বিয়ার গ্রিলস, যিনি সব বিরুদ্ধতা জয় করতে পারেন, যিনি যেকোনো চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত, ডিসকভারিতে যার তেলেসমাতি দেখে মানুষের মুখ হা হয়ে যায়, তিনিও ভয় পান! জ্বি, ঠিকই পড়েছেন। তিনিও ভয়-টয় পান!
- নাম কি?
- আজ্ঞে, বিয়ার গ্রিলস।
- করো কি?
- এডভেঞ্চার করে বেড়াই।
- তাই নাকি! পাহাড় পর্বতে উঠতে পারো?
- জি এটা তো হাতের মোয়া।
- কুমিরের সাথে যুদ্ধ করতে পারবা?
- কি বলেন, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। কুমির তো ছাই মশাই! বাঘে মহিষে আর বিয়ার গ্রিলসে এক ঘাটে জল খায়।
- ওরেব্বাহ! ঘন জঙ্গল ফংগলে একলা বিষাক্ত জীবজন্তুর সাথে থাকতে পারবা?
- আন্ডারএস্টিমেইট করলেন নাকি! ফরেস্ট ইজ মাই হোম...
- তুমি তো একটা জিনিস। চলো তোমারে নিয়ে এক জায়গায় যাই। কই যেতে হবে বলেন জাস্ট।
- ককটেল পার্টিতে। (এক ধরণের গেট টুগেদার, যেখানে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষেরা বিভিন্ন উপাদান মেশানো পানীয় পান করে থাকে।)
- ইয়ে মানে পার্টি? আমার তো একটু কাজ আছে, বউ মাত্র ফোন দিলো। বাচ্চাটা প্রজাপতির ডিম বাজি খাবে। ওটা ম্যানেজের দায়িত্ব আবার আমার উপর। বুঝেনই তো...
কথাবার্তা কাল্পনিক, তবে ভয়টা অলৌকিক নয়। বিয়ার গ্রিলস যিনি সব বিরুদ্ধতা জয় করতে পারেন, যিনি যেকোনো চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত, ডিসকভারিতে যার তেলেসমাতি দেখে মানুষের মুখ হা হয়ে যায়, তিনিও ভয় পান! জ্বি, ঠিকই পড়েছেন। তিনিও ভয়-টয় পান! তিনি নিজেই বলেন,
'মানুষের আসলে ভয় পাওয়া উচিৎ নয়, কিন্তু সত্য যে আমি নিজেই অনেক কিছুতেই ভয় পাই। যেমন ককটেল পার্টিগুলো আমার পছন্দ নয়, যেখানে অনেক মানুষ থাকে যাদের আমি একেবারেই চিনি না। এমন জায়গা যেতে আমার অস্বস্তি হয় খুব।'
একটি আন্তজার্তিক কনফারেন্সে বিয়ার গ্রিলস বলেন তার আত্মবিশ্বাসজনিত ঘাটতির কথা। একজন তরুণ হিশেবে তিনিও মাঝে মধ্যে কনফিডেন্সহীনতায় ভুগেন! বুঝেন তাহলে অবস্থা। কিছু কিছু সমস্যা বোধহয় সবারই থাকে জীবনের কোনো না কোনো স্টেজে। যারা সেটাকে সবচেয়ে ভালোভাবে সামলে নিতে পারে তারাই টিকে যায় জীবনে। যেমন, ভয়কে জয়ের উপায় বাতলে দিয়েছেন বিয়ার গ্রিলস নিজে। তিনি বলেন,
“তুমি তখনই ভয়কে জয় করতে পারবে, যখন তুমি যে ব্যাপারটিকে ভয় পাচ্ছো সেটির মুখোমুখি হবে। আসলেই তাই, ভয় থেকে পালানোর উপায় একটাই, তার কাছে যাওয়া। কারণ একমাত্র ওই সময়টাই তুমি ভয়টাকে দেখবে না,কারণ তুমি সেটিকে অলরেডি দেখছো! এই কঠিন ব্যাপারটি আমি অনেক কষ্টে শিখেছি, এখন ভয়গুলোকে এভাবেই ফেস করি আমি।”
গ্রিলস জানান উড়োজাহাজ থেকে লাফ দেয়ার সময়ও তার ভীষণ নার্ভাসনেস কাজ করে। কথাটি যে সত্য তার প্রমাণ মেলে ২০ বছর বয়সে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনায়। জাম্বিয়ায় একটি বিমান থেকে প্যারাশ্যুট থেকে লাফ দিতে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন গ্রিলস। এক্সিডেন্টটা এতটাই মারাত্মক ছিলো যে মেরুদণ্ডের তিনটি হাড় ভেঙ্গে যায় তার। এমনকি চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করে নেওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়। তিনি এটিকে জীবনের সেকেন্ড চান্স হিশেবে অভিহিত করেন। তার কথা হচ্ছে,
“নিজেকে খুব ভাগ্যবান বলতেই হয়। আমি হয়তো মারাই যেতাম কিংবা প্যারালাইজ হয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু তা হয়নি, নিশ্চয়ই জীবন আমাকে যে দ্বিতীয় সুযোগটি দিলো এর পেছনে অবশ্যই কোনো উদ্দেশ্য আছে...!”
বিয়ার গ্রিলস তবু পাল্টাননি,
“আমি ভয় পেয়েছিলাম, কিছুটা আশাহত হয়েছিলাম। কিন্তু তাতে কী! আমি আমার আগের কাজেই ফিরে গিয়েছি, কারণ জীবনটা এমনি এমনি দেয়া হয়নি, এটি কাজে লাগাতে আমি সবসময়ই ভিন্ন কিছু করতে চেয়েছি প্রাণপণে। জীবনে এমন খারাপ অবস্থা কখনো কখনো আসা উচিৎ, এতে আমরা বুঝতে পারি জীবনের গুরুত্ব কতটুকু।”
বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতিতে কীভাবে সারভাইব করতে হয়, বেঁচে থাকতে হয় এই বিষয়ে শো করেই গ্রিলস সবচেয়ে বেশি খ্যাতি পান। প্রতিকূল পরিস্থিতি কিভাবে জয় করতে হয় সেটি তার চেয়ে ভালো আর কে জানে! কিন্তু তার নিজের যে জিনিসটি জয় করতে হয়েছিলো সেটি হলো “কনফিডেন্স”। বিয়ার গ্রিলস স্কুলে খুব একটা ভালো ছাত্র হিসেবে বিবেচিত হতেন না। ওই জায়গাটিতে আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে তাঁকে খুব স্ট্রাগল করতে হয়েছে। কিন্তু অল্প বয়সের স্ট্রাগলই তাঁর কাছে আপেক্ষিকভাবে ভালো মনে হয়েছে।
সাফল্য খুব সহজে পেয়ে গেলে সেটার প্রভাব যে খুব বেশি সময় থাকে না! সবচেয়ে কম বয়সে এভারেস্ট বিজয়ীদের মধ্যে বিয়ার গ্রিলস অন্যতম। তিনি এভারেস্টে চড়ার সময় অনেক মৃতদেহ দেখতে পান। এসব দেখে কিছুটা ভয় আসে, নিজের উপর কিছুটা সন্দেহ হয়, পারবেন তো শেষ পর্যন্ত? তিনি পেরেছিলেন। আর নিয়ে এসেছিলেন কিছু বরফ, যাকে তিনি বললেন সেলফ-ডাউট জয় করার প্রতীক।
তবে এখনকার তরুণদের নিয়ে কিছুটা চিন্তা হয় কারণ, কারণ তারা টিভি স্ক্রিনের সামনে, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর সময় দিচ্ছে। তাই গ্রিলস বললেন, “তরুণদের বাইরের জগতটা দেখা দরকার। কৌতূহল আর এডভেঞ্চারের স্পিরিট তৈরি করার জন্য জীবনে কিছু ঝুঁকি নেয়ার অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন।” বিয়ার গ্রিলস লাজুক এবং আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগতে থাকা তরুণদের বেশি অভয় দিতে চান। তাই সবার উদ্দেশ্যে তাঁর ম্যাসেজ,
'জীবনের পুরস্কার সবসময় সবচেয়ে বিশালদেহী, সাহসী, চতুর কিংবা সবচেয়ে সেরা মানুষরা পাবে, এটা একেবারেই ভুল ধারণা। কখনো কখনো যারা খুব জেদি, প্রত্যয়ী, অনড় এবং ধাক্কা খাওয়ার পরও নিজের পায়ে ঘুরে দাঁড়ায়, তাদেরই জীবন সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ পুরস্কার হয়ে আসে। তাই কারোরই ঝুঁকি না নিয়ে দমে থাকা উচিৎ নয় এবং হতাশ থাকা উচিৎ নয়।'
(বিবিসি অবলম্বনে)