বাসন্তী রেমার কষ্ট, বেদনাটা আমাদের বোঝার কথা নয়। তবে এটা বুঝি, বাসন্তীর সঙ্গে যেটা হয়েছে, মধুপুরের গারো সম্প্রদায়ের সঙ্গে যা ঘটেছে, সেটা অন্যায়। মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া এই পাঁচশো কলাগাছ ছিল বাসন্তীর জীবিকার একমাত্র অবলম্বন...

টাঙ্গাইলের পেগমারি নামের যে গ্রামে বাসন্তী রেমার বসবাস, এখানে তারা কয়েক পুরুষ ধরে আছেন, শত শত বছর ধরে জায়গাটায় তাদের বিচরণ, যখন বাংলাদেশ, এমনকি পাকিস্তানেরও জন্ম হয়নি, তারও আগে থেকে। পড়ালেখা করেননি তারা, জায়গা-জমির হিসেবও বোঝেন না। পুর্বপুরুষেরা যেসব জমিতে চাষবাস করতেন, সেগুলোকেই নিজেদের ধরে নিয়ে এখন চাষাবাদ করেন তারা। এক-দেড়শো বছর আগেও করতেন, এখনও করেন। সরকারী জমি, খাস জমি, বন বিভাগের জমি- এতসব হিসেব তাদের মাথায় ঢোকে না। 

গারো আদিবাসী বাসন্তী রেমা কিংবা মধুপুরের এরকম আরও অজস্র মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন একটাই- জমিতে চাষাবাদ। উত্তরাধিকারসূত্রে তারা এই জমিগুলোতে ভোগদখল করে থাকেন, তাদের কাছে কোন নির্দিষ্ট দলিল-দস্তাবেজ নেই, দরকারও পড়ে না, শত বছর ধরে এভাবেই সব চলে আসছে। এবছর বাসন্তী রেমা ঋণ নিয়ে তার ভাগের দেড় বিঘা জমিতে প্রায় পাঁচশো শবরি কলার গাছ লাগিয়েছিলেন। কয়েক মাসের হাড়ভাঙা খাটুনিতে গাছগুলো বেড়ে উঠেছিল বেশ খানিকটা। ফল ধরার সময়ও হয়ে এসেছিল। গতকাল বনবিভাগের লোকজন এসে অবৈধ জায়গা দখলমুক্ত করার নামে ট্রাক্টর দিয়ে সবগুলো কলাগাছ কেটে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। 

শুধু বাসন্তী রেমী নন, তার মতো আরও অনেক গারো পরিবার এমন জুলুমের শিকার হয়েছেন। মধুপুর উপজেলার আরণখোলা ইউনিয়নের আমতলী গ্রামে এরই মধ্যে অন্তত দশটি গারো পরিবারের পাঁচ একর জমির আনারস, পেঁপে, আদা, হলুদ, কলা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় গারো সম্প্রদায়ের লোকজন অভিযোগ করেছেন, বন বিভাগ নিজেদের জমি দাবি করে কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই গত ২৪ আগস্ট পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে ট্রাক্টর দিয়ে তাদের জমির ফসল মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। 

সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত গারোরা দাবী করেছেন, জমি উচ্ছেদের বা ফসল সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে তাদের কোন আগাম নোটিশ দেয়া হয়নি, পুরো ব্যাপারটাই ঘটেছে অতর্কিতে। এসময় তাদের পাঁচ একর জমির ফসল ট্রাক্টরের নিচে পিষে ধ্বংস করা হয়েছে। করোনা মহামারির এই সময়ে বন বিভাগের এমন 'অমানবিক আচরণে' তাদের এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে, কারণ ফসল ফলানো ছাড়া অন্য কোন কাজ তারা করেন না, জানেনও না। গারোরা বলেছেন, যুগ যুগ ধরে দখলসূত্রে এই জমিতে চাষ করে আসছেন তারা। কেউ উত্তরাধিকার, আবার কেউ 'বাংলা দলিল' (রেজিস্ট্রিবিহীন) মূলে এই জমির মালিক। অথচ সেই জমি থেকে এখন তাদের উৎখাত করা হচ্ছে! 

এদিকে বন বিভাগ বেআইনীভাবে গাছ কাটা বা ফসল নষ্টের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে উল্টো দাবী করেছে, জবরদখল হয়ে থাকা জমিই নাকি তারা উদ্ধার করেছে। সিএস ১০৪ দাগের যে জায়গাটায় বাসন্তী রেমার কলাবাগান, বা অন্যান্য গারো পরিবারগুলো জীবিকার জন্য আনারস, পেঁপে, আদা, হলুদ, কলা চাষ করেছিলেন, সেগুলো ধ্বংস করে দেয়াটা তাদের রুটিন কাজের অংশ। তারা বরং অভিযোগ এনেছে, দখলকৃত জমি উচ্ছেদের সময় গারোরা দলবেঁধে তাদের ওপর হামলা করেছে- এই মর্মে। 

বাসন্তী রেমার ৫০০ কলাগাছ কেটে ফেলেছে বন বিভাগ

কলাবাগান কাটার খবরে স্থানীয় গারোরা একত্রিত হয়ে বনবিভাগের কর্মীদের ধাওয়া দিয়েছেন, এই ঘটনা সত্যি। কিন্ত কেউ যখন একটা মানুষের মুখের ভাত ছিনিয়ে নেবে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া লোকটার তখন করণীয় কি? যে জমিতে শত শত বছর ধরে তারা চাষবাস করে বেঁচে আছে, বন কর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই অভয়ারণ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে, নিজেরাও বনরক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের কর্মী বাহিনীর সদস্য (সিএফডব্লিউ) হিসেবে কাজ করছে- সেখান থেকে যখন তাদের উচ্ছেদ করা হবে, তাদের ফসল নষ্ট করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হবে- তখন তারা প্রতিবাদ করবে না? 

হতে পারে এই জমির আসল মালিক বন বিভাগ, হতে পারে এই জমি রাষ্ট্রের এই প্রতিষ্ঠানটির আওতাধীন। তবুও তারা পারে না বিনা নোটিশে একজন অসহায় মহিলার পাঁচশো কলাগাছকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে। পাঁচশো কলাগাছ- এটা আমাদের কাছে একটা সংখ্যা। বাসন্তী রেমার কাছে বেঁচে থাকার অবলম্বন, তার জীবিকা, তার রুটিরুজি। টাকা ধার করে, মাসের পর মাস হাড়ভাঙা খাটুনি আর পরিশ্রমে কলাগাছগুলোকে বড় করেছিলেন তিনি, কলা বিক্রি করে তিনি ধার শোধ করতেন, আগামী কয়েকটা মাস তার সংসার চলতো এই গাছগুলোর ফল।বিক্রি করে। বন বিভাগ শুধু কলাগাছ কাটেনি, তারা জীবন সংগ্রামে।লিপ্ত একজন নারীর দুটো হাতই কেটে নিয়েছে। 

মাটিতে পড়ে থাকা কলাগাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকা বাসন্তী রেমার ছবিটা দেখে মনে হয়, কলাগাছ নয়, মাটিতে শুয়ে আছে পাঁচশো মৃত শিশু, কোন দানবের আচমকা আক্রোশের বলি হয়ে যাদের মৃত্যু হয়েছে। বাসন্তী রেমা তার মৃত সন্তানদের দিকে তাকিয়ে থাকেন অপলক, ঝাপসা হয়ে আসা দৃষ্টিতে গোচর হয় না তার আগত ভবিষ্যত। তার স্বপ্নগুলো সুতো কাটা ঘুড়ির মতো মুখ থুবড়ে পড়েছে মাটিতে। বাসন্তী রেমার কষ্ট, বেদনাটা আমাদের বোঝার কথা নয়, তবে এটা বুঝি, বাসন্তীর সঙ্গে যেটা হয়েছে, মধুপুরের গারো সম্প্রদায়ের সঙ্গে যা ঘটেছে, সেটা অন্যায়। আপনার-আমার মতো বাসন্তীরাও এই মাটির সন্তান, এদেশের নাগরিক। সেই নাগরিকদের প্রতি অবিচার করার অধিকার রাষ্ট্রের নেই, রাষ্ট্রের কোন প্রতিষ্ঠান বা তার কর্তাব্যক্তিদেরও নেই। 

ছবি কৃতজ্ঞতা- দৈনিক সমকাল।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা