আপনার কথা শুনে নিশ্চয়ই কেউ জিমে যাওয়া শুরু করবে না? কিংবা ঐদিন রাতেই বাচ্চা হবার জন্য সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করবে না। তাই এসব 'বাঙালি কার্টেসি' থেকে বের হয়ে আসুন।
আপনি কি জানেন, আমরা কেউই ভুলের উর্ধ্বে না, আমাদের জীবন ১০০% পারফেক্ট না? আপনার নিজের অতি অবশ্যই একটা না একটা শর্টকামিং আছে, যেটা নিয়ে কেউ কথা বললে আপনার ভালো লাগে না। যা আপনার শুনতে ভালো লাগবে না, সেসব ব্যাক্তিগত সেনসিটিভ বিষয় অন্যকে জিজ্ঞেস না করে, বিব্রত না করার নামই হলো 'স্মার্টনেস'।
আমার সম্প্রতি ঢাকা ভ্রমণের একটা উদাহরণ দেই- ঢাকায় যেদিন নেমেছি, সেদিন থেকে শুরু করে যেদিন আমি ঢাকা ছেড়েছি সেদিন পর্যন্ত একটা বাক্য আমাকে প্রতিদিন শুনতে হতো সেটা হলো- হায় হায়! তুমি তো মোটা হয়ে গেছ! আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার দৃঢ় বিশ্বাস, আমি যে মোটা হয়ে গেছি- এই তথ্যটা আমি জানি না। এবং আমার সাথে দেখা হবার পর, এই তথ্যটি আমাকে জানানো তাদের খুব-খুব প্রয়োজন। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, দেশে আমার দেখা প্রায় প্রতিটা মানুষ কারো সাথে দেখা হলে, আজকাল আর কুশলাদি বিনিময় করে না। তারা যা বিনিময় করে তা হলো, আপনাকে নিয়ে তাদের সুগভীর মতামত এবং জাজমেন্টাল কমেন্ট। ধরেন, আমি যদি এখন আমার কোনো পোস্টে লিখি 'বা**', তাহলে আমার ফলোয়ার এবং বন্ধু লিস্টের প্রায় অর্ধেক মানুষ খুব অফেন্ডেড ফিল করবে, আমার ভাষাচর্চা নিয়ে আমাকে ইনবক্স করবে- আপা শব্দটা চোখে পড়ছে, পোস্ট থেকে সরিয়ে নিন। কিন্তু আমি যদি কাউকে ইনবক্স করি কিংবা ছবিতে কমেন্ট করি- 'মাগো মা, এত ছবি তুলার টাইম পাও কই? বা তুমি আগের থেকে মোটা হয়ে গেছ, থাইরয়েড নাকি কিংবা জামাইর সাথে এত ঘুরো, বাচ্চা-কাচ্চা কবে নিবা?' এসব কথায় কেউ অফেন্ডেড ফিল করবে না, যদি করেও থাকে, তারা কেউ বলতে পারবেনা আমি অফেন্ডেড। কারণ আমাদের সমাজে এগুলো অফেন্ডেড হবার বিষয়-ই না। এগুলো খুব জরুরি প্রশ্ন।
আসলে এগুলো হলো 'বাংলা কেয়ারইং' বা 'আলগা পিরিত'- যেই পিরিতের কোনো যুক্তি নেই। শুধু যে যুক্তি নেই তা নয়, এই ধরণের পিরিত কিছুতেই অপর পক্ষকে কমফোর্ট দেয়না, সাপোর্ট দেয়না। যা দেয় তা হলো অস্বস্তি। আপনার কথা শুনে নিশ্চয়ই কেউ জিমে যাওয়া শুরু করবে না? কিংবা ঐদিন রাতেই বাচ্চা হবার জন্য সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করবে না। তাই এসব 'বাঙালি কার্টেসি' থেকে বের হয়ে আসুন। এগুলো কোনো ভদ্রতা বা কনভার্সেশন স্টার্টার না।
বাঙালি সমাজকে এসব থেকে বের করার প্রথম এবং প্রধান উপায় কী জানেন? আপনি নিজে এগুলো বলা বন্ধ করুন। কারও সাথে দেখা হলে সালাম দিন, চুমা দিন, হাগ্ দিন, কেমন আছেন জিজ্ঞেস করুন। 'চুমা দিন, হাগ দিন' এগুলো দেখে ভ্রু বাঁকা হয়ে গেছে? বাঙালি কালচার নিয়ে টানাটানি করে ফেললাম? সম্পর্ক ভেদে এসব করাই যায়, তবে দুদিনের ফেসবুকের পরিচয়ে ইনবক্সে চুম্মা-চাট্টি করতে যাবেন না, সেগুলো আবার ছাগলামি। কারও সাথে দেখা হলে 'কেমন আছেন, শরীর কেমন, চাকরি-বাকরি কেমন যায়' ইত্যাদি হলো কুশলাদি। 'বেবি কবে নিবা? চাকরি হয়েছে নাকি? ডিভোর্স কীভাবে হলো? পড়ালেখার কতদূর? বিয়ে হয়না কেন? মোটা হয়েছ কীভাবে? শুকিয়েছ কেন?' এগুলো কোনো কুশল বিনিময় না।
তাই কারও সাথে দেখা হলে- প্লিজ, প্লিজ এসব প্রসঙ্গে কথা বলা থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। বিশ্বাস করুন, দুনিয়াতে কয়েক'শ কোটি টপিক আছে কথা বলার জন্য। অন্যের চোখের নিচে কেন কালি পড়লো সেটা আপনার জানা যেমন জরুরি না, তেমনি আপনি দুপুরে কী দিয়ে ভাত খেয়েছেন সেটাও অপরকে জানানো খুব গুরুত্বপূর্ণ না! আপনি যেদিন থেকে এসব বলা বন্ধ করবেন, সেদিন থেকে আপনার সাথেও এসব বলা বন্ধ হবে।
পরিশেষে, আমার লেখার খোরাকই হলো 'মানসিক স্বাস্থ্য'। যেই জাতির কুশলাদি শুরু হয় অন্যকে মানসিকভাবে আঘাত করার মাধ্যমে, তাদের আসলে প্রথমে 'কেমন আছ' কীভাবে বলতে হয়, এইটা জানানো খুব জরুরি।
Be smart with your conversation. Focus on the relationship, not on the information exchange!
ফিচার্ড ছবি- লেখক