আমাদের শিল্পীদের কি আমরা নিজেরাই মেরে ফেলিনি?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
পাইরেসির খপ্পরে পড়ে অডিও বাজার ধ্বংস হয়ে গেছে অনেক আগেই। আবার গুগল বা ইউটিউবের গুণে এক ক্লিকেই ডাউনলোড করে ফেলা যায় গান, সেখান থেকে তো শিল্পীরা টাকা-পয়সা পাবেন না তেমন কিছুই। তাহলে কেন তারা কষ্ট করবেন বলুন?
খুব অপ্রিয় কিছু কথা বলতে চাই আজ। আইয়ুব বাচ্চু মারা গেলেন বছরখানেক আগে, গুণী এই শিল্পীর অকালমৃত্যুতে সবাই শোকাহত হয়েছেন, ফেসবুকের নিউজফিড আর টিভি চ্যানেলের পর্দাজুড়ে কেবল দুঃখগাঁথাই চোখে পড়েছে। সবার মতো আমিও শোকের সাগরে ভেসেছি, সেইসঙ্গে কিছু কথাও মাথায় এসেছে। সেই মূহুর্তে সেগুলো বললে গালি একটাও হয়তো মাটিতে পড়তো না। সত্য তেঁতো হয়, সত্য ভয়ানক হয়, অপ্রিয় হয়, এসব কথা শুনতে ভালো লাগে না, বলতেও না। তবে কখনও না কখনও তো কথাগুলো বলতেই হবে।
আচ্ছা, গত পাঁচ-সাত বছরে সঙ্গীতজগতে আইয়ুব বাচ্চুর অবদান কী ছিল? প্রশ্নটা শুনেই তেড়ে আসবেন না দয়া করে। শুধু আইয়ুব বাচ্চু নন, জেমস, হাসান, বিপ্লব, কিংবা এরকম আরও যাদের গান শুনে আমরা বড় হয়েছি, আমাদের কৈশোর যাদের সঙ্গে কেটেছে, সেই শিল্পীরা কি আমাদের নতুন কিছু উপহার দিতে পেরেছেন গত অর্ধযুগে, বা গত এক দশকে? কনসার্ট বা টেলিভিশনে লাইভ গান গাওয়া ছাড়া এই শিল্পীরা নতুন আর কিছুই করছেন না এখন। কোনো অ্যালবাম নেই, তেমন কোন নতুন গানও নেই। কেন এই অবস্থা?
একটা সময়ে কী দারুণ সমৃদ্ধ ছিল আমাদের সঙ্গীত জগত! ভাবলেও এখন রূপকথার মতো লাগে। জেমসের অ্যালবাম বের হবে, পত্রিকায় খবর দেখে অডিও ক্যাসেটের দোকানে আগে থেকে নাম লিখিয়ে আসা লাগতো তখন। নইলে ক্যাসেট হাতে পাবার কোন নিশ্চয়তা নেই। একশো কপি আসুক কিংবা এক হাজার, শেষ হয়ে যাচ্ছে নিমেষেই! যেদিন ঢাকা থেকে অ্যালবাম শহরে পৌঁছানোর কথা, সেদিন ভোর থেকেই ক্যাসেটের দোকানের সামনে মানুষের লাইন- এসব দিন হারিয়ে গেছে অনেক আগেই!
বালামের প্রথম অ্যালবামটা যখন রিলিজ হয়েছিল, তখন আমাদের পুরো শহরজুড়ে শুধু ঘুরেফিরে ওই গানগুলোই বাজতো টানা কয়েকটা মাস! একটা সময় ছিল, যখন একটার পর একটা অ্যালবাম বের হয়েছে শুধু। এলআরবি-নগরবাউল তো নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীতাই করতো, সঙ্গে সেই দৌড়ে ছিল দলছুট, সোলস, মাইলসের মতো ব্যান্ডগুলোও। প্রমিথিউস বা আর্কের অ্যালবাম আসা মানেই যেন একটা উৎসবের মতো ছিল ভক্তদের কাছে। পিছিয়ে থাকতো না একক বা মিক্স অ্যালবামও। আসিফ, মনির খান, মমতাজ কিংবা অ্যান্ড্রু কিশোর, কুমার বিশ্বজিৎ, সবার ক্যাসেটই বিক্রি হতো হাজারে হাজারে। ঈদ-পূজা-ভালোবাসা দিবস বা পয়লা বৈশাখ, সব উৎসবেই রিলিজ হতো অডিও অ্যালবাম, সেগুলো কেনার জন্যে হুমড়ি খেয়ে পড়তো শ্রোতারা। এখন সেই দিন কোথায়?
পাইরেসির খপ্পরে পড়ে অডিও বাজার ধ্বংস হয়ে গেছে অনেক আগেই। সেই পাইরেসি বন্ধ করার চেষ্টা করেনি দায়িত্বশীল কেউই, পাইরেসি কারা করছে, তাদের গোড়াটা ধরে টান মারা যে দরকার, সেসবও মনে হয়নি তৎকালীন সরকারগুলোর। দিনের পর দিন শিল্পীরা বঞ্চিত হয়েছেন প্রাপ্য সম্মানী থেকে। ইন্টারনেট সহজলভ্য হবার পরে তো শিল্পীদের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিয়েছে প্রযুক্তিই। কীসের আশায় শিল্পীরা এখন মেধা খরচ করে, পরিশ্রম করে নতুন গান করবেন বলুন তো? আমরা তো গুগলে সার্চ দিয়ে এক ক্লিকেই ডাউনলোড করে ফেলতে পারবো সেগুলো, ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়বে সাথে সাথেই। সেখান থেকে তো শিল্পীরা টাকা-পয়সা পাবেন না তেমন কিছুই। তাহলে কেন তারা কষ্ট করবেন বলুন?
শিল্পচর্চাটা ভালোবাসা থেকে হয়। কিন্ত সেটার সাথে প্রাপ্য সম্মানীটাও লাগে। শিল্পীর পেটে ভাত না থাকলে শিল্প বের হবে না কোনোদিন। যুগ বদলেছে, মিডিয়া এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে চলে এসেছে। অডিও অ্যালবাম এখন আর কেউ কিনবে না, সবাই ইউটিউবেই গান শুনবে। কিন্ত এই মাধ্যমটার সঙ্গে আমাদের শিল্পীদের সিংহভাগই সেভাবে জড়িত নন, বিশেষ করে সিনিয়র শিল্পীরা তো একেবারেই নন। এই মাধ্যমের সাথে তাদের যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয়ার ব্যাপারটাতে তো কেউ হাত দিলেন না এত বছরেও। ইউটিউবে ঢুকলেই আপনি জনপ্রিয় সব গানই শুনতে পাবেন, এই গানের ভিউ'র ওপরে তো শিল্পীর রয়্যালিটি পাবার কথা ছিল, অথচ অমুক তমুক চ্যানেল থেকে আপলোড হওয়া এই গানগুলো থেকে তারা কানাকড়িও পাচ্ছেন না। এটা কি ডিজিটাল মিডিয়ার প্রতি শিল্পীদের অবহেলা, নাকি শিল্পীদের প্রতি আমাদের অবহেলা?
এদেশের শিল্পীদের হাজার হাজার গান প্রতিদিন মোবাইল কোম্পানীগুলোর কলার টিউন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কয়েক বছর আগেও রিংটোন আর কলার টিউনের ব্যবসাটা দারুণ লাভজনক ছিল মোবাইল কোম্পানীগুলোর জন্যে, এখন কী অবস্থা জানি না। শিল্পীদের গান দিয়ে গ্রাহকের পকেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নেয়া মোবাইল কোম্পানীগুলো কি শিল্পীদের প্রাপ্য সম্মানীটা বুঝিয়ে দিয়েছেন? এক কথায় উত্তর হচ্ছে- না।
আবার শিল্পীদের কেউ কেউই নিজেদের সহকর্মীর হয়ে ভূয়া কাগজপত্র বানিয়ে মোবাইল কোম্পানীগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে বসে আছেন, টাকা আত্মসাৎ করছেন বলে অভিযোগ আছে! কিছুদিন আগে এমনই এক মামলায় কয়েকদিন জেলও খেটে এসেছেন গায়ক আসিফ আকবর! প্রাপ্য সম্মানী থেকে বঞ্চিত হবার বেদনাটা হয়তো সবাই প্রকাশ করেন না। কিন্ত শিল্পীদের কথার ভেতরেই বেদনাটা লুকিয়ে থাকে। নইলে এত এত জনপ্রিয় গানের জন্ম দেয়া মাহফুজ আনাম জেমস কেন অভিমান করে বলেন, 'যা গাওয়ার গেয়ে ফেলেছি, নতুন করে আর কোনো গান গাইতে চাই না। এখন শুধু পুরনো গান গেয়েই কাটিয়ে দেব...' কেন আইয়ুব বাচ্চুর মতো শিল্পী জীবনের শেষ আট-দশ বছরে বলার মতো কোনো সৃষ্টি তৈরি করলেন না, কেন আজম খানের মতো গুণী শিল্পী শেষ বয়সে অসুস্থ হলে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর মতো তেমন কাউকে পাওয়া যায় না?
শিল্পীরা উপঢৌকন চান না, বাড়তি কোনো সুযোগ সুবিধা চান না, বারিধারায় প্লট বা ফ্ল্যাটও চান না। তারা চান সম্মান, আর চান, তাদের কাজের পারিশ্রমিক। সেটাও যদি পাওয়া না যায়, নতুন গান, নতুন শিল্প কি আকাশ ফুঁড়ে বেরুবে?
শিল্পীরা মারা গেলে তাদের জন্যে দুঃখপ্রকাশ করার চাইতে বেশি জরুরী জীবদ্দশায় তাদের প্রাপ্য সম্মান আর সম্মানীটা বুঝিয়ে দেয়া। কেউ মারা গেলে তার জন্যে আপনি শোক প্রকাশ করলেন কী করলেন না, তাতে সেই মানুষটার কিছুই আসে যায় না। কিন্ত বেঁচে থাকার সময়টায় তিনি যদি পাশে কাউকে না পান, যদি আর্থিক নিরাপত্তার অভাবে তার শিল্পচর্চাটাই বাধাগ্রস্থ হয়, তাহলে শিল্পীর বেঁচে থাকার প্রেরণাটাই ফুরিয়ে যায়।
বিপ্লব-হাসানরা হারিয়ে গেছেন, ব্যান্ডগুলো ভেঙে গেছে, আইয়ুব বাচ্চু তো চলেই গেলেন, থেকেও অনেকটা না থাকার মতোই আছেন জেমস। এগুলো দেখলে, এসব কথা ভাবলে কষ্ট পাওয়া ছাড়া আর কোন লাভ হয় না আসলে। মানুষ আইয়ুব বাচ্চু নাহয় ২০১৮ সালে মারা গিয়েছেন, কিন্ত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুকে তো আমরা মেরে ফেলেছি আরও দশ বছর আগেই, মেরে ফেলেছি জেমস, হাসান বা অন্যান্য যারা ছিলেন তাদেরও। আর এই দায়টা আমাদের সবার...