যেকোনো উৎসব বা পার্বণে, অথবা বাড়িতে কুটুম এলে হেঁশেলের চাপ যেন বেড়ে যায় বহুগুণ। গিন্নির ঘামেভেজা কপাল, শাড়ির খুঁটে হলুদের গুড়ো আর হাতে ব্যস্ত খুন্তি; বাঙ্গালী রান্নাকে নিয়ে গিয়েছে এক অসাধারণ শিল্পেরই পর্যায়ে। 

পাত পেড়ে বসা, কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া, কলাপাতায় পঞ্চব্যঞ্জণ, সুক্তো দিয়ে শুরু করে, ঝালে ঝোলে অম্বল পেরিয়ে, পাকা রুই মাছের কালিয়া, সোনামুগের ঘন ডাল, মাছের দশাসই মাথা দিয়ে মুড়োঘন্ট আর শেষপাতে এসে নতুন খেজুড় গুড়ের পায়েস আর খাটি মর্তমান কলার সাথে দই-রাবড়ি... বাঙ্গালীর রসনাবিলাস যেন মহাভারতের বলশালী ভীমের মতনই বাড়াবাড়ি রকমের। বাঙ্গালী খেতে ভালোবাসে। ভালোবাসে খাওয়াতেও। যেকোনো উৎসব বা পার্বণে, অথবা বাড়িতে কুটুম এলে হেঁশেলের চাপ যেন বেড়ে যায় বহুগুণ। গিন্নির ঘামেভেজা কপাল, শাড়ির খুঁটে হলুদের গুড়ো আর হাতে ব্যস্ত খুনতি...বাঙ্গালী রান্নাকে নিয়ে গিয়েছে শিল্পেরই পর্যায়ে। 

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষজন যখন বাঁচার জন্যে খায়, সেখানে আমরা খাওয়ার জন্যেই বাঁচি৷ দুপুরের প্রথম প্রহরে থালাভরা ভাতের সামনে বসা, মাছের ঝোলে ভাত মাখিয়ে লেবু চিপে খাওয়া শুরু, খেয়ে দেয়ে উদরে ঈষৎ হাত বুলিয়ে এক ভাতঘুম, ছুটির দুপুরগুলোতে হৈচৈ করে মাংস-ভাত... আমাদের জীবনে আনন্দের অন্যতম উৎসও এই খাবার। 

খাবারঘর যেন উৎসবের আরেক তীর্থ!

একটাসময়ে এই বঙ্গীয় জনপদের লোকজনের বেশ অর্থবিত্ত ছিলো। এখনো যে নেই, তা বলছিনা। তবে আগের মতো সেই চটক অবশ্যই আর নেই। যাক, যে সময়ের কথা বলছি, তখন সদ্য সদ্য "ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি"র জাহাজ ঘাঁটি গেড়েছে বঙ্গদেশের বন্দরে। এ দেশ শাসন করতে গেলে কিছু প্রভাবশালী স্থানীয় মানুষের সাথে যে আঁতাত করতে হবে, সেটা ব্রিটিশরা বেশ ভালোই জানতো। তারই ফলশ্রুতিতে জোব চার্নকের কোলকাতারও বেশ কিছু মানুষকে হাত করলো লালমুখোরা। সে তালিকায় জগৎশেঠ, উর্মিচাঁদ ছাড়াও ছিলো আরো মালদার সব বাঙ্গালি। ব্রিটিশদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হলো এই বঙ্গীয় বাবুদের তরতর করে বেড়ে ওঠা৷ কোলকাতায় শুরু হলো এক নতুন কালচার, বাবু কালচার। কোলকাতার বাবুদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লড়াই হতো৷ আফিমের লড়াই, সুগন্ধির লড়াই, পায়রার লড়াই, খাবারের লড়াই...লড়াইয়ের নাম ও বৈচিত্র‍্যের তালিকা বেশ দীর্ঘ৷ সে সময়ে যেকোনো উৎসবে যে ব্যক্তি যত বেশি পদের খাবারের ব্যবস্থা করতে পারতেন, ততই তার গরিমার প্রচার ও প্রসার হতো। 

খাবারের পাতে এরকম হরেক বাহারের পদ না থাকলে চলে! 

এরকমই সময়ের এক প্রভাবশালী ব্যক্তির বিবাহ উৎসবের খাদ্যতালিকার ছবি সম্প্রতি চোখে পড়ে। ১৩৮ টা পদের সে খাদ্য-তালিকাও বেশ আকর্ষণীয়। জানা যায়, কৃষ্ণচন্দ্রের মহারাজ কুমার শ্রীসৌরীশচন্দ্র রায়ের 'শুভ আশীর্ব্বাদ' উপলক্ষ্যে চারটে ডাল-ভাতের ব্যবস্থা হয়েছিলো, ১৩৫৪ সালের ১৪ই অগ্রহায়ন, রোজ রবিবারে। এবং এই  প্রীতিভোজের যে মেন্যুকার্ড, তা ভোজনরসিক যেকোনো বাঙ্গালীর জিভে জল আনিয়ে দেয়ার মতনই। এবং লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, খাবারের বৈচিত্র্য এবং খাবারের নাম। ১৩৮ পদের এই মেন্যুতে ভাতই রয়েছে ২ রকম এবং পাঁচ রকমের রয়েছে পোলাও। মাছের এগারো পদ রয়েছে এবং মাংসের পাঁচ পদ। এছাড়া শরবত, ফলমূল, হজমি, মিষ্টান্ন, আচার, চাটনিরও রয়েছে ব্যাপক সরবরাহ। খাবারের নামগুলোও অদ্ভুত। বাঁধা কপির বুক ধড়ফড়ি, আলুর জয় হিন্দ, কুমড়ার হুসেন শা... বাহারি সব নাম। 

১৩৮ পদের সেই মেন্যুকার্ডের খাবারের নামগুলো বড্ড বিচিত্র

খাবারের এই মেন্যুকার্ড যেন এক লহমায় ধাক্কা দিয়ে নিয়ে গেলো অতীতে। এবং আবারো টের পেলাম- কত বৈচিত্র‍্যের ছিলো এদেশের খাবার। এদেশে এসেছে বহুজাতের মানুষ। খাদ্যভাণ্ডারে এবং খাদ্যের প্রকারেও এসেছে তাই পরিবর্তন। পার্সিয়ান, পর্তুগীজ, বিলিতি, চীনা আর দিশি খাবারের মিলনে এ যেন এক অন্যরকম তানপুরার ছিলার টান! একসময়ে মানুষ যারপরনাই তৃপ্তি পেতো, মেতে থাকতো খাবারের বহরে, খাবারের বাহারে। ব্যাঙের ছাতার মত রেস্তোরাঁ আর বিভিন্ন খাবারের শংকরায়ন তখনো হয়ে ওঠেনি অতটা প্রকট। যতই দিন গড়াচ্ছে, পুরোদস্তুর বাঙ্গালীয়ানা খাবার নিয়ে ঔদাসিন্যের আবহ দেখছি। উৎসাহে কেমন যেন ভাটা পড়ছে সর্বত্রই। খাবারের সেই জৌলুশের ক্ষেত্রটিও সংকুচিত হচ্ছে প্রতিদিনই। বাঙ্গালী খাবারের একচ্ছত্র আধিপত্যও আর নেই। সেখানে চলে আসছে বিজাতীয় খাবারের দাপট। বাঙ্গালীর সেই খাওয়ার আর খাওয়ানোর শিল্পে কী ক্রমশ ভাটা পড়ছে? লক্ষণ-টক্ষন অবশ্য সেরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে। 

কিন্তু সেরকম কিছু হলে তা মোটেও সুখকর বিষয় হবেনা আমাদের জন্যে। নিজেদের স্বকীয় বিষয়ের ক্ষেত্রটি, নিজের শিল্পের জায়গাটিই আমরা হারাবো হয়তো দিনশেষে। যেটি কাম্য নয় মোটেও।  

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা