

গ্রাফিতিটি যদি আরেকটু কম সময়ে আঁকতে পারতাম, তাহলে পুলিশের এই ঝামেলায় পড়তে হতো না। পরবর্তী সময়ে এই বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে।

বিপদের মুহুর্তেও নিজের প্রাণের কথা না ভেবে যেই ছেলেটি ভেবেছিলো গ্রাফিতি'র কথা, আঠারো বছরের সেই তরুণটির নাম ব্যাংসি। আগে পরে কিছু নেই। শুধুই ব্যাংসি। অদ্ভুত নাম, সন্দেহ নেই। তার চেয়েও অদ্ভুত ব্যাপার হলো, পৃথিবী জুড়ে তাঁর কোটি কোটি ফ্যান, অথচ কেউ তাকে কখনো দেখে নি! প্রচারসর্বস্ব এ যুগে ব্যাংসি বেছে নিয়েছেন অজ্ঞাতকুলশীল জীবন। নিয়মিতই হয়তো তিনি সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন বড় বড় মিডিয়াকে, কিন্তু সেখানেও তিনি নিজের পরিচয়কে, চেহারাকে লুকিয়ে রাখছেন নরম মোড়কে। কিন্তু কেন? তাঁর সোজাসাপটা উত্তর-

আমার পরিচয় তো মূখ্য না। মূখ্য আমার কাজ, আমার প্রতিবাদ।

প্রতিবাদ অথবা শিল্পকর্ম প্রকাশের ক্ষেত্রে গ্রাফিতি খুব একটা প্রাচীন মাধ্যম না হলেও মূলসূত্র কিন্তু এক জায়গাতেই৷ সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ একে অন্যের সাথে যোগাযোগ আর প্রতিবাদের জন্যে, মন্তব্য আর শিল্প প্রতিভার আত্মপ্রকাশের জন্যে বেছে নিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যম। গুহাবাসী মানুষ দেয়ালে ছবি এঁকে, পাথর কুঁদে কথাবার্তা বলেছে, মন্তব্য প্রকাশ করেছে। ইলোরা অজন্তার পাথরে খোঁদাই করা শিল্পকর্ম অথবা পম্পেই নগরীর সমাধিস্থানের গুহাগুলোর মধ্যের আদিম ছবি এ কথার স্বপক্ষেই সাক্ষ্য দেবে। সে হিসেবে গ্রাফিতি একটু পরবর্তী মাধ্যম হলেও সূত্র ঠিকই ধ্রুবক; মতামত, মন্তব্য, প্রতিবাদ।

যদিও বিভিন্ন দেশে গ্রাফিতি আঁকাকে বেআইনি হিসেবে দেখা হয়, তবু প্রতিবাদের ক্ষেত্রে গ্রাফিতি এক অসাধারণ বিষয়। এই তো বাংলাদেশেও 'সুবোধ তুই পালিয়ে যা' গ্রাফিতি নিয়ে অজস্র কথাবার্তা হলো সাম্প্রতিক সময়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, কথা হচ্ছিলো ব্যাংসি নিয়ে। সেখানে গ্রাফিতি নিয়ে এত কথা কেন বলছি! কারণ হচ্ছে, ব্যাংসি আর গ্রাফিতি বলতে গেলে সমার্থক শব্দই। অজ্ঞাতে থেকে গ্রাফিতি'র মাধ্যমেই বরাবর তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর প্রতিবাদ। সমসাময়িক বিভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বহু সমস্যাকে বিদ্রুপ-রূপকের মধ্য দিয়ে তিনি তুলে রেখেছেন দেয়ালে। এ বিষয়ে তাঁর মতামতও খুব স্পষ্ট-

আইডিয়া প্রকাশের জন্যে অথবা প্রতিবাদের জন্যে আমাকে ব্যয়বহুল কোনো প্রক্রিয়ায় যেতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই। রাস্তার দেয়াল, মনের খেয়াল আর তুলি-রঙ এর সংস্পর্শে করা যায় পৃথিবীর যেকোনো বিপ্লব। এজন্যে কাড়ি কাড়ি টাকা নষ্ট করার দরকার নেই। দরকার একটি সংবেদনশীল হৃদয়।

পৃথিবীতে ব্যাংসির যে পরিমাণ ফ্যান-ফলোয়ার ও জনপ্রিয়তা, তিনি চাইলে ক্যানভাসে ছবি এঁকে সেসব ছবিকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করতে পারতেন। কিন্তু সেখানেও তীব্র আপত্তি তাঁর। কোনো একটা বিষয়ে তিনি প্রতিবাদ করবেন আর সেটা টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে কেউ বেডরুমে অথবা ড্রয়িংরুমে টাঙ্গিয়ে রাখবে! তাহলে তাঁর শিল্পীসত্তা বা প্রতিবাদী সত্তার মূল্য কোথায়! এ কারণে তিনি আঁকেন দেয়ালে, ট্রেনে, যানবাহনে, রাস্তায়! যা ব্যাটা, পারলে এবার আমার পেইন্টিং কিনে ঘরে নিয়ে যা। পারবি? হিম্মত আছে?

এ প্রসঙ্গে আরেকটা গল্প বলি। ২০০২ সালের ঘটনা। লন্ডনের রাস্তায় তিনি এক গ্রাফিতি আঁকেন। 'গার্ল উইথ বেলুন' নামের ঐ ছবিতে দেখা যায়, একটা ফুটফুটে ছোট বাচ্চা মেয়ে একটা হার্ট শেপের লাল টুকটুকে বেলুন কে হাত বাড়িয়ে ডাকছে। আর সেই লাল বেলুনটি  ক্রমশ চলে যাচ্ছে শিশুটির ধরাছোঁয়ার বাইরে। অসাধারণ এই ছবিটি নাড়িয়ে দিলো সবাইকে। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লো ছবিটি। এত সহজে এত বড় মেটাফোরিক্যাল কনসেপ্টের ছবি দেখে মুগ্ধ হলো প্রায় সবাই। 'গার্ল উইথ বেলুন' এর আর্টওয়ার্ক নিলামে উঠলো। দাম উঠলো প্রায় দেড় মিলিয়ন ডলার!

নিলামের দর চূড়ান্ত, গ্যাভেলের আঘাতও পড়েছে টেবিলে। ক্রেতা টাকা দিয়ে আর্টওয়ার্ক বুঝে নেবেন ঠিক তখনই ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা। দেয়ালে টানানো আর্টওয়ার্কটি টুকরো টুকরো হয়ে নীচে নেমে এলো। ব্যাংসি আর্টওয়ার্কটির মধ্যে যন্ত্র বসিয়ে রেখেছিলেন। যখনই এটা বিক্রির কথা উঠবে, তখন যাতে তিনি এই আর্টওয়ার্ক ধ্বংস করে ফেলতে পারেন এজন্যে। তিনি তো আগেই বলেছেন, টাকার জন্যে ছবি আঁকেন না। তাঁর ছবি কেউ কিনতেও পারবে না। সেটাই করেছেন তিনি। দেড় মিলিয়ন ডলার টাকা আর যাই হোক, কী আসে যায়!

যেই মুহুর্তে বিক্রি ফাইনাল হলো, তখনই টুকরো টুকরো হওয়া শুরু হলো আর্টওয়ার্কটি! 

অসাধারণ সব স্ট্রিটওয়ার্ক, গ্রাফিতির পাশাপাশি তিনি বানিয়েছেন ডকুমেন্টারিও। 'এক্সিট থ্রু দ্য গিফট শপ' নামের ডকুমেন্টারি 'এ্যাকাডেমি এ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট ডকুমেন্টারি ফিচার' এর জন্যে নমিনেটেডও হয়েছে। ওয়েবি এ্যাওয়ার্ডসে 'পার্সন অব দ্য ইয়ার'ও নমিনেটেড হয়েছেন তিনি। ২০১০ এ টাইম ম্যাগাজিন তাকে 'মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল হান্ড্রেড পিপল' এর লিস্টে রেখেছিলো। ক্রাইমওয়াচ, টার্ফ ওয়্যার এর মত তাঁর অসাধারণ সব গ্রাফিতি নিয়ে নিয়মিত আলোচনা হয়। লন্ডনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাঁর আর্ট নিয়ে এক্সিবিশন, সিম্পোজিয়াম, ফেস্টিভ্যাল হয়। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আর্ট এ্যাটাক নিয়েও গ্রাফিতি এঁকেছেন তিনি।

আর্ট এ্যাটাক নিয়েও সম্প্রতি গ্রাফিতি একেছেন ব্যাংসি! 

তবে সারা পৃথিবীতে যার এত এত ভক্ত, অনুরাগী... সেই মানুষটি বরাবরেই পর্দার ওপারে। ব্যাংসি'কে নিয়ে চাইলে হাজার হাজার পৃষ্ঠা লিখে ফেলা সম্ভব। অদ্ভুতুড়ে এই মানুষটি অতলস্পর্শী রহস্যের এক বড়সড় খাসমহলও। চৌদ্দ বছর থাকতেই শুরু করেছিলেন গ্রাফিতি আঁকার কাজ। ছোট ছোট অপরাধে জেলেও গিয়েছেন বেশ ক'বার। তবে থামেন নি কখনো। প্রতিবাদী শিরদাঁড়া বরাবরই রেখেছেন সোজা। নিজেকে অখ্যাত রেখে নিজের সৃষ্টিকর্মগুলোকে করেছেন বিখ্যাত। নিজেকে বানিয়েছেন বিপ্লবের এক মূর্ত প্রতীক।

ব্যাংসি ঠিক এখানেই অসাধারণ। তাঁর স্পষ্টবাদিতার জন্যে। তাঁর দুর্বোধ্যতার জন্যে। তাঁর রহস্যময় অবয়বের জন্যে। তার বিশুদ্ধ প্রতিবাদী চেতনার জন্যে।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা