আমরা অনিয়ম-দুর্নীতি দেখি, সিস্টেমকে গালি দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাই, ব্যারিস্টার সুমন পাশ কাটাতে পারেন না। দেশের ফুটবল ধ্বংস হলে আমাদের কিচ্ছু আসে যায় না, আমাদের জন্য বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদ আছে। কিন্ত সুমনের আসে যায়, তাই তিনি প্রভাবশালীদের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দাঁড়ান...

ব্যারিস্টার সুমনকে আপনারা সবাই চেনেন। সামাজিক নানা অনিয়ম আর দুর্নীতি নিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে সমস্যা তুলে ধরা এবং প্রতিবাদ করে ভাইরাল হয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই আইনজীবী। তবে অনেকেই তার যে পরিচয়টি জানেন না, সেটা হচ্ছে তিনি একজন নিখাদ ফুটবলপ্রেমী। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল তার সঙ্গী, একটা সময় মাঠ মাতিয়েছেন ফুটবলার হিসেবে, এখন ফুটবলের উন্নয়নের জন্য হবিগঞ্জে নিজের খরচে একটা ফুটবল একাডেমি খুলে বসেছেন। 

ইদানিং তাকে দেখছি ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের আমলে ফুটবলের পিছিয়ে পড়া এবং সীমাহীন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ফেডারেশনের সমালোচনায় মুখর হতে। আপনি ব্যারিস্টার সুমনকে পছন্দ করতে পারেন, না-ও করতে পারেন। কিন্ত দেশের ফুটবলের ভবিষ্যত নিয়ে তার ভাবনার সঙ্গে একাত্ম আপনাকে হতেই হবে, এই বিষয়ে দ্বিমত পোষনের বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। 

ব্যারিস্টার সুমন নাছোড়বান্দা টাইপের মানুষ। যেটার পেছনে একবার লাগেন, সেটার শেষ দেখে ছাড়েন। মহাসড়কের ওপর বিদ্যুতের পিলার লাগানো হয়েছে দেখে তিনি গাড়ি থেকে নেমে ভিডিও করলেন, সেটা ফেসবুকে আপলোড দিলেন, ভাইরাল হলো সেই ভিডিও, বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীরা সেই পিলার সরিয়ে রাস্তার বাইরে নিয়ে গেল। এরপর বিভিন্ন সময়ে নানা অনিয়ম আর অব্যস্থাপনার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন এই আইনজীবী, কখনও স্কুলের সামনে থাকা ডাস্টবিনে দাঁড়িয়ে লাইভে এসেছেন, কখনও ইট-সিমেন্ট দিয়ে দখল করা রাস্তা থেকে। প্রতিবারই কাজ হয়েছে, ডাস্টবিন অন্যত্র সরানো হয়েছে, রাস্তা দখলমুক্ত হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন থেকে প্রভাবশালী ব্যক্তি- কেউ রেহাই পায়নি তার সচেতনতা থেকে। 

ব্যারিস্টার সুমনের ফুটবলপ্রেম অনেক পুরনো

এবার তিনি আরেকটা মিশনে নেমেছেন, ফুটবল ফেডারেশনে সংস্কার আনার মিশন। গত একযুগ ধরে একদল লোকের কাছে জিম্মি হয়ে আছে দেশের ফুটবল। ঘুরেফিরে তারাই সভাপতি-সহ সভাপতি কিংবা অন্যান্য পদ দখল করে রাখছেন। ফিফার অনুদানের টাকা কিভাবে আসছে, কোথায় খরচ হচ্ছে, কিছুরই হিসেব নেই। দেশের ফুটবল দিনকে দিন শুধু পিছিয়েই চলেছে। র‍্যাংকিং নিম্নমুখী, ভূটান-শ্রীলঙ্কার মতো দলও আমাদের বলেকয়ে হারায় এখন, হারতে হারতে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকেই আমরা নিষিদ্ধ হয়ে যাই, দেশের ইতিহাসের সর্বনিম্ন র‍্যাংকিংয়ে পৌঁছে যায় আমাদের অবস্থান- তবু এই লোকগুলোর কোন বিকার নেই, ফুটবলের উন্নয়নে কোন পদক্ষেপ নেই, আছে শুধু রঙবেরঙের আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখিয়ে পদ আঁকড়ে ধরার সীমাহীন লোভ।

বাফুফে সভাপতি হিসেবে কাজী সালাউদ্দিন দায়িত্ব নিয়েছিলেন ২০০৮ সালের ২৮শে এপ্রিল। তখন ফিফা র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৮০তম। গত ১২ বছর ধরে তিনিই সভাপতি, এগিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা- এখন আমাদের অবস্থান ১৮৭-তে! ২০১৮ সালে তো ১৯৭-তেও পৌঁছে গিয়েছিলাম আমরা, যেটা কিনা বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সর্বনিম্ন র‍্যাংকিং। বয়সভিত্তিক এবং নারী ফুটবল দলগুলো কিছু সাফল্য পেলেও, জাতীয় দলের ক্ষেত্রে গত বারো বছরে বলার মতো কোন অর্জন নেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও, বরং আছে ব্যর্থতা আর ভরাডুবির অজস্র গল্প। ফুটবলার হিসেবে অজস্র অর্জনে সমৃদ্ধ কাজী সালাউদ্দিনের যে ফুটবল প্রশাসক হিসেবে চরমভাবে ব্যর্থ, সেটারই সামান্য একটা নমুনা এটা। 

কাজী সালাউদ্দিন লিওনেল মেসির আর্জেন্টিকে বাংলাদেশে এনেছেন, নাইজেরিয়ার সঙ্গে তাদের প্রীতি ম্যাচের আয়োজন করেছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে গ্ল্যামারাস ঘটনাগুলোর একটি হচ্ছে এটি। কিন্ত এই গ্ল্যামার দিয়ে তো দেশের ফুটবলের কোন লাভ হয়নি। জাতীয় দলের পারফরম্যান্সের অবস্থা তথৈবচ, সালাউদ্দিনের আমলে ৭৪টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে মাত্র ১৯টিতে! এই সময়ে ভূটানের কাছেও হারতে হয়েছে একাধিকবার। বিগত চারটি সাফ ফুটবল টুর্নামেন্টে গ্রুপ পর্বই পার হতে পারেনি বাংলাদেশ। পারফরম্যান্সের হতদরিদ্র‍্য অবস্থা বোঝানোর জন্য এটুকুই মনে হয় যথেষ্ট।

গত ১২ বছর ধরে বাফুফে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কাজী সালাউদ্দিন

এই সীমাহীন ব্যর্থতার পরেও দায়িত্ব ছাড়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না কাজী সালাউদ্দিন বা তার কমিটির কারো মধ্যে, বরং নিজেদের বানানো সিন্ডিকেটের বলয়কে কাজে লাগিয়ে আরও একবার নির্বাচিত হবার আশা প্রকাশ করেছেন বর্তমান সভাপতি। বারো বছরেও যিনি দেশের ফুটবলের কোন উন্নতি করতে পারেননি, একটা ভালো মানের একাডেমি বানিয়ে দিতে পারেননি, তিনি আরেকটা সুযোগ কোন মুখে প্রত্যাশা করেন? দেশের ফুটবলের প্রাণকেন্দ্র যে স্টেডিয়ামটা, সেই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের চেহারা হয়েছে পাড়ার মাঠের চেয়েও খারাপ- কি করে আরও চার বছর সভাপতি পদে থাকার আশা করেন কাজী সালাউদ্দিন?

একারণেই ব্যারিস্টার সুমন বিরোধিতা করছেন বাফুফের এই কমিটির। সেই একই লোক, একই কমিটিকে ফেডারেশনের দায়িত্বে তিনি দেখতে চান না। আর তাই ফুটবলপ্রেমীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি রাস্তায় নেমে এসেছেন, সঙ্গে পেয়েছেন সাবেক তারকা ফুটবলার কায়সার হামিদকেও। ব্যারিস্টার সুমনের কথা পরিস্কার- সভাপতি পদে সালাউদ্দিন সাহেব থাকুক বা অন্য কেউ থাকুক, তাকে কাজ করতে হবে, উন্নতি দেখাতে হবে। যে কাজ করতে পারবে না সে চলে যাবে। দেশের ফুটবল দিনকে দিন পিছিয়ে যাবে, আর এই লোকগুলো পদ আঁকড়ে বসে থাকবে- এটা তো হতে পারে না। 

ব্যারিস্টার সুমনের ফুটবলপ্রেম নিয়ে কিছু কথা না বললেই না। নিজের এলাকা হবিগঞ্জে কিছুদিন আগে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ব্যারিস্টার সুমন ফুটবল একাডেমি। ফুটবলটা তিনি নিজেও বেশ ভালো খেলেন, খেলাটার প্রতি তার একটা প্যাশন আছে। এর আগেও তিনি এলাকার শিশুদের মধ্যে খেলার সামগ্রী বিতরণ করেছেন, মাঠ মেরামত করে দিয়েছেন, নিজের খরচে টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছেন। তবে তার এবারের উদ্যোগটা ছাপিয়ে গেছে অতীতের সবকিছুকে। 

এলাকার তরুণদের বাছাই করেছেন তিনি একাডেমির জন্য। করোনায় সারাদেশ যখন বিপর্যস্ত, তখন তার একাডেমিতে জোরেশোরে চলেছে অনুশীলন। দূর-দূরান্ত থেকে তরুণরা এসেছে একাডেমিতে অডিশন দিতে, যশোর থেকে এক কিশোর লকডাউনের মধ্যে চারশো কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে চলে এসেছে ফুটবল খেলবে বলে! ঢাকা থেকে কোচ, ফিটনেস ট্রেনার নিয়ে গেছেন ব্যারিস্টার সুমন, যাতে একাডেমির তরুণরা সেরা সার্ভিসটাই পায়। 

ব্যারিস্টার সুমনের ফুটবল একাডেমি

একশোর বেশি তরুণ ফুটবলার এখন ব্যারিস্টার সুমনের ফুটবল একাডেমির অংশ। কোচ-সহকারী কোচের পাশাপাশি এদের জন্য অভিজ্ঞ অ্যানালিস্ট আনা হয়েছে, যিনি প্রতিটা ফুটবলারকে নিয়ে বিশ্লেষণী রিপোর্ট করেন। আছে গোলরক্ষকদের জন্য আলাদা কোচ। জিমনেশিয়াম স্থাপনের কাজ চলছে, এমন অত্যাধুনিক জিমনেশিয়াম বাফুফেরও নেই! পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে খুব শিগগিরই অ্যাকাডেমিতে ইউরোপিয়ান কোচ আনা হবে বলেও জানানো হয়েছে। এই অ্যাকাডেমি নিয়ে ব্যারিস্টার সুমন কতটা ডেসপারেট, সেটা তার কথাবার্তা শুনলেই বোঝা যায়। নিজের খামারের গরু বিক্রি করে হলেও তিনি অ্যাকাডেমি চালাতে চান বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন একবার। 

ব্যারিস্টার সুমনের সাথে আমাদের একটা বড়সড় পার্থক্য আছে। আমরা অনিয়ম-দুর্নীতি দেখি, সিস্টেমকে গালি দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। ব্যারিস্টার সুমন পাশ কাটান না, তিনি আবর্জনার ওপরে দাঁড়িয়ে ফেসবুক লাইভে আসেন।আপনার কাছে তার আঞ্চলিক উচ্চারণে বলা কথাবার্তা হাস্যকর লাগতেই পারে, তার রাজনৈতিক অবস্থান আপনার পছন্দ না হতেই পারে, কিন্ত এই লোকটা যে একটা পরবর্তন এনেছেন, তার কারনে যে বেশকিছু সমস্যার সমাধান হয়েছে- এটাতে কোন সন্দেহ নেই। নিজের উদ্যোগে তিনি রাস্তা সংস্কার করেছেন, পুল-কালভার্ট বানিয়ে দিয়েছেন; তাই তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করার আগে দেশের জন্য আমরা কি করেছি, আর সুমন কি করেছেন- দুটো ব্যাপারকে মিলিয়ে দেখা ভালো। 

দেশের ফুটবল নিয়ে ব্যারিস্টার সুমন একটা অসম যুদ্ধে নেমেছেন, প্রতিপক্ষ এখানে ভীষণ প্রভাবশালী। এই লড়াইতে আমরা ব্যারিস্টার সুমনের পক্ষে আছি। নতুন প্রজন্ম যাতে ফুটবলের দুরবস্থার জন্য আমাদেরকে দায়ী করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব আমাদেরই হাতে। আমরা পাশ কাটিয়ে যাই সবকিছু, ব্যারিস্টার সুমনের মতো পাগলাটে কেউ কেউ পারেন না, তারা লেগে থাকেন একটা বদল আনার আশায়, সমাজটাজে বদলে দেয়ার আশায়। সেই বদলে দেয়ার মিশনে এই ক্র‍্যাক-হেডেড মানুষগুলোকে সঙ্গ দেয়াটা ভীষণ দরকার...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা