বাংলাদেশের বন্দরে ভারতীয় পণ্য পাবে প্রায়োরিটি: এ কেমন বন্ধুত্ব?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
দুনিয়ার প্রতিটা দেশ কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি করার সময় নিজের স্বার্থটাই আগে দেখে। আমরাই এক ব্যতিক্রমধর্মী অতিথিপরায়ণ দেশ, যারা অতিথি বন্ধুর জন্য নিজের দেশের নাগরিকদের বলি, 'বাবারা, একটু মানিয়ে নাও, বুঝোই তো- অতিথির মনে কষ্ট দেওয়াটা কি ঠিক?'
ভারত ও বাংলাদেশ উভয় সরকারই দাবী করে এই দুইটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক যে কোন সময়ের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ, দুইটি বন্ধুপ্রতিম দেশের উদাহরণ হিসেবে বিশ্বে অতুলনীয়।
এই বন্ধুত্বের কিছু উদাহরণ আমরা দেখেছিও। নানা সমস্যা সমাধানে তারা নানা চুক্তি করছে, শান্তিপূর্ণ ভাবে, আলোচনার মাধ্যমে। তবে- একটু খটকা আছে। চুক্তিগুলোতে কীভাবে কীভাবে যেন বাংলাদেশ শুধু উদারমনা বন্ধুর মত দিয়েই যাচ্ছে, দিয়েই যাচ্ছে…
ফারাক্কা বাঁধ, টিপাইমুখি বাঁধ নির্মাণ করে এবং তিস্তা নদীর পানি আটকে বাংলাদেশকে তার ন্যায্য পানি দিচ্ছে না ভারত উলটো বন্যার সময় পানি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে দিচ্ছে- যদিও ১৯৯৬ ও ২০১১ সালের করা চুক্তিতে ন্যায়সঙ্গত পানি পাওয়ার কথা ছিলো। এসব পুরানো কথা। উলটো বাংলাদেশ গত বছর অক্টোবরে ফেনী নদীর ১.৮২ কিউসেক পানি ত্রিপুরার সাব্রুম শহরে সরবরাহ করার জন্য চুক্তি করে এসেছে “মানবিক” বিবেচনায় কারণ সেখানে খাওয়ার পানি নেই। যদিও তিস্তা নিয়ে আজতক কোন সুরাহা হয়নি।
একই অবস্থা দেখেছি আমরা ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট চুক্তির বেলাতেও। বাংলাদেশের উপর দিয়ে পন্য পরিবহনে টন প্রতি ভারতের খরচ পড়ছে ২ ডলারেরও কম যা বিশ্বে সর্বনিন্ম! একই অবস্থা আমদানী রপ্তানি ঘাটতি, সীমান্তে হত্যা, এনআরসির কারণে বাংলাদেশে ভারতীয়দের পুশব্যাকসহ সকল ইস্যুতেই!
তবে সবচেয়ে নির্লজ্জ বন্ধুত্বের উদাহরণ আমরা সম্ভবত কিছুদিনের মধ্যেই প্রত্যক্ষ করবো।
২০১৮ সালের অক্টোবরে দিল্লিতে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য সরবরাহ করতে দুই দেশের চুক্তি হয়। সেই চুক্তির আওতায় প্রথমবারের মতো গতকাল কলকাতার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বন্দর থেকে চারটি কনটেইনার রড ও ডালের একটি চালান নিয়ে যাত্রা করেছে এমভি সেঁজুতি নামের একটা জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশ্যে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কাভার্ড ভ্যানে করে কনটেইনার চারটি তারপর আখাউড়া-আগরতলা স্থলবন্দর হয়ে প্রবেশ করবে ভারতের ত্রিপুরা ও আসাম রাজ্যে।
এই চুক্তি অনুসারে ভারতকে বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের জন্য অতিরিক্ত কিছু দিতে হবে না। মানে বাংলাদেশের অন্যান্য আমাদানিকারকদের মতোই নির্ধারিত হারে মাশুল দিতে পারবে ভারতীয় আমদানীকারকরা।
শুধু তাই-ই নয়। চুক্তির আর্টিক্যাল-৪ (পোর্ট এন্ড আদার্স ফ্যাসিলিটিজ) অনুসারে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে যে ধরণের সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে পরিবাহিত ইন্ডিয়ার পণ্যের ক্ষেত্রেও একই সুবিধা প্রদান তো করবেই, এ ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ‘প্রায়োরিটি’র ভিত্তিতে ‘স্পেস’ প্রদান করবে!
এই প্রায়োরিটির ভিত্তিতে স্পেস প্রদান করা জিনিসটা কি? চুক্তি অনুযায়ী এর অর্থ হলো, “একই দিনে একটি বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের পণ্য বোঝাই জাহাজ ও ভারতের পণ্য বোঝাই জাহাজ বন্দরে এলে ভারতের পণ্যবাহী জাহাজটিকেই আগে প্রায়োরিটি দিতে হবে।”
এই অদ্ভুত বৈষম্যমূলক শর্তের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে হওয়া একটি চুক্তিকে সবারই সম্মান করা উচিত।’ একই সুর চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র সভাপতি মাহবুবুল আলমের কথাতেও- ‘আপনার বাড়িতে কোন মেহমান এলে নিজে খাওয়ার আগে অবশ্যই মেহমানদের খাওয়ানো উচিত। সে হিসাবে ভারতীয় পণ্য বেশি প্রায়োরিটি পেতে পারে।’ এতে দেশি আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের তেমন কোন সমস্যা হবে না বলেও দাবি করেন তিনি।
তবে এ কথাটি কতটুকু সত্য তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। এ প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক শিল্পের সংগঠন বিজেএমইএর সহ সভাপতি এ এম চৌধুরী সেলিম বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে বন্দরে যেহেতু জাহাজ জট ও কনটেইনার জট নেই সেহেতু আপাতত কোন সমস্যা হবে না। তবে যখন বন্দরের জাহাজ জট শুরু হবে এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতের পণ্য পরিবহন আস্তে আস্তে বাড়বে তখন দেশীয় ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।’
আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে বিজেএমইএর সাবেক প্রথম সহ সভাপতি নাছির উদ্দিন চৌধুরীর বক্তব্যে, ‘আমদানি পণ্য হাতে বুঝে পেতে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের। ঈদ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বাজেটের আগে-পরে চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ জট তীব্র হয়ে পড়ে। তা কাটিয়ে উঠতে কয়েক মাস সময় লাগে। এমন অবস্থায় ভারতীয় পণ্য অগ্রাধিকার পেলে দেশের অর্থনীতিতেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তৈরি পোশাক ক্রেতাদের কাছে জাহাজের গড় অবস্থান ও পণ্য খালাসের দীর্ঘসূত্রতার কারণে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। ভবিষ্যতে তা আরো বাড়বে এবং রপ্তানিতে এর প্রভাব পড়তে পারে।’
আর এই চুক্তির ভবিষ্যৎ প্রভাব যে অজানা- বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন এর সভাপতি আহসানুল হক চৌধুরীর কথাতেই তা স্পষ্ট, ‘আমরা এখনো জানি না বছরে ভারত থেকে কী পরিমান পণ্য এ বন্দর দিয়ে পরিবহন করা হবে। ফলে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। যদি ভারতের পণ্য পরিবহন বাড়ার পাশাপাশি আমাদের বন্দরের অবকাঠামোগত সম্প্রসারণ না হয় তাহলে তা দেশের আমদানি-রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
দুনিয়ার প্রতিটা দেশ কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি করার সময় নিজের স্বার্থটাই আগে দেখে। আমরাই এক ব্যতিক্রমধর্মী অতিথিপরায়ণ দেশ, যারা অতিথি বন্ধুর জন্য নিজের দেশের নাগরিকদের বলি, 'বাবারা, একটু মানিয়ে নাও, বুঝোই তো- অতিথির মনে কষ্ট দেওয়াটা কি ঠিক?'
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন