হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কুকুরের আনাগোনা, ভুয়া করোনা রিপোর্ট প্রদান, সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা পেতে এত ভোগান্তি- আর কোনো মধ্যম আয় বা উন্নয়নশীল দেশে কি এসব সম্ভব?
ফেইসবুক স্ক্রল করছি। হঠাৎ একটা ছবিতে থমকে গেলাম। দেশের একটা বিভাগীয় শহরের হাসপাতালের বারান্দায় জরুরি ইউনিট বসিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ বাদে পৃথিবীর আর কোনো মধ্যম আয়ের বা উন্নয়নশীল দেশে এ চিত্র কল্পনা করা যায়? যাহোক, আমরা না হয় মাত্রই ‘বড়লোক’ হচ্ছি, তাই কিছু সমস্যা থাকতেই পারে। আর কদিন গেলে হয়তো সব ‘ঠিকঠাক’ চলবে।
কিন্তু হাসপাতালের সেই জরুরি ইউনিটে কয়েকটা কুকুর এলোপাতাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আচ্ছা, এটা কি মেনে নেওয়ার মতো কোন বিষয়? এটাও হতে পারে? কোথায় বাস করছি আমরা? রাষ্ট্রের কাছে আমাদের এই প্রাপ্য ছিল? আমরা যে এত উন্নয়ন উন্নয়ন করে মুখে ফেনা তুলে ফেলি, আমার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত না করে এত উন্নয়ন দিয়ে কী হবে? একটা দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নই সব?
শুধুমাত্র ঐ হাসপাতালের জরুরি ইউনিটেই নয়, দেশের পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থাতেই এমন কিছু কুকুররা এলোপাতাড়ি ঘুরে। ঘুরে ঘুরে এই খাতটাকে কামড়ে ধ্বংসের ধারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
গত ক'দিন আগের ঘটনা। রাজধানীর একটি স্বনামধন্য বেসরকারী হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে র্যাব প্রায় ৪২০০ ভুয়া করোনা রিপোর্ট জব্দ করে। একদিন পরে জানা যায়, টেস্ট ছাড়াই হাসপাতালটি অন্তত সাত হাজারের অধিক মানুষের ভুয়া করোনা রিপোর্ট সরবরাহ করেছে!
একজন সুস্থ মানুষ কীভাবে এমন কাজ করতে পারে? যে মানুষগুলো বিশ্বাস করে এই হাসপাতাল থেকে করোনা টেস্ট করিয়েছেন, তাদের কী অবস্থা? কিংবা যে আক্রান্ত, তাকে টেস্ট না করিয়ে যখন নেগেটিভ ফলাফল জানানো হয়েছে তাঁর কী অবস্থা?
আল্লাহই ভাল জানেন এসব ভুয়া রিপোর্টের কারণে কত মানুষের মাঝে রোগ ছড়িয়েছে। অথচ জানা গেছে, হাসপাতালটি দেশে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই সরকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে করোনা চিকিৎসা দিয়ে আসছে। চুক্তি সম্পাদনের সময় সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন।
এমনকি এও জানা গেছে, হাসপাতালটি ২০১৪ সাল থেকে লাইসেন্স নবায়ন না করেই পরিচালিত হয়ে আসছে! এমন একটি লাইসেন্সবিহীন ও ভুয়া রিপোর্ট প্রদানকারী হাসপাতাল এ পর্যন্ত দেশের মানুষের যত ক্ষতি করেছে তার দায় কী স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্তরা এড়াতে পারেন?
এ তো গেলো টেস্টের কথা। হাসপাতালগুলোতে সেবার মানের যে কত নাজেহাল অবস্থা, কত যে নিকৃষ্ট তা বলাই বাহুল্য। বেশ কদিন আগে একটা টিভি রিপোর্ট দেখেছিলাম। একজন বাবা তার সন্তানকে চিকিৎসার জন্য গ্রাম থেকে ঢাকা নিয়ে এসছেন। কিন্তু কোথাও ভর্তি করাতে পারছেন না। করোনা সন্দেহে কেউ ভর্তি করছে না। রাজধানীর সব সরকারি হাসপাতাল ঘুরেও যখন ভর্তি করতে পারেন নি তখন সরকারি এক হাসপাতালের একজন ‘দরবেশ’ তাকে পথ দেখালো। একটা প্রাইভেট হাসপাতালের খোঁজ দিলেন। চড়া মূল্যের সে হাসপাতালেও সুচিকিৎসা না পেয়ে শেষে শিশুটি মারা গেল! কী দোষ ছিল শিশুটির? তাঁর কি দেশের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার ছিলো না?
করোনাকালের এই কয়েকমাসে এমন লাখ লাখ ঘটনা আমাদের চারপাশে ঘটছে। তবে হ্যাঁ, ব্যতিক্রম আছে কিছু। কোথাও কোথাও সেবার মান ঠিক আছে। রোগীরা ঠিকমতোই সেবা পাচ্ছে। কিন্তু সেটাই তো স্বাভাবিক। একটা উন্নয়নশীল বা মধ্যম আয়ের দেশের মানুষ মৌলিক চাহিদাজনিত সমস্যার সঠিক সমাধান পাবেন এটাই তো স্বাভাবিক।
কিন্তু এই দেশের সিংহভাগ রোগী সেটা পাচ্ছেন না। দুর্ভাগা দেশের মানুষ এমন জটিলতায় পড়বে তা আগেই অবশ্য ঠাওর করেছিলেন বিশ্লেষকরা। কোভিডকালে এমন যাতাকলে পৃষ্ঠ হয়ে হাজারো নাগরিক তাদের কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হবেন তা তারা আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
তবে এই দেশের স্বাস্থ্যখাতের অবস্থাটা হুট করেই যে এতটা নাজুক হয়ে পড়েছে, তা কিন্তু নয়। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে, আমরা বহু আগে থেকেই এমন দৈন্যতায় দিন কাটাচ্ছি। যার চূড়ান্ত প্রকাশ এখন দৃশ্যমান। করোনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমরা কতোটা দুর্ভাগা। এই মহামারি মোকাবেলায় যখন সারাবিশ্ব তালমাতাল, তখন গুটিকয়েকজন বাদে আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তিরা হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ রোগীরা হাসপাতালের পর হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা পাচ্ছে না। মেনে নিলাম, ভ্যাকসিন নাই বলে বা নির্দিষ্ট ওষুধ না থাকায় কোভিড চিকিৎসায় আমাদের চাহিদার সেই কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়ার পূর্ণ সক্ষমতা রাষ্ট্রের নেই। কিন্তু আমি কোভিড আক্রান্ত কিনা তা শনাক্ত করার সক্ষমতা কি এই রাষ্ট্রের নেই? না থাকলে কেন থাকবে না? আমরা ভুগছি, আমরা মরছি কেউ দেখছে না। দেখার কেউ নেই? নষ্ট এই সিস্টেমটাকে ঢেলে সাজানোর জন্য কোন সে দরদী যে সব পালটে দিয়ে কিছুটা হলেও ঠিক করবে, এই অসহায়ত্ব থেকে আমাদের মুক্তি দেবে।
আমি জানি, এমন করে হাজার হাজার মানুষ বিলাপ করলেও কেউ এগিয়ে আসবে না। হয়তো দেশের সরকারপ্রধান আর সাথে হাতে গোনা অল্প কিছু মানুষ প্রানান্তর চেষ্টা করছেন কিন্তু তাদের সাথে তাল মিলিয়ে দেশটা রক্ষা করার দায়িত্বে আর কেউ নেই? ১৮ কোটি মানুষের একটা অসহায় দেশকে বাঁচানোর জন্য, লড়াই করা মানুষের কেন এত অভাব!
অবশ্য অভাব থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ এদেশে বিত্তের লোভে সবাই দৌড়ায়। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী নিজেই দলের নেতাদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘হাসিনা ছাড়া দলের সব নেতাকে কেনা যায়’। কর্মী বা বিরোধীদলের কথা তো বাদই দিলাম।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন