বেগম রোকেয়াই প্রথম এই অঞ্চলের নারীদেরকে মুক্তির আহবান জানিয়েছিলেন, মাথা উঁচু করে, মেরুদণ্ড সোজা করে বাঁচার শিক্ষা দিয়েছেন। প্রতিটা পদে পদে নারীর বিরোধিতা করা, নারীকে তেঁতুল হিসেবে গণ্য করা লোকজন তাই বেগম রোকেয়াকে নিয়ে নোংরা মন্তব্য করতেই পারে...
নারী জাগরণের অগ্রদূত- এই নামেই জেনে এসেছি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে। পাঠ্যবইয়ে তার জীবনী পড়েছি, তার লেখা প্রবন্ধ ছিল বাংলা বইয়ের পাঠ্যসূচীতে। তবে এদেশের অজস্র লোকের চোখে যে তিনি ভীষণ অজনপ্রিয় একজন মানুষ, তার প্রতি যে অনেকে মনের ভেতর তীব্র ঘৃণা লালন করে- সেটা আজই জানতে পারলাম।
মহীয়সী এই নারীর জন্ম এবং মৃত্যু একই তারিখে, ৯ই ডিসেম্বর। একারনে দিনটিকে বেগম রোকেয়া দিবস হিসেবে পালন করা হয় অনেক আগে থেকে। এই দিবস নিয়ে যেখানে যত খবর প্রকাশিত হয়েছে, সেসব পত্র-পত্রিকার ফেসবুক পেইজে সংবাদের নিচে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের মেলা বসেছে যেন। ২০২০ সালে এসে বেগম রোকেয়ার মতো একজনকে খেতাব দেয়া হচ্ছে ইসলামের শত্রু, জাহান্নামী, নারীদের ধ্বংসের কারিগর হিসেবে। এবং এই খেতাবদাতাদের প্রায় সবাই পুরুষ, যারা নিজেদের সর্বেসর্বা মনে করে, প্রভু ভাবে, যাদের কাছে নারীরা সেবাদাসী এবং বিনোদনের বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়।
আজ থেকে একশো বছরেরও বেশি সময় আগে মেয়েদের শিক্ষার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বেগম রোকেয়া, সমাজের নানা স্তর থেকে তাকে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্ত তখনও কেউ তাকে 'ইসলামবিরোধী' বা 'জাহান্নামী' হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন বলে জানা নেই। ঘড়ির কাঁটায় একশো বছর পেরিয়ে যাওয়া মানে একটা জাতির মানসিকতার দিক দিয়ে কয়েকগুণ এগিয়ে যাওয়া। অথচ বেগম রোকেয়াকে নিয়ে করা এসব মন্তব্য দেখে মনে হচ্ছে, এগিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, এদেশের অজস্র মানুষ পেছাতে পেছাতে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে ফিরে গেছে।
বেগম রোকেয়া ছিলেন যুগের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা একজন মানুষ। তিনি যে সময়ে জন্মেছেন, বড় হয়েছেন, তখন মুসলিম নারীদের দুনিয়া ছিল চার দেয়ালের ভেতরে। ঘরের বাইরে বের হওয়াটা ছিল বারণ। জন্ম, বিয়ে, স্বামীর সেবা, সন্তানের দেখভাল আর সংসারধর্ম পালন করতে করতে একদিন মরে যাওয়া- এই ছিল তখনকার নারীদের জীবনচক্র। বেগম রোকেয়া সেই জীবনচক্র ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন, আরও শত শত নারীকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন সেই শৃঙ্খল ভাংতে। বাংলাদেশের নারীসমাজ আজ যে অবস্থানে এসেছে, সেটার পেছনে বেগম রোকেয়ার অবদান তো অনস্বীকার্য। বাঙালি পুরুষের আঁতে ঘা লাগার জন্যে এটুকুই তো যথেষ্ট।
স্বামীর মৃত্যুর পরে বেগম রোকেয়া স্বামীর নামেই সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন মেয়েদের জন্য। অন্তপুরে পড়ে থাকা নারীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন শিক্ষার আলো। নারীর উন্নয়ন, নারীর অগ্রগতি, নারীর পশ্চাৎপদ মানসিকতা, সমাজের বিধিনিষেধ- সবকিছু নিয়ে তিনি লিখেছেন ক্রমাগত, তার কলম কখনও পুরুষকে বিদ্ধ করেনি, করেছে পুরুষের বানানো অপ্রাসঙ্গিক নিয়ম-নীতি আর ভ্রান্ত সমাজব্যবস্থাকে। নিজের কলমে তিনি বিদ্ধ করেছেন নারীকেও, কারন অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন, নারীর পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারন নারী নিজেও।
মশাল হাতে একাকী তিনি হেঁটেছেন বন্ধুর পথে, হাজারো বাক্যবাণে বিদ্ধ হয়ে একটা নতুন রাস্তা তিনি তৈরি করে দিয়েছেন পরবর্তী সময়ের নারীদের জন্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর যে সময়টাতে তিনি নারীদের শিক্ষা এবং মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন, আজকের এই একবিংশ শতকেও আমরা সেই সাহস দেখাতে পারছি না অনেকক্ষেত্রে। বেগম রোকেয়া নিজে শিক্ষিত হয়েছেন এবং সমাজের অন্যান্য নারীর জন্য শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে লড়াই করে গেছেন। বেগম রোকেয়া চেয়েছিলেন প্রতিটি নারীর মধ্যে বোঝার এবং অনুধাবন করার শক্তি তৈরি হোক, নিজের জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নারী নিজে নিক। নারী নিজে স্বাবলম্বী হবে, নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার নিজের হাতে রাখবে- দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা ইনসিকিওরিটিতে ভোগা বাঙালি পুরুষদের একটা অংশ এটা কী করে মেনে নেয়? অতএব দাও গালি বেগম রোকেয়াকে, এই নারীই যত নষ্টের গোড়া!
সেই যুগে বসে তিনি নারীদের সংগঠিত করার চিন্তা করেছিলেন, মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন "আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম" প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নারীর ভোটাধিকারের জন্য তিনি আন্দোলন করেছেন। নারীরও যে সমাজ, কর্মক্ষেত্র ও রাজনীতিতে অবদান রাখার সুযোগ আছে, সেটা বাঙালীদের মধ্যে প্রথম অনুধাবন করেছিলেন বেগম রোকেয়াই। আজ যে নারীর ক্ষমতায়নের কথা গর্ব করে বলি আমরা, নারী প্রধানমন্ত্রী, নারী বিরোধীদলীয় নেত্রী, নারী স্পিকার- সেটার বীজ তো বেগম রোকেয়াই বুনে দিয়েছিলেন শতবর্ষ আগে। 'নারী নেতৃত্ব মানি' বলে ঘোষণা দেয়া পুরুষ সমাজ যে বেগম রোকেয়াকে সেজন্য গালিগালাজ করবে, তাতে অবাক হবার কি আছে?
বেগম রোকেয়া মাত্র ৫৩ বছর বেঁচে ছিলেন। ওই সময়ের মধ্যেই তিনি যে কীর্তিগাঁথা রচনা করেছেন, সেটা অবিশ্বাস্য। ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল, তেইশে বিধবা হলেন, তবু তিনি থেমে থাকেননি, বরং দ্বিগুণ তেজে জ্বলে উঠেছেন। তিনি লিখেছেন মতিচুর, সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, নিজের লেখা, নিজের কর্মের মাধ্যমে তিনি নারীকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন, নারীকে আত্মনির্ভরশীল, মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে বাঁচার শিক্ষা দিয়েছেন। নারীকে পণ্য হিসেবে ভাবা, দাসী হিসেবে গ্রাহ্য করা পুরুষেরা বেগম রোকেয়ার ওপর এতে রুষ্ট হতেই পারেন, অবাক হবার কিছু নেই।
কারা বেগম রোকেয়াকে পছন্দ করে না? কারা তাকে নিয়ে কটু মন্তব্য করে? কারা তাকে 'জাহান্নামী' বানিয়ে দেয়? তারাই, যারা নারীকে ঘরের ভেতর বন্দী করে রাখতে চায়। যারা নারীকে ক্লাস ফাইভের পরে আর পড়াশোনা না করানোর ফতোয়া দেয়। যাদের কাছে নারী হচ্ছে তেঁতুলের মতো বস্তু, দেখলেই লালা ঝরে। বেগম রোকেয়া তাদের কাছে শত্রুসম, যারা কর্মক্ষেত্রে নারীর অবস্থানকে মেনে নিতে পারে না। যারা এই ২০২০ সালে এসেও মধ্যযুগীয় চিন্তাচেতনা লালন করে, মারীর গায়ে হাত তোলাটাকে অধিকার মনে করে, তারা বেগম রোকেয়াকে ভয় পাবেই, ভয় পেতে তারা বাধ্য। তারা বেগম রোকেয়াকে ইসলামের শত্রু বানিয়ে দেয়, অথচ বেগম রোকেয়া কোনোদিন না ধর্মের বিরোধিতা করেছেন, না করেছেন পুরুষের বিরোধিতা। তিনি বিরোধিতা করেছেন নারীর পিছিয়ে পড়া মানসিকতার, তিনি সমালোচনা করেছেন সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার আর একপাক্ষিক নীতি-নিয়মের।
আজ এদেশের নারীরা প্রতিটা সেক্টরে ছড়িয়ে গেছে। কি চিকিৎসা, কি ব্যবসা, কি সাংবাদিকতা, কি অভিনয়, কি রাজনীতি- সব জায়গায় নারীর জয়জয়কার। নারীর এগিয়ে চলার প্রতিটা গল্পের পেছনে অদৃশ্যভাবে বেগম রোকেয়ার নামটা লেখা থাকে, লেখা থাকবে। তিনিই তো প্রথম এই অঞ্চলের নারীদেরকে মুক্তির আহবান জানিয়েছিলেন, মাথা উঁচু করে, মেরুদণ্ড সোজা করে বাঁচার শিক্ষা দিয়েছেন। প্রতিটা পদে পদে নারীর বিরোধিতা করা, নারীর অগ্রযাত্রা মেনে নিতে না পারা লোকজন তাই বেগম রোকেয়াকে নিয়ে নোংরা মন্তব্য করতেই পারে। তাতে বেগম রোকেয়ার অবদান ম্লান হবে না একটুও।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন