পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব যে কারণে সম্ভব নয়
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ইমরান খানের শেখ হাসিনাকে ফোন করার খবরে ঈদের আনন্দ শুরু হয়ে গেছে বাংলার আপামর পাকিস্তানী প্রেমীদের ঘরে। তাদের মনে দিল্লির লাড্ডু ফুটছে, যেন ঢাকা আর ইসলামাবাদ মিলিত হয়ে যাচ্ছে আবার!
বাংলাদেশের অজস্র মানুষের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতি অন্যরকম একটা প্রেম আছে, এটা অস্বীকার করার কোন উপায়ই নেই। আদমশুমারি করা হলে সংখ্যাটা লাখের অংক ছাড়িয়ে কোটিতে চলে যাওয়ার কথা। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে এসেও অনেক মানুষ এটা বিশ্বাস করে যে, পাকিস্তানের অধীনেই আমরা ভালো ছিলাম, 'ভারতীয় ষড়যন্ত্রে' পাকিস্তান না ভাঙলে বিশ্বে আমাদের অবস্থানটাই নাকি অন্যরকম হতো! সেই অন্যরকমটা কেমন, সেটা পাকিস্তানের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। আন্তর্জাতিক আঙিনায় একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র, অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর, সেনা শাসনে অতিষ্ঠ এবং জঙ্গীবাদ ও মৌলবাদের অত্যাচারে জর্জরিত একটা রাষ্ট্রের অংশ হওয়ার চেয়ে বাংলাদেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে বাঁচাই যে ভালো- সেটা এদের কখনও বোঝানো যাবে না।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেছেন গতকাল, দুজনের কথা হয়েছে প্রায় পনেরো মিনিট ধরে। আঞ্চলিক রাজনীতির সাম্প্রতিক অস্থিরতাকে হিসেবে ধরলে, এই ফোনালাপ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, ভারত সরকারও শেখ হাসিনা এবং ইমরান খানের এই কথোপকথনকে গুরুত্ব সহকারেই বিবেচনা করছে। কিন্ত সবকিছু ছাপিয়ে ঈদের আনন্দ শুরু হয়ে গেছে বাংলার আপামর পাকিস্তানী প্রেমীদের ঘরে। তাদের মনে দিল্লির লাড্ডু ফুটছে, যেন ঢাকা আর ইসলামাবাদ মিলিত হয়ে যাচ্ছে আবার!
কিন্ত তাদের উৎসাহে জল ঢেলে দিয়েই বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই আকাশ কুসুম কল্পনার পরিসমাপ্তি এখানেই। মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, চব্বিশ বছর ধরে সীমাহীন অত্যাচার আর প্রবঞ্চনার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার কোন সুযোগ নেই, তার ওপর বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের অতীত ও বর্তমান সম্পর্ক, উপমহাদেশের ভূরাজনৈতিক সমীকরণ এবং আরও কয়েকটা সুনির্দিষ্ট কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হওয়া কখনোই সম্ভব নয়।
আঞ্চলিক কূটনীতির দিক থেকে দেখলে, ভারত কখনোই চাইবে না বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের কোন ধরণের বন্ধুত্ব হোক। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের অবস্থান বরাবরই এন্টি পাকিস্তান ঘরানার। বাংলাদেশের অবস্থানও প্রায় একই রকম। উপমহাদেশে নেপাল এবং বাংলাদেশ, এই দুই দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুবই ভালো। নেপাল হাতছাড়া হয়েছে চীনের কাছে, ভারত এখন কোনভাবেই বাংলাদেশকে হারাতে চাইবে না। আর বাংলাদেশেরও ভারতকে ডিঙিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ার কোন সম্ভাবনাই নেই, অন্তত এই সরকারের আমলে তো নয়ই।
আরেকটা জিনিস উল্লেখযোগ্য, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের যথেষ্ট প্রভাব আছে। এমনকি কথায় কথায় প্রতিপক্ষকে ভারতের দালাল গালি দেয়া এদেশের সাবেক এক প্রধানমন্ত্রীও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেখা পাবার জন্যে হোটেল লবিতে বসে ছিলেন অনেকটা সময়। কাজেই এদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রচ্ছন্ন প্রভাবকে অস্বীকার করার কোন উপায়ই নেই। তাছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব করাটা এখনও সচেতন জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশের কাছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের সঙ্গে বেইমানী করার শামিল।
তারচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, একাত্তরের সেই নৃশংস কুকীর্তির জন্য আজও পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি। বরং সময়ে সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের বিরোধিতাই করেছে। এমনকি বাংলাদেশ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে, তখন তারা প্রকাশ্যে সেই বিচারেত বিরোধিতা করেছে, যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের মৃত্যুর পর দেশটির পার্লামেন্টে শোক প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে, পাকিস্তানের জন্য রাজাকারদের যে অবদান, সেটাকে তারা স্বীকার করে গেছে বরাবরই। আর এখন এসেছে বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে- এরচেয়ে বড় হিপোক্রেসি বোধহয় আর হতে পারে না।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বন্ধুত্ব হয় প্রয়োজনের খাতিরে। ভারতের সঙ্গে আমাদের সীমানা আছে, নদীর পানির ভাগাভাগি আছে, আছে সমুদ্রসীমার সংযোগ, আছে বাণিজ্য। কিন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে এসবের কোনোটিই নেই। পাকিস্তানের পেঁয়াজ বা গরুর ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয় না, প্রতি বছর চিকিৎসা বা কেনাকাটার জন্য লাখ লাখ মানুষ পাকিস্তানে যান না, হাজার হাজার বাংলাদেশী ছাত্র সেদেশে পড়াশোনা করে না, তাদের দেশে বেড়ানোর জন্য পাকিস্তান অ্যাম্বাসির সামনে লাইন পড়ে না- সত্যি কথা বলতে, পাকিস্তানকে আসলে আমাদের কোন দরকারই নেই। তাদের ওপর আমাদের কোন নির্ভরশীলতাও নেই, বরং তাদেরই আমাদের সাহায্য দরকার, আর সেকারণেই ইমরান খানের এত তোড়জোড়।
এর আগেও ইমরান খান বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন, পাকিস্তানকে বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করে আমাদের অগ্রযাতার কথা উল্লেখ করেছেন। এমনকি একাত্তরের আগে যে পশ্চিম পাকিস্তানীরা এই অঞ্চলের মানুষের ওপর শোষণ চালিয়েছেন, এমন কথাও তার মুখে শোনা গেছে। এখন তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন দিচ্ছেন, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী করতে চাইছেন, ভালো কথা। কিন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তান যে আচরণটা করেছে, সেসবের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনাটা কি তিনি কখনও করবেন? যে সেনাবাহিনীর মদদে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন, তারা কি তাকে সেটা করতে দেবে? বন্ধুত্ব, আন্তরিকতা, বা ভালো সম্পর্ক- সবকিছুর আগে রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে যে বাংলাদেশের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে, সেটা তাকে কেউ মনে করিয়ে দিলে ভালো হয়...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন