তারা এই একমাসে কল্পনাতীত এক কাজ করেছে। তাদের সংগ্রহ করা প্ল্যাস্টিকের সংখ্যা কত জানেন? ১০ হাজার? ৫০ হাজার? ১ লাখ? নাহ। ১০ লাখ, তাও না।

বিডি ক্লিন নিজেদের ছাপিয়ে যাচ্ছে বার বার। কিছুদিন আগে এগিয়ে চলো'তে তাদের অন্যরকম এক সুবাস ছড়ানোর গল্প লিখেছিলাম। যে ময়লার স্তুপের সামনে দিয়ে যেতে যেতে মানুষ নাক চেপে ধরতো, তারা সেসব ময়লা দূর্গন্ধ পরিষ্কার করে সেখানে গাছ লাগিয়ে এসেছে। ফুলের বাগান করে দিয়েছে। এখন আর সেখানে মানুষ ময়লার গন্ধ বিব্রত হয় না বরং ফুলের সুরভিতে তারা হাসে।

এবার বিজয় দিবসে তারা আরো বিশাল এক ঘটনা ঘটিয়েছে। অভূতপূর্ব এই দৃশ্যকে উপলব্ধি করা খুব জরুরি আমাদের জন্যে। কারণ, বিডি ক্লিন এক দেশপ্রেমের অনন্য নজির গড়েছে। মৌখিক কথার ফুলঝুরি নয়, কাজ দিয়ে তারা দেখিয়েছে দেশকে এভাবেও ভালবাসা যায়।

বিডি ক্লিন কি করেছে সেটা বরং খুলেই বলি৷

বিডি ক্লিন নভেম্বর ১০ থেকে ডিসেম্বর ১০ - এই এক মাসে গোটা দেশ থেকে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক সংগ্রহ করেছে। যে প্লাস্টিক মাটির সাথে মিশে না, পরিবেশকে নষ্ট করে দিচ্ছে, জলবায়ু ও পরিবেশ সংকটকে তীব্রতর করছে সেই প্লাস্টিকগুলো তারা দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে সংগ্রহ করেছে। সবুজ রংয়ের টি শার্ট পরিহিত একদল প্রাণোচ্ছল তরুণরা দেবদূতের মতো বিডি ক্লিনের সদস্য হয়ে ছড়িয়ে আছে সারাদেশে। তারা এই একমাসে কল্পনাতীত এক কাজ করেছে। তাদের সংগ্রহ করা প্ল্যাস্টিকের সংখ্যা কত জানেন? ১০ হাজার? ৫০ হাজার? ১ লাখ? নাহ। ১০ লাখ, তাও না। তারা একমাসে সংগ্রহ করেছে ৩০ লক্ষ পরিত্যক্ত প্লাস্টিক!

প্লাস্টিক বিষ! 


কেন ৩০ লক্ষ? তারা বলছে, "যে দেশের মাটিতে শহিদের রক্ত মিশ্রিত, সে মাটিকে প্লাস্টিক দুষণ ও পরিচ্ছন্ন রাখা সহ ৩০ লক্ষ শহিদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় পরিবেশের জন্য মারাত্মক দূষণকারী ৩০ লক্ষ পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে সংগ্রহ তার রিসাইকল নিশ্চিত করতেই বিডি ক্লিনের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।"

বিজয় দিবসকে উদযাপন করতে এর চেয়ে দারুণ ইনিশিয়েটিভ আর কিছু হতে পারে? আমি দেখেছি রাজনীতিবিদরা এলাকায় এলাকায় গালভরা বুলি আউড়াচ্ছেন, বিরানী রান্না করে ফকির মিসকিনকে দেয়ার নাম করে নিজেরাই সাঙ্গোপাঙ্গ মিলে সাবাড় করছেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আর হিন্দি গান একসাথে মাইকে লাগিয়ে বিজয় দিবস পালন করছেন। এই বিজয়ের মাহাত্ম্য কি আদৌ কি এসব সিজনাল নেতা, আতি পাতি নেতারা বোঝেন?

মুক্তিযুদ্ধের ক্যানভাসকে বোঝার জন্যে, মুক্তিযুদ্ধের আবেগটা, দেশপ্রেমের তীব্রতাকে ধারণ করার জন্যে আউট অফ দ্য বক্স কি করা উচিত সেটা আসলে করে দেখালো বিডি ক্লিন৷ তারা এমন এক কাজ করলো, যা আমাদের লজ্জায় ফেলে দিলো। আমরা যারা পানি খেয়ে বোতল ছুঁড়ে ফেলি রাস্তায় আর ফেসবুকে এসে বড় বড় লেকচার ঝাড়ি, তাদের জন্য শেখার আছে অনেক কিছু। আমাদের অধিকাংশ মানুষই কথা অনেক বেশি বলি, কাজের বেলায় ঠনঠন। বিডি ক্লিন আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালো কিভাবে দেশকে ভালবাসা যায়, কিভাবে কাজের মাধ্যমে সে ভালবাসা প্রকাশ করা যায়।

এখনো তো ইন্টেরেস্টিং কথাটাই বলিনি। এই ৩০ লক্ষ প্লাস্টিক নিয়ে তারা করেছে কি জানেন?

বিডি ক্লিন প্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরীতে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক বোতল দিয়ে প্রদর্শনী করেছে। সেখনে তৈরী করা হয়েছে ১৯ ফিট বাই ৭১ ফিট একটি নৌকা। যা নদীমাতৃক বাংলাদেশ ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে নির্দেশ করে। সেইসাথে প্লাস্টিক বোতলের ঢাকনা দিয়ে তারা তৈরী করেছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি। এই প্লাস্টিকের বোতল দিয়েই তারা জাতীয় পতাকা খচিত বাংলাদেশের মানচিত্র তৈরি করেছে। শুধু তা-ই নয়, তারা জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও তারুণ্যের প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগারের প্রতিকৃতিও করেছে। এসব ছাড়াও পরিত্যক্ত প্লাস্টিক বোতল দিয়ে তৈরি বিভিন্ন সামগ্রীর দেখা মিলবে তাদের এই প্রদর্শনীতে।

প্লাস্টিক বোতলের মুখ দিয়ে তৈরি মানচিত্র  


এই অভূতপূর্ব প্রদর্শনী আপনি দেখতে পাবেন মহাখালীর টিএন্ডটি স্কুল মাঠে। আরো ৫ দিন চলবে এই প্রদর্শনী৷ কিন্তু, কেন তারা এই প্রদর্শনী করলেন? শুধু বিজয় দিবসে চমক দেখাবার জন্যে? না। তাদের বৃহৎ একটি উদ্দেশ্য আছে। তারা বলছেন,

কেন এই ব্যাতিক্রমধর্মী প্রদর্শনী?

যে মাটিতে শহীদের রক্ত মিশে আছে, সে মাটিকে প্লাস্টিক দূষণ থেকে বাঁচাতে চান তারা৷ প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ে সচেতন করতে চান মানুষকে। আমরা ময়লা ফেলার সময় ভাবি, একটা বোতল ফেললে কি এমন হবে? কিন্তু এই একটা একটা করেই কত বিশাল স্তুপ হয় তা বিডি ক্লিনের এই প্রদর্শনী না দেখলে কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না হয়ত। এই প্লাস্টিক রিসাইকেল করতে না পারলে আমাদের দেশকে মারাত্মক ক্ষতির মুখে ফেলে দিবে, ইতিমধ্যে ফেলেছেও। বিডি ক্লিন এই করুণ সত্যকে সামনে নিয়ে এসেছে।

বিডি ক্লিন বলছে, "যে সকল কোম্পানি প্লাস্টিক বোতলজাত পানীয় ও খাদ্য উৎপাদন করে বাজারজাত করে যাচ্ছে, তাদেরকে বোঝাতে চায় তারা। খালি প্লাস্টিক বোতলগুলো যেন এই কোম্পানিগুলো নিজ দায়িত্বে সংগ্রহ করে তার সঠিক রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা করার গুরুত্ব বোঝে সেই উপলব্ধির জায়গা তৈরি করতে চায় বিডি ক্লিন।

তাদের এই উদ্যম, ভাবনার জায়গাগুলো রীতিমতো মুগ্ধতা জাগানিয়া, ঠিক তাদের কাজের মতোই। খুব পাগলাটে না হলে বোধহয় একমাসে এই জাদুকরি ইভেন্ট করা সম্ভব হতো না তাদের পক্ষে। বুঝতে পারি, ভালবাসার জায়গাটাকে কতটা তীব্রভাবে ধারণ করলে এই পাগলামো করা যায়।

সবুজ টি শার্ট পড়া এই স্বপ্নবাজ তরুণদল এমনই ক্ষ্যাপাটে থাকুক, দেশপাগলা থাকুক। তাদের এই পাগলামো রোগটা সংক্রমক হোক সবার মধ্যেই। তবেই, না একটা দেশ পাবো, বিজয় মানে কি তা উপলব্ধি করতে পারব সত্যিকার অর্থে...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা