কে এই দুর্ধর্ষ বীরত্বের ইতিহাস পাঠ করাবে এই প্রজন্মকে?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ঠিক এসময়টাতেই ৮ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুরের কপালে চিন্তার ভাঁজ। সারাদেশে বিজয় হয়ে গেলেও খুলনার শিরোমনিতে যশোর ক্যান্টনমেন্টের পাকিস্তানিরা ঘাঁটি গেঁড়ে বসে আছে।
১।
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ । বাংলাদেশ বিজয় উদযাপন করছে। বিজয় উদযাপিত হচ্ছে বন্ধুপ্রতীম ভারতেও। সামরিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পাবলিক সারেন্ডারের ঘটনা ঘটে গেছে এদিন। পাকিস্তানের এই নিঃশর্ত আত্মসমর্পনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ মুক্ত হল।
ঠিক এসময়টাতেই ৮ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুরের কপালে চিন্তার ভাঁজ। সারাদেশে বিজয় হয়ে গেলেও খুলনার শিরোমনিতে যশোর ক্যান্টনমেন্টের পাকিস্তানিরা ঘাঁটি গেঁড়ে বসে আছে। ৭ ডিসেম্বর এরা মুভ করেছে যশোর থেকে খুলনায়, তখন থেকে এখানে এরা ওই শিল্প এলাকার স্থাপনাগুলো নিয়ে দুর্ভেদ্য ব্যুহ তৈরি করে আছে। ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান এমন সিদ্ধান্ত কেন নিল, ধোঁয়াশার মত বিষয়। প্রাথমিকভাবে মেজর মঞ্জুরের যেটা মনে হল-
ক। যশোর সেনানিবাসকে পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান নিরাপদ আশ্রয় ভাবতে পারছিল না। কারণ যশোর ক্যান্টনমেন্ট অতটা আর জনশূণ্য এলাকা নয় এখন। তার দরকার মোটামুটি জনশূণ্য ফাঁকা ফাঁকা এলাকা। বাংলার জনসমুদ্রে মৃত্যুদূতের মত গেরিলারা মিশে থাকে। ভারতীয় বাহিনীকে ঠেকানো গেলেও এদের ঠেকানো যায় না। শিরোমনি মোটামুটি জনমানব শূণ্য এলাকা। শিরোমণি, আটরা, গিলাতলা, তেলিগাতি, দৌলতপুর ও শোলগাতিয়া এগুলোতে ক্যাম্প বসিয়ে যুদ্ধ চালানো তার জন্য সুবিধাজনক।
খ। মার্কিন সপ্তম নৌবহর আগমণের খবরে তাদের সাথে যুক্ত হতেই হায়াত খান এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মার্কিন নৌবহর এলেই যুদ্ধের গতি একদম ১৮০ তে ঘুরে যাবে বলে সে বিশ্বাস করেছিল। যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে অধিকতর নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে হিসেব করে চললে দুই থেকে তিন সপ্তাহ ভালমত যুদ্ধ চালানো সম্ভব।
মেজর মঞ্জুর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। পশ্চিমের অফিসারগুলো মাথামোটা হয়, তিনি এটা জানেন। হায়াত খানের বোঝা উচিত ছিল, ৭ম নৌবহর এলেও এই ভূমিতে আর যা-ই হোক, পাকিস্তানী শাসন আর চলবে না। যুদ্ধটা হয়ত দীর্ঘায়িত হবে খানিক, এতটুকুই। ৭ই মার্চের ওই মহাকাব্যিক ভাষণের পর একটা প্রাচীন জনপদ ঘুমন্ত অবস্থা থেকে জেগে উঠেছে।
এমন এক জনপদ, যাদের সাথে যুদ্ধ করতে আলেকজান্ডারের সেনারাও আর অগ্রসর হয়নি। হয়ত সেনারা ক্লান্ত ছিল, তবুও টলেমির আঁকা গঙ্গা-যমুনা বিধৌত এই ব-দ্বীপের মানচিত্রে শক্তিশালী হস্তীবাহিনীর কথা উঠে এসেছিলো সসম্ভ্রমে। এই ভূমির লোকেরা এমনই। একতাবদ্ধ হলে সব ভেঙেচুরে দিতে পারে।
হায়াত খানের শিরোমনি ফ্রন্টও আজ মধ্যরাতে ভেঙেচুরে যাবে। তিনি ১২ জন বাছাই করা মুক্তিসেনার নাম ভেবে রেখেছেন। স্টেনগান হাতে তাঁরা আজ মধ্যরাতে ট্যাংকগুলোকে স্তব্ধ করে দেবেন তিনি। ভোররাতে দুটা পিটি৭৬ ট্যাংক কে সামনে রেখে তিনি এদের নিয়ে এগিয়ে যাবেন। পরে মেজর হুদা ৬ টা ট্যাংক নিয়ে এগুবেন ডানদিক দিয়ে ওই বেতের ঝোপগুলোর মধ্য থেকে। আজরাইল ভর করবে এই ৮ টা ট্যাংকের সবগুলোতে।
২।
ভারতের অফিসাররা তেমন একটা কথা শুনতে চায়না। যৌথকমান্ড বটে, তবে একটু দাদাগিরি ওরা দেখাতে চায়। নতুন আগত রাজপুত রেজিমেন্ট আরো ঘাড়ত্যাড়া টাইপ। এরা ভেবেছিল ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর এয়ারফোর্সের এটাকের পর শিরোমনি ফ্রন্ট ধ্বসে গেছে। মুক্তিবাহিনী কমান্ডারদের কাছে খবর ছিল ভিন্ন। এখানে দু’টা পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, একটা ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্ট, দু’টা পাঞ্জাব কোম্পানি, একটা আর্টিলারী রেজিমেন্ট, একটা ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানি, একটা পশ্চিম পাকিস্তানী প্যারামিলিশিয়া রেজিমেন্ট, ৫০০ জনের কমান্ডো দল আর শ’পাঁচেকের মত আশ-শামস রাজাকার, জামাত-ইসলামী ছাত্র সংঘের লোক আছে।
বিশাল ফোর্স। বিশাল। তার উপর আছে অর্ধশত ট্যাংক, দেড়শতকের উপর আর্টিলারী, ল্যান্ড মাইন। এছাড়াও শিরোমনি হয়ে উঠেছে দুর্ভেদ্য সম্পূর্ণ অনন্য একটা কারণে। ব্রিগেডিয়ার হায়াতের মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করে মেজর হুদা আগেও শুনেছেন, খুলনা বিভাগের এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে পাকিস্তানিরা স্ট্যালিনগ্রাদ বলছে। স্ট্যালিনগ্রাদ অভ দ্য ইস্ট। বটে! হিটলার যখন স্ট্যালিনগ্রাদে এসে পৌঁছলো, সোভিয়েতের লাল ফৌজ তখন শিল্পাঞ্চলের স্থাপনাগুলোর প্রত্যেকটিকে দুর্গের মত গড়ে তোলে!
শিরোমনিতেও যে তা-ই হচ্ছে! শিল্প নগরীরের ওই অংশেই সকল জুটমিল। প্রতিটা মিলের প্রতিটা বিল্ডিং কে ওরা করে তুলেছে দুর্গের মত। ৮-১০ কিলোমিটার জুড়ে সকল স্থাপনা, প্রতি ৫০ থেকে ৬০ গজ পরপর ল্যান্ড মাইন পোঁতা, বাংকার, মেশিনগান পোস্ট, ট্রেঞ্চ ইত্যাদি।
এসব নিয়ে রাজপুত রেজিমেন্টের মেজর মাহেন্দ্র সিং ও মেজর গণির কোন ভাবান্তর ছিল না। এয়ার স্ট্রাইকের পর নীরবতা দেখে এরা ধরেই নিয়েছিল, পাকিস্তানিরা শেষ। ঘটনা তা না। মারখোর ছাগল কোয়েটার পাহাড়ের গায়ে শক্ত হয়ে লেগে থাকে। এয়ার স্ট্রাইকের সময়ও এরা মাটি কামড়ে পড়ে ছিল। মেজর মাহেন্দ্র সিং আর মেজর গণি কনভয় নিয়ে এগিয়ে গেল। অনেকটা ভিতরেই গিয়েছিল ওরা।
এতটাই ভিতরে যে, সেখান থেকে বহু ভারতীয় সেনার লাশ আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হল না। সাড়ে তিনশ’র মত লাশ নিয়ে কুকুরের মত মার খেয়ে পালিয়ে এলো। মেজর মঞ্জুর আর মেজর জলিল বলেছিলেন বারবার এভাবে আক্রমনে না যেতে। শুনলো না। ভারতের সাধারণ সৈনিক, যাদের লাশটাও খুঁজে পাওয়া গেল না, তাদের জন্য মেজর মঞ্জুরের মনটা ভারী হয়ে উঠল।
৩।
হায়াত খানকে এর আগেও আত্মসমর্পনের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী হায়াত খান সেকথা হয়ত কানেই তোলেনি। সেক্টর অধিনায়ক মেজর মঞ্জুর ও সহ-অধিনায়ক মেজর নাজমুল হুদা তাদের ফোর্স নিয়ে ফুলস্কেল এটাকে যেতে চান। মিত্রবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সদস্যরা ভড়কে গেছে রাজপুতদের অবস্থা দেখে। ভারতের রাজপুত রেজিমেন্ট প্রচন্ড মার খাবার পর এই অঞ্চলের মিত্রবাহিনী কমান্ডার মেজর দলবীর সিং এই সর্বাত্মক আক্রমণের প্ল্যানে সায় দিচ্ছেন না।
মেজর মঞ্জুরের মনে কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব নাই। প্রিয়তমা স্ত্রী ইয়াসমিনকে তিনি বিদায়ী চিঠি লিখেছেন। আজ মধ্যরাত, ১৭ ই ডিসেম্বর তিনি প্রিয় স্বদেশভূমির শেষ যুদ্ধক্ষেত্রে তার বাহিনী নিয়ে নামবেন হানাদার মুক্ত করতে। তার তো ভয় থাকার কথা না। এই যুদ্ধে তার যা-ই হোক, তার প্রিয় মুক্তিযোদ্ধারা মাতৃভূমির শেষ ইঞ্চিটুকু হায়েনাদের থেকে ছিনিয়ে নেবে!
১৬ ডিসেম্বর রাতের খাবারের পর মেজর দলবীর সিং এর কাছে সামরিক সজ্জার কোমরের বেল্ট আর চিঠি হাতে এক স্যান্ডো গেঞ্জি-লুঙ্গি পরা, মাথায় গামছা পেঁচানো দীর্ঘদেহী এক বাঙালি পুরুষকে দেখা গেল। প্রথমে দলবীর সিং চিনতে পারেন নি। ভাল করে দেখে বুঝলেন, এ হল ৮ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুর। যোগ্য গেরিলা সাজই বটে! বাঙ্গাল গেরিলা। দলবীর সিং রাতের আঁধারে আক্রমনে যেতে চাচ্ছেন না। কিন্তু মেজর মনজুরের মতে এটাই সবচেয়ে ভাল সময়, পাকিস্তানীদের ট্যাংকগুলোকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেবার জন্য। তাছাড়া ৯ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলও তার ফোর্স নিয়ে দ্রুত ধেয়ে আসছেন শিরোমনির যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য। মুক্তিবাহিনী পাগল হয়ে আছে তাদের কমান্ডারদের উপযুক্ত সময়ে গ্রিন সিগন্যালের জন্য। এটাই সঠিক সময়।
কোমরের বেল্ট খুলে অধিনায়ক যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যান, তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, তিনি যুদ্ধ জিতেই তবে ফিরবেন, নচেৎ নয়। মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর, বীরোত্তম ও তাই করলেন। কোমরের বেল্ট জমা দিয়ে বললেন, এই যুদ্ধ জিতেই তবে ফেরা। আর যদি না ফেরা হয়, ইয়াসমিনকে যেন চিঠিটা দেয়া হয়। সে যেন জানে তার প্রিয়তম মানুষ যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করতে গিয়ে মরেছে।
৪।
অল্প কিছুক্ষণ বাদে মেজর মঞ্জুরকে দেখা গেল দুই হাতে দু’টা স্টেনগান নিয়ে পাকিস্তানী ট্যাংকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তার বাছাই করা পাথুরে চেহারার ১২ জন লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা বাঙালি তরুণ তাকে অনুসরণ করে চলেছে নিঃশঙ্ক চিত্তে। নিষ্কম্প হাতে সামনে থাকা কয়েকডজন ট্যাংকের হ্যাচ খুলে গ্রেনেড ছেড়ে দিয়ে ভিতরে থাকা গানম্যানদের নিকেশ করে দিচ্ছে অনায়াসে। গোলাগুলি হচ্ছে অবিরাম, শব্দে কান পাতা দায় হয়ে পড়ল। তবুও সে শব্দ ছাঁপিয়ে একেকটা ট্যাংকের গানম্যান নিকেশ করে দিয়ে “জয়বাংলা” গর্জন বাংলাদেশের বিজয় ঘোষণা করতে লাগল বারংবার।
ভোরবেলায় তীব্র কুয়াশায় আক্রমণের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হল। সামনে দুটা পিটি৭৬ ট্যাংক নিয়ে নিচু জমি থেকে থেকে মেজর মঞ্জুর উঠে এলেন তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে সড়ক পথে। ট্যাংক এগিয়ে দিয়ে সম্মুখব্যুহে ঢুকলেন তারা। সামনে ট্যাংক ফেলে তারা রেখে সরে গেলেন পিছন থেকে, কুয়াশার চাদরে নিজেদের জড়িয়ে পাকিস্তানি ব্যুহের ভিতর ঢুকে যাবার জন্য। মেজর মাহেন্দ্র’র মত ভুল করার কোন মানে হয় না। শীতের সকালের মিষ্টি রোদ মেখে শত্রুকে আক্রমণ চলেনা। জাঁকিয়ে বসা শীতের মধ্যরাত আর ভোরের এই ভয়াবহ কুয়াশা বেশ মানানসই।
আক্রমণ হলই এই উপযুক্ত সময় জুড়েই। কুয়াশা সরে যেতেই ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, স্টালিনগ্রাদ অভ দ্য ইস্টের ট্যাংকের আওয়াজ স্তব্ধ করে দিয়েছে লুঙ্গি-স্যান্ডো গেঞ্জি পরা অল্পবয়েসী ক’জন “বাঙ্গাল”। যুদ্ধ চলছে বটে, তবে তা আরো চালালে পুরো ব্রিগেডসহ নিজেকে খুন হয়ে যেতে হবে বলে মনে হচ্ছে।
মেজর খন্দকার নাজমুল হুদা তার ফোর্স নিয়ে মধ্যরাতের প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান থেকে ভোররাতেই আক্রমণভাগে সরে আসলেন। সকালে একটু বেলা হলে তিনি ৭ পাঞ্জাব আর্টিলারী রেজিমেন্টকে ফায়ারিং এর গ্রিন সিগন্যাল দিলেন। ভারতীয় সেনারা নিরাপদ দুরত্ব থেকে আর্টিলারীর ভারী গোলাবর্ষণ শুরু করল। অল্প কিছুক্ষণ পরই মেজর দলবীর সিং আবারো এয়ার স্ট্রাইকের জন্য ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের ইস্টার্ন উইংকে অনুরোধ করেন। মানেটা বোঝা গেল? ঢাকার সুবোধ বালকদের মত আত্মসমর্পন করে ফেলো বাছারা। নয়তো, কচুকাটা করা হবে।
মেজর মঞ্জুর আর মেজর হুদার সেনারা বাঙ্কার খুজে খুজে যখন গ্রেনেড মারছিল, তখনই দেখে রাজাকারসহ পাকবাহিনীর সদস্যরা দিকবিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে ভেগে যাওয়া শুরু করছে। গল্লামারী রেডিও স্টেশনের দিকে পলায়নপর এই দলটা পৌঁছানো মাত্র সবিস্ময়ে আবিষ্কার করে ৯ নং সেক্টরের মেজর জয়নাল আবেদীন গল্লামারী রেডিও স্টেশন দখল করে “জয়বাংলা” ট্রান্সমিট করে চলেছেন সহোৎসাহে।
ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান সহ পর্যুদস্ত এই বাহিনী দুপুরে আত্মসমর্পন করে নসু খানের ইটভাটার কাছে।
আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পন অনুষ্ঠিত হয় বেলা দেড়টায়, খুলনা সার্কিট হাউজ প্রাঙ্গনে। উপস্থিত ছিলেন মিত্রবাহিনীর পক্ষে মেজর দলবীর সিং, ৮ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর, ৯ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল। ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের কোমরের বেল্ট ও ব্যাজ খুলে আত্মসমর্পন দলিলে সাইন করিয়ে নেয়া হয়। এসময় তার সাথে ছিল ৩ হাজারের মত সৈন্য ও এদেশীয় কুলাঙ্গার আশ-শামস সদস্যরা।
৫।
শিরোমনির যুদ্ধ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ ব্যাটলফিল্ড। আমরা হলিউডের সিনেমায় এভেঞ্জারদের “সেভিং দ্য ওয়ার্ল্ড” শুনে আহ্লাদিত হই, তাদের মত হতে চাই, ধারণ করি তাদেরকে পোস্টার, টি-শার্ট আর স্টিকারের মাধ্যমে। এন্ডগেম দেখতে বসুন্ধরায় পাড়াপাড়ি লাগিয়ে দেই। আমাদের আসল এন্ডগেমের ইতিহাস কি জানি আমরা? কিংবা ব্র্যাড পিটের ফিউরি দেখে অনেককে কষ্ট পেতে দেখেছি। মুভি ভাল, সন্দেহ নাই। কিন্তু আপনার জন্মভূমির বৃষ্টিভেজা সোঁদা গন্ধে যে শিরোমনির ট্যাংক যুদ্ধের প্রলয়ের চিহ্ন রয়ে গেছে তা কি জানতে চেয়েছেন?
তবে আমরা না জানলেও ইন্ডিয়া, পোল্যান্ড সহ ৩৫টা দেশের সমরবিদ্যার শিক্ষায় কিন্তু “ট্যাংক ব্যাটল অফ খুলনা” পাঠ্যবস্তু। কেনই বা হবে না? ওই যুদ্ধে ৮-১০ কিলোমিটারের ভিতরে একটা গাছ পর্যন্ত অক্ষত ছিল না। স্থাপনাগুলো তো গুড়িয়ে গেছে ডিসেম্বরের ১০ তারিখের পর থেকে আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের ফলে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর এত ভয়াবহ ট্যাঙ্ক ব্যাটল আর হয়েছিল কি না, তা পৃথিবীর ইতিহাস জানে না। ডিফেন্স জার্নালে অন্তত পাই নি আমি।
পাকিস্তানী ফোর্সের জানা হিসাব আমি দিয়েছি এখানে, আপনি শুধু কল্পনা করে দেখেন, যুদ্ধে একবেলাও ডাল-ভাত না পাওয়া আমাদের পূর্বপুরুষরা কিসের জোরে গুড়িয়ে দিয়েছিলেন ওত বড় আর শক্তিশালী বাহিনীকে। কিসের জোরে দুইহাতে দু’টা স্টেনগান নিয়ে মেজর মঞ্জুর ওই কুয়াশার রাতে মহাপ্রলয়ের নটরাজ বনে গিয়েছিলেন? কে ছিলেন সেই ১২ জন কমান্ডো? কি ছিল তাদের সেই জোর, যার জেরে শেষ ব্যাটলফিল্ড পর্যন্ত সমান উদ্যমে নিকেশ করে দিয়েছিলেন পাকি হানাদার আর এদেশীয় রাজাকারদের?
উত্তর খুঁজুন। খুঁজে পেলে দেখবেন খাঁটি বাঙালী পরিচয়ে আর খারাপ লাগছে না আপনাদের। খুঁজে পেলে দেখবেন, আপনার যে পড়শি ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে বলে- দেশে কোন যুদ্ধ হয় নাই, যুদ্ধাপরাধ হয় নাই, তাকে আপনি কতটা ঘৃণা করেন। খুঁজে পেতেই হবে আপনাদের। নাহলে কে সিনেমা বানাবে আমাদের এন্ডগেমের? কে এই বীরত্বের ইতিহাস পাঠ করাবে এই প্রজন্মকে?