৫৮ বছর ধরে যেখানে প্রতিবারই লাভ হতো ব্যবসাতে, এবার সেখানে ক্ষতির একটা পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। বছরের প্রথম ছয়মাসেই শেয়ার প্রতি লোকসান ৫১ টাকা ৩৭ পয়সা। এছাড়াও দ্বিতীয় প্রান্তিক শেষে বাটা সু কোম্পানির শেয়ারপ্রতি নগদ প্রবাহ কমে ঋণাত্মক ৫ টাকা ৮৫ পয়সায় নেমেছে।

আচ্ছা, ছোটবেলা থেকে কোন ব্রান্ডের জুতো দেখে, ব্যবহার করে আপনি বড় হয়েছেন, এই প্রশ্নটা যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে কোন উত্তরটি দেবেন? অবধারিতভাবে যে উত্তর আসবে বলে ধরে নিচ্ছি, সেটি হচ্ছে 'বাটা।' দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশের ছেলেবুড়ো সবাইকেই মোটামুটি কব্জা করে রেখেছে এই প্রতিষ্ঠানটি, তাদের পণ্যের জোরে। 

বাটা'র প্রোডাক্টের অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য সাসটেইনিবিলিটি 

'বাটা'র মালিকের নাম টমাস বাটা। হ্যাঁ, তাঁর নামানুসারেই কোম্পানির নাম "বাটা" রাখা হয়। টমাস বাটা'র পরিবার বহুকাল আগে ধরেই মুচিপেশায় জড়িত ছিলেন। সেই পেশাটিকেই একটি বিজনেস মডেল হিসেবে দাঁড় করান মিঃ বাটা। গড়ে তোলেন বাটা কোম্পানি। যাত্রা শুরু হয় একটি বিশ্বখ্যাত জুতো প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তারা তো সৈন্যদের জন্যেও জুতো প্রস্তুত করতেন নিয়মিত। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও তাদের কাজ থামেনি। বরং বেড়েছে। আস্তে আস্তে প্রচার ও প্রসার বাড়ে তাদের। সুইজারল্যান্ডের লুসানে বাটা'র মেইন শাখা এবং এখন পর্যন্ত বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ২৬টি দেশে রয়েছে তাদের শাখা। 

বাংলাদেশে বাটা জনপ্রিয় হওয়ার প্রধান কারণ তাদের প্রোডাক্টের সাসটেইনিবিলিটি। এদের জুতো, স্যান্ডেল বেশ শক্তপোক্ত হওয়ার কারণে এক জোড়া কিনলেই অনেকদিন বেশ নিশ্চিতে পার করে দেয়া যায়। আগের জেনারেশনের মানুষের এই কোম্পানি পছন্দ হওয়ার কারণ, বাটার ডিজাইনগুলো কিছুটা সেকেল ধরণের। বাটা সবসময়েই তাই নজর দিয়েছে কোয়ালিটি এবং স্থায়িত্বে, ডিজাইনের দিকে তাই ওভাবে তাদের নজর পড়েনা। এ কারণে ইয়াং জেনারেশন একটু পিছিয়েও রাখে তাদের। এ্যাপেক্স, লোটো বা অন্যান্য কোম্পানির চটকদার পণ্যের ভীড়ে বাটার আবেদন এই জেনারেশনের কাছে যে কিছুটা কম, সে নিয়ে কোনো বিতর্কই নেই। 

১৯৬২ সালে বাটা এদেশে আসার পর প্রতিদিনই প্রায় ১,৬০,০০০ জোড়া জুতো বানাচ্ছে। বছরের হিসেবে প্রায় ৩০ মিলিয়ন পন্য বানাচ্ছে তারা। এবং বাংলাদেশের অবিসংবাদিত ভাবে এক নম্বর ব্রান্ড বললেও তাদের নামই আসবে। তাছাড়া বিশ্বখ্যাত অন্যান্য ব্রান্ড যেমন- এডিডাস, নাইকি, হাশ পাপিস এরও লোকাল ফ্রাঞ্চাইজি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে বাটা। 

কিন্তু করোনার প্রকোপে ধ্বস নেমেছে এই বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসায়। এদেশে আসার পরে এই প্রথমবার লস হয়েছে প্রোডাক্ট সেলে। ৫৮ বছর ধরে যেখানে প্রতিবারই লাভ হতো ব্যবসাতে, এবার সেখানে ক্ষতির একটা পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। বছরের প্রথম ছয়মাসেই শেয়ার প্রতি লোকসান ৫১ টাকা ৩৭ পয়সা। এছাড়াও দ্বিতীয় প্রান্তিক শেষে বাটা সু কোম্পানির শেয়ারপ্রতি নগদ প্রবাহ কমে ঋণাত্মক ৫ টাকা ৮৫ পয়সায় নেমেছে। 

বাটার বিজনেস হয় মূলত দুই ঈদ থেকে। রোজার ঈদ ও কোরবানির ঈদ। এই দুই ঈদে তাদের পুরো বছরের প্রায় অর্ধেক ব্যবসা হয়। কিন্তু এবারে হয়নি কিছুই৷ মানুষজন নামেনি রাস্তায়। দোকানপাট খোলা থাকলেও সেখানে নেই মানুষের চাপ। মানুষের আনাগোনা কম। তাছাড়া মানুষের যেখানে রুটিরুজির সংস্থানও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দিনদিন, সেখানে তারা জুতো- স্যান্ডেলের পেছনেও টাকা খরচ করার মত অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা দেখাতে পারছেনা৷ একারণেই বিশাল ক্ষতির মুখে এই প্রতিষ্ঠানটি। গুদামে পড়ে আছে লাখ লাখ পন্য। এগুলো নষ্ট হওয়ারও আশঙ্কা তাদের।  

যদিও বাটা চেষ্টা করছে আবার মূলস্রোতে ফেরার জন্যে। ইয়াং জেনারেশনকে টার্গেট করে প্রোডাক্টের ডিজাইনে পরিবর্তন আনা হচ্ছে, বিজ্ঞাপনেও আনা হচ্ছে নতুনত্ব। এছাড়া অনলাইনে প্রোডাক্ট সেলের জন্যেও নেয়া হচ্ছে জোরেসোরে উদ্যোগ। এছাড়া আরেকটি নতুন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যেটির নাম- Chatshop. সরাসরি অফিশিয়াল স্টোররুমের ম্যানেজারের সাথে হোয়াটস্যাপে কথাবার্তা বলে ঘরে বসেই পছন্দের ডিজাইন ও সাইজের প্রোডাক্ট কেনা যাচ্ছে। 

বুদ্ধিদীপ্ত বিজ্ঞাপনে আবার মূলস্রোতে ফিরতে চাইছে তারা  

আমরা আশা করবো, বাটা আবার তার মূলস্রোতে ফিরবে। এবং সব জেনারেশনকে টার্গেট করে তারা আগের সাম্যাবস্থানে চলে আসবে আবার৷ We Love Shoes ট্যাগলাইনে যে কোম্পানির পথচলা শুরু, তারা খুব শীঘ্রই এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠবে, এটাই প্রত্যাশা৷ 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা