আমরা রাসেলকে চিনি, যে তার অফিসের কারও সাথেই তেমন কথা বলে না। রাসেলের মনে হয় তার কথা বলা উচিত। কিন্তু সে ‘কেমন আছেন, ফয়সাল ভাই?’ বাদে দ্বিতীয় প্রশ্নটি খুঁজে পায় না।

আড়িয়াল খাঁ: প্রতিদিন আমরা অনেক মানুষের সাথে মিশি। তাদের সাথে প্রয়োজনীয় কথা বলি কিংবা নিছক আড্ডা দেই। তারপর হয়ত আমরা বিচার করি মানুষটাকে। মনে মনে কিংবা আরেকজনের সামনে। আমরা বিচার করি মানুষটা ভাল কি খারাপ। একদম অপরিচিত মানুষটা যদি হেসেহেসে কথা বলে আমাদের মন ভাল করে দেয় তাকে আমরা পছন্দ করি। কেউ কেউ আছে এমন গুমোট মেরে থাকে ভ্যাপসা আকাশের মতো। আমরা তাকে পছন্দ করি না। কারণ সে তেমন মিশুক না। গুটিয়ে রাখে নিজেকে। এমন মানুষকে আমরা কেউ স্বাভাবিক ভাবি না। কারণ স্বাভাবিকতা হল সামাজিকভাবে অন্যান্য মানুষ কিংবা গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত থাকা। 

আমরা তাই গুটিয়ে রাখা মানুষদের খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে বলি। কিছু মানুষকে আমরা চিনি যারা সবার সামনে মঞ্চে উঠতে হবে এই ভয়ে সামাজিক অনুষ্ঠানের মোক্ষম সময় একদম হাওয়া হয়ে যায়। আমরা অনিতাকে চিনি, যে একটা ওয়ার্কশপ করছে আরও অনেক মানুষের সাথে। তিনদিন হয়ে গেল, অনেকে অনেকের নাম ধরে ডাকছে কিন্তু সে এখনও সবার সাথে কথাই বলতে পারেনি ঠিকঠাক। আমরা হয়ত আরও একজনকে চিনি, যে চিৎকার করে বাস থামাতে সংকোচ বোধ করে আর তার স্টপের একটু আগেই নেমে যায় আরেকজন থামাতে বললে। বাকি পথটুকু সে হেঁটে হেঁটে যায়। 

আমরা রাসেলকে চিনি, যে তার অফিসের কারও সাথেই তেমন কথা বলে না। কিন্তু কাউকে অপছন্দ করে অথবা রেগে আছে এমনও না। রাসেলের মনে হয় তার কথা বলা উচিত। কিন্তু সে ‘কেমন আছেন, ফয়সাল ভাই?’ বাদে দ্বিতীয় প্রশ্নটি খুঁজে পায় না। তূর্যের কথা বলা যাক। তার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা হল চায়ের দোকানের আড্ডা। কিন্তু সেখানে পুরো বিকেল সন্ধ্যা কেটে গেলেও সে কয়টি কথা বলেছে? হ্যাঁ, হেসেছে অবশ্য অন্যদের কথায়। কিছু কিছু তর্কের জায়গায় চেয়েছে একটা যুক্তি দেখাতে। কিন্তু কেন যেন সে বলতে পারল না। সে পারেওনি কোনোদিন। 

ক্লাসে শিক্ষক জিজ্ঞেস করেন, কে কে পারবে প্রশ্নটার উত্তর? রাকা পারে। কিন্তু দাঁড়িয়ে উত্তরটা দেয়না কখনও। সবাই তার দিকে তাকিয়ে থাকবে, ক্লাসের একষট্টিটা মস্তিষ্ক-একশ বাইশটা চোখ তার দিকে থাকবে এই ব্যাপার সে সহ্য করতে পারবে না।

সরলীকরণ করে এইসমস্ত মানুষকে আমরা ‘ইন্ট্রোভার্ট’ বলি। কেউ কেউ আমরা বলি যে তারা কম কম মিশতে পারে কিংবা আগেও কম মিশেছে। অভ্যাসটা গড়ে ওঠেনি। ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে। আবার কেউ কেউ বলি এটা আসলে ‘লজ্জা’। মানুষের সামনে নিজেকে এবং নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে সে লজ্জাবোধ করে। এটা কাটিয়ে ওঠাই ভাল আমরা ভাবি। বাবা-মায়েরা কিংবা মুরুব্বিরা বলেন ‘ছেলে আমার মুখচোরা’।

মানুষের ব্যক্তিত্বের ধরন সরলীকরণের এই ধারা সাধারণত প্রচলিত সামাজিক নিয়মে হয়। যেহেতু প্রতিষ্ঠিত সমাজেও অনেক ভুল বিশ্বাস এবং প্রথা থেকে যায়, তাই মাঝেমাঝে আমরা ভুল বিশ্বাস আর ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠি। আমাদের মাঝে যারা কম কম মিশতে পারি তারা ভেবে বসি এটা আমাদের দূর্বলতা। আগামীদিন থেকে আরও বেশি সামাজিক হতে হবে। কিন্তু আগামীদিন কেন আগামী বছরেও আমরা পারি না। আমরা মানসিক কষ্টে ভুগি। আমরা ভাবি যারা জনপ্রিয়, আড্ডায়-পরিবারে-ক্লাসে-অফিসে, তাদের মতো হওয়াই স্বাভাবিক। আমরা প্রতিদিন পারি না এবং প্রতিদিন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকি।

ইন্ট্রোভার্ট কী সেটা সংজ্ঞায় বোঝার কোনও দরকার নেই। শামুক যখন পুরোটা খোলসের ভেতরে থাকে সেটা ইন্ট্রোভার্সন। আর যখন একদম বাইরে চলে আসে সেটা এক্সট্রোভার্সন। শব্দ দুটি একশ বছর আগে সর্বপ্রথম টেনে আনে দার্শনিক কার্ল জুং। ভদ্রলোক বললেন, একদম খোলসের ভেতরে কেউ থাকতে পারে না। তাকে কিছু না কিছু মানুষের সাথে মিশতেই হয়। তাই একেবারে ‘এবসোলিউট ইন্ট্রোভার্ট’ কেউ নেই। আবার অপরদিকে পুরোপুরি এক্সট্রোভার্টও কেউ থাকতে পারে না। কার্ল জুং একটা মডেল তৈরী করে দেখান কোন ‘টাইপ’ মানুষের মস্তিষ্কের জন্য কোন ধরনের ‘এনার্জি’ প্রয়োজন। তিনি দেখালেন যারা বহির্মুখী অর্থাৎ এক্সট্রোভার্ট তাদের শক্তির উৎস হল সামাজিক যোগাযোগ, পরিবার-বন্ধু-আড্ডা-অফিস-পার্টি-অন্যান্য। 

ইন্ট্রোভার্ট আর এক্সট্রোভার্ট মানুষের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ বিপরীত 

আবার তিনি বললেন ইন্ট্রোভার্ট মানুষ ঠিক উলটো। এমন সামাজিক যোগাযোগ তাদের শক্তি ক্ষয় করে। সুতরাং এর বদৌলতে তাদের কিছু একা সময় দরকার হয় যাতে তারা পুনরায় মানসিকশক্তি অর্জন করে ‘ফ্রেশ’ অনুভব করতে পারে। এক্সট্রোভার্ট আর ইন্ট্রোভার্ট মানুষ একটি গ্রাফলাইনের দুই বিপরীত দিকে অবস্থান করে। প্লাস ওয়ান আর মাইনাস ওয়ানের ভেতর। প্লাসের দিকে এক্সট্রোভার্ট আর মাইনাসের দিকে ইনট্রোভার্ট। আমরা ভুলভাবে চিন্তা করে প্লাসকে পজেটিভ হিসেবে ধরে নেই। এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যারা ইন্ট্রোভার্ট তাদেরও তাড়া করে। তারাও মাইনাস থেকে প্লাসের দিকে যেতে চায়। কারণ প্লাসের দিকে লোকেরা স্বাভাবিক। সবাই তাদের পছন্দ করে। অস্বাভাবিক হয়ে কে থাকতে চায় একটা সভ্য সমাজে? 

১৯৯৯ সালে এই দুই ধরনের মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে একটা বৈজ্ঞানিক যজ্ঞ চালানো হল। তাদের মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল পরীক্ষা করা হল। ইন্ট্রোভার্টদের মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব এবং এন্টিরিয়র থ্যালামাস অংশে বেশি দেখা গেল রক্ত চলাচল। যে অংশ পরিকল্পনা, সমস্যা-সমাধান, অতীত স্মৃতিচারণ এইসব নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর এক্সট্রোভার্টদের ক্ষেত্রে দেখা বেশি রক্ত চলাচল দেখা গেল পোস্টেরিয়াস থ্যালামাস-টেম্পোরাল লোবস্‌ এইসব অংশে। পরিবেশ থেকে ডাটা সংগ্রহ করে তাৎক্ষণিক ‘এনালাইসিস’ করে যেসব অংশ। 

সুতরাং স্বচ্ছ যৌক্তিক মন নিয়ে ভাবলে আমরা দেখি পুরো ব্যাপারটাই মস্তিষ্কের কার্যক্রমের ভিন্নতা মাত্র। ভিন্ন ভিন্ন অংশের সক্ষমতার উপর কেউ ইন্ট্রোভার্ট, কেউ এক্সট্রোভার্ট। যে বিজ্ঞানের ছাত্র, সফল এবং সন্তুষ্ট হবার জন্য বিজ্ঞান পড়াই তো তার জন্য যুক্তিযুক্ত হবে। বাজারে ব্যবসায় শিক্ষার পসার ভাল দেখে সে কি বিজ্ঞান ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় শিক্ষা পড়বে? তাহলে তো সে নিজের অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাবে। ঠিক সেরকম একজন ইন্ট্রোভার্ট মানুষ যে, তার ব্যক্তিত্বই হচ্ছে অন্তর্মুখীতা। মানুষ ভাল বলবে এই আশায় এক্সট্রোভার্ট হবার চিন্তাভাবনা নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে সন্দিগ্ধ হওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। এইরকম চিন্তাধারা হতাশা আর উদ্বেগ নিয়ে আসবে কেবল। 

ইন্ট্রোভার্ট মানুষের বৈশিষ্ট্য কেমন হয়? 

আপনি লিফটে আরেকজনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। খুব পরিচিত মানুষ আপনার। তাকে আপনি অনেক প্রশ্ন করছেন। সে উত্তরও করছে ছোট ছোট শব্দে। কিন্তু নিজে থেকে প্রশ্ন করছে না। আপনি ধরে নিতে পারেন মানুষটা ‘মুডি’। খুব সম্ভবত মানুষটা ইন্ট্রোভার্ট। গেট-টুগেদারে কিংবা কোন পার্টিতে অনেকেই যায় সামাজিকতা রক্ষা করতে। না গেলে তাকে নিয়ে অনেক কথা হবে সেটা আরেক বিড়ম্বনার বিষয় হবে। তারচে’ বরং সেখানে গিয়ে সে ঘরের কোণে সময়টা পার করে দেওয়া নিরাপদ। নতুন কারও সাথে পরিচিত হওয়া, নিজের পরিচয় অন্যের কাছে প্রথমে গিয়ে প্রকাশ করা এইসব তার উদ্দেশ্য না। কারণ সে ইন্ট্রোভার্ট। লোকটা হতে পারে চমৎকার আর্টিস্ট, কিংবা অভিনেতা, কিংবা অফিসের বড় কর্তা। মজার ব্যাপার হল সে হতে পারে একজন ‘পাবলিক স্পিকার’। কয়েকশ মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে সে কথা বলতে পারে, কিংবা তাদের দিকনির্দেশনা দিতে পারে। কিন্তু একজনের সামনে, কয়েকজনের সামনে সে হয়ে যায় অপ্রস্তুত। এমন ইন্ট্রোভার্ট মানুষের অভাব নেই আশেপাশে। 

আপনি যদি ইন্ট্রোভার্ট হন আপনার জন্য কোনও অনুপ্রেরণা কিংবা ‘মোটিভেশনে’র প্রয়োজন নেই। কারণ আপনার ব্যক্তিত্ব-ই অন্তর্মুখীতা। এটা কোনো অস্বাভাবিকতা নয়। আপনার প্রয়োজন নেই জানা যে ইন্ট্রোভার্ট মানুষও সফল হতে পারে কিনা! বিখ্যাত মানুষজন কে কে ইন্ট্রোভার্ট ছিলেন। কারণ এটা আপনার দূর্বলতা নয়। আপনার কেবল জানা প্রয়োজন আপনি নিজেকে। আপনি ইন্ট্রোভার্ট মানুষ নাকি লাজুক! 

আপনি হয়ত আরেকটু আত্মবিশ্বাস পেলে নিজেকে আরও সামাজিক করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে হিসাবটা আলাদা হয়ে যায়। কারণ ইন্ট্রোভার্সন আপনার ব্যক্তিত্ব। আর লজ্জা স্রেফ একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বলা যায়। আপনি ইন্ট্রোভার্ট হলে জেনে রাখুন আপনি ভাগ্যবান, আপনি নিজেকে বেশি সময় দিতে পারছেন। আপনি চাইলেই নিজের মতো মানসিক শান্তি অর্জন করে নিতে পারবেন আপনার বহুল ব্যবহৃত মস্তিষ্ক এবং মস্তিষ্কের ক্ষমতা দিয়ে। আর যদি আপনি সৃজনশীল কেউ হন তাহলে তো সোনায় সোহাগা। কেউ একজন বলেছেন, “ইন্ট্রোভার্ট ছাড়া পৃথিবীতে আর্ট বলে কিছু থাকত না”।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা