ঘরবন্দী এই দিনগুলোতে অন্তত 'মানুষ' থাকার চেষ্টা করুন, প্লিজ!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
এই কোয়ারেন্টিন পিরিয়ডে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অনেক বাড়বে, তাছাড়া ধারণা করা হচ্ছে- আগামী বছর ডিভোর্স অ্যাপ্লিকেশন প্রায় ডাবল হবে। এইসময় সবচেয়ে বেশি যা হবে তা হলো- সাইকোলজিক্যাল ইনজুরি।
শেষ যেদিন আমি অফিসে যাই, সেদিন আমার ম্যানেজারের সাথে একটা দীর্ঘ মিটিং ছিল। মিটিংয়ের বিষয়বস্তু পুরোটাই করোনা বিষয়ক। গত এক সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়ায় লক্ষ লক্ষ মানুষের চাকরি চলে যায়, শত শত ছোট-বড় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। সবকিছু অনেকটা স্পিলবার্গের সিনেমার মতন হয়ে যাচ্ছে- কেমন যেন সবার চোখে-মুখে চিন্তা, আতঙ্ক, উদ্বেগ।
আমিও সবার মতন চিন্তিত। ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই যাত্রায় আমার চাকরিটা থাকবে তো? ম্যানেজার বলেছিলো, 'শাহিদা, চাকরির চাইতে আমাদের কাজের ক্ষেত্রটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই মহামারিতে, কিংবা এটা শেষ হয়ে যাবার পর আমাদের সবার জন্যই জরুরি প্রশ্নটা হবে- আমি আমার জায়গা থেকে আমার এই দেশের মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারবো তো? সার্ভিস, শাহিদা সার্ভিস! তুমি কী সার্ভিস দিবে আর তোমার দক্ষতাই নির্ধারণ করবে তোমার চাকরির ভবিষ্যৎ।'
এই দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা কথাবার্তা বলেন ভাববাচ্যে, এরা সরাসরি বলবে না চাকরি থাকবে, কি থাকবে না। তারা বুদ্ধি করে আপনাকে নিজেই নিজের ভাগ্য নির্ধারক বানিয়ে ফেলবে। তবে ম্যানেজারের কথাগুলো আমার মনে ধরেছে। সে যদি বলতো চাকরি থাকবে, তবুও আমি জানতাম এটার গ্যারান্টি নেই, আমি পারমানেন্ট সরকারি কর্মজীবী। চাকরি থাকবে স্বাভাবিক, কিন্তু তবুও কোথায় যেন একটা খচ খচ থেকেই যেত। কিন্তু উনি যা বলেছেন, তা আসলে আমার ভেতরের খচখচানি পুরোপুরি দূর করে দিয়েছে। উনি আমার ভেতরে আত্মবিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছে, আমাকে দিয়ে আমাকেই প্রশ্ন করিয়েছে- What's my worth?
এবার আমার লেখার মূল বিষয়ে আসি। আমি অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল কোর্টে কাজ করি। এই কোর্ট পুরো অস্ট্রেলিয়ায় ঘটে যাওয়া বিয়ে, ডিভোর্স, প্রটেকটিভ অর্ডার, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, চাইল্ড কাস্টডি বিষয়গুলো দেখে। আমার ম্যানেজার বলেছিলো, 'শাহিদা, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স এই কোয়ারেন্টিন পিরিয়ডে অনেক বাড়বে, তাছাড়া ধারণা করা হয়- আগামী বছর ডিভোর্স অ্যাপ্লিকেশন প্রায় ডাবল হবে। দুইটা মানুষ সব ফেলে একই ছাদের নিচে, নিজস্ব রুটিনের বাইরে, নতুন রুটিনে দৈনন্দিন জীবনে অভ্যস্ত হতে গিয়ে মারপিট শুরু করবে। এতটা বোধহয় সহজ হবে না দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা সবার একসাথে একই ছাদের নিচে থাকা। এইসময় সবচেয়ে বেশি যা হবে তা হলো- সাইকোলজিক্যাল ইনজুরি। আর আমার কাজের জায়গাটাই হলো মানুষের মনের আঘাতগুলোতে মলম দেয়া।
সিডনিতে যখন ছিলাম, তখন আমি স্টেট্ গভর্নমেন্টের যে ডিপার্মেন্টে কাজ করেছি, সে ডিপার্টমেন্ট নারী শিশুদের নির্যাতন বিষয়গুলো দেখতো। আমি ম্যানেজ করতাম ওয়েস্টার্ন আর সাউথ ওয়েস্ট সিডনির কেসগুলো।
সিডনির এই অংশটা খুব ডায়নামিক। শিশু নির্যাতন, বৌ পেটানো এই অংশে প্রচুর ঘটতো এবং এখনো ঘটে। আমরা সিডনির এই অংশকে বলতাম 'কনটেনশাস এরিয়া', মানে সবচেয়ে সংবেদনশীল এরিয়া। এই এরিয়াতে কোন দেশীয়/ধর্মের মানুষ বেশি থাকে সেটা বলতে চাচ্ছিনা। কিন্তু মানুষ যে কী পরিমান 'অমানুষ', এই ডিপার্টমেন্টে কাজ না করলে আমার অনেকখানি জানা হতো না। খারাপ বাবা মা যে দুনিয়াতে এত আছে, বিশ্বাস করেন, এত আছে- আমি জানতাম না। মাঝে মাঝে ইচ্ছা হতো একটা পিস্তল কিনি, তারপর সেইসব বাবা-মাকে স্রেফ গুলি করে মেরে ফেলি।
ছয় মাসের এক শিশু বাচ্চাকে তার বাবা ঘুষি দিয়ে এক চোখ নষ্ট করে ফেলেছে। বুঝলেন? এক চোখ নাই করে ফেলেছে। নীল চোখের ওই এক চোখওয়ালা শিশু আমাকে যে কতদিন কাঁদাবে আমি আসলে তা জানিনা। সে তার মায়ের সাথে আরেক চোখে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে এসেছিলো, সোশ্যাল সাপোর্ট ইত্যাদি প্রসেসের জন্য। আমি সেই শিশুকে সেদিন দেখেছিলাম। তারপর এক সপ্তাহের নোটিস এবং আরেক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে, ৬ ডিজিটের স্যালারির পার্মানেন্ট সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে, আমার তিনবছর বয়সী মেয়ের পুরো ভরণপোষণ কাঁধে নিয়ে, ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টে কন্ট্রাক্টর হিসেবে জয়েন করি (পরে অবশ্য ওরা আমাকে পার্মানেন্ট করে ফেলে)। আমার এই লেখা আপনাদের কোনোদিন বোঝাতে পারবেনা কী যন্ত্রণা নিয়ে সেই চাকরিটা আমি ছেড়ে এসেছিলাম।
'স্কুল বন্ধ করেন, স্কুল বন্ধ করেন' এই ধরনের বলদামি যেসব অস্ট্রেলিয়ান করেছেন এবং এখনো করেই যাচ্ছেন, তারা জানেন না- এই দেশে হাজারো শিশু আছে, যারা ঘরে নিরাপদ না। এবিউসিভ বাবা-মা'রা তাদের সন্তানদের নিয়ে ঘরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। আমরা যারা সাধারণ বাবা-মা, তারাও কিন্তু বিরক্ত হয়ে পড়ছি এইসময়ে সারাদিন সন্তানকে এন্টারটেইন করতে করতে। আর সেসব বাবা-মার কথা ভাবেন, যারা 'সন্তান' বিষয়টাতেই বিরক্ত।
এইতো বললাম অস্ট্রেলিয়ার কথা, আর বাংলাদেশে কী হচ্ছে, আর কী হবে কে জানে। আমি এমন অনেক পরিবারকে চিনি, যেখানে বৌকে বাচ্চাকে খারাপ গালি দেয়া ডাল ভাতের মতন স্বাভাবিক ঘটনা। কাউকে মানসিক কিংবা শারীরিকভাবে অত্যাচার করা কোনো মানসিক অসুখ না, যে এ থেকে মুক্তির উপায় কীভাবে আমি এখানে লিখে দিবো; তা হলেই হয়ে যাবে। এ সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়ান সরকার ১.১ বিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স আর মানসিক স্বাস্থ্য খাতে। এইদেশে এই মুহূর্তে সব অফিস-আদালত বন্ধ হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। প্রায় বেশিরভাগ সরকারি ডিপার্টমেন্ট এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম অপশনে চলে গেছে। যেসব ডিপার্টমেন্ট খোলা আছে সেগুলো অন্তত উইকেন্ডে বন্ধ থাকে। পুলিশ আর স্বাস্থসেবা বাদে যে আরেকটা ইউনিট দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা খোলা থাকছে এবং এদেশের দুস্থ নারী শিশুদের জন্য কাজ করছে তা হলো 'ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স সার্ভিস'।
এই সময় সন্তানের স্ক্রিন টাইম বরং একটু বেশি হোক, তবুও পেটানো অথবা বাজে গালি দেয়াও কিন্তু শিশু নির্যাতন। এমন অনেক কিশোর-কিশোরীর কথা আমি জানি, যারা ঘরের চাইতে বাইরে, স্কুলে, বন্ধুর বাসায়ই বেশি স্বস্তিবোধ করে। কারণ ঘরে বাবা মায়ের ঝগড়া তাদের দেখতে হয়না, শুনতে হয়না। আজকে এই হোম কোয়ারেন্টিনে তাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। না চাইলেও তাদেরকে বাসায় বসে আপনাদের চিৎকার-চেচামেচি শুনতে হবে। এই সময়টাতে অন্তত আপনাদের এই ঝগড়া করেও 'মহান সংসার' টিকিয়ে রাখার ফিলোসফি একটু সাইডে রাখেন। সন্তানের সামনে তার মাকে কিংবা বাবাকে ছোট করে কোনো কথা বলবেন না। প্লিজ না। আপনি যেমন তার প্রিয়, তার অথর্ব বাবা কিংবা দজ্জাল মাও তার খুব প্রিয়।
এই দুঃসময়ে আমরা সবাই খুব বিরক্ত, মেজাজ-মর্জি ভালো না। ঘরে ফেরার তাগিদ আমাদের আজীবন থাকলেও, এই মুহূর্তে শুধুই ঘরে থাকাটা একটা অভিশাপ লেভেলে চলে গেছে। তাই ভায়োলেন্স, গালিগালাজ, মারপিট যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। কারণ এ থেকে মুক্তির অপশন এই মুহূর্তে বাংলাদেশে খুব বেশি নেই। আপনার এবং আপনার সন্তানের মানসিক শান্তি বজায় রাখুন।
লেখা শেষ করার আগে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলি-
'YOUR ABUSIVE PARTNER DOESN’T HAVE A PROBLEM WITH HIS ANGER; HE HAS A PROBLEM WITH YOUR ANGER.'
মাথা ঠান্ডা রাখুন, প্রয়োজন হলে দুইজন দুই ঘরে থাকুন। নারীদের উদ্দেশ্যে বলছি, আপনাদের ঘরে যেসব পুরুষ আছে এবং যাদের হাত-পা অক্ষত থাকা সত্ত্বেও, আপনাকে ঘরের কাজে সাহায্য করছে না, তাদের এই যাত্রায় ক্ষমা করে দিন। বরং আপনার সন্তান থাকলে, তাদেরকে ভবিষ্যতে এমন অথর্ব না বানানোর প্রতিজ্ঞা করুন। তবুও পার্টনারের উপর জমে থাকা মেজাজ, সন্তানের সাথে গালিগালাজ করে প্রকাশ করবেন না, প্লিজ।
পরিশেষে, আমাদের এই ঘরবন্দি জীবনটা সুন্দর হোক। আনন্দের না হোক, অন্তত স্বস্তির হোক।