যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে!

বাঙালি রমণী মাত্রই প্রবচনটির কথা জানেন। নিজেকে পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা নারী চরিত্রের এক অন্যতম দিক। যে নারী একেবারেই সাজেন না, তার কাছেও অন্তত একটি কাজল এবং ঠোঁট সাজাবার উপকরণ হিসেবে লিপস্টিক থাকবেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্যগত সাজগোজের সাথে তাল মিলিয়ে কিন্তু পিছিয়ে নেই বাঙালী নারীরা। আবহমান কাল ধরেই এদেশের নারীরা নিজস্ব ঢঙয়ে সাজিয়ে পরিপূর্ণ করে তুলেছেন নিজেদের। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অব্দি, কোথায় নেই তাদের স্বচ্ছন্দ্য পদচারণা!

প্রাচীন বাংলার ইতিহাস থেকে দেখা যায়, সেসময়কার নারীরা নিজেদের সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী সাজগোজ করতেন। হিন্দু ও মুসলিম উভয় নারীই ব্যবহার করতেন সিঁদুর। নিম্ন বর্ণের নারীরা চুলে সুগন্ধী তেল ব্যবহার করতেন। চুল ধোয়ার জন্যে ব্যবহার করতেন রিঠা। চুল আঁচড়াতে কাঠের চিরুণি।  মুখে তেমন কোন প্রসাধনীর ব্যবহারের কথা জানা না গেলেও ছিল গয়নার প্রচলন।

মধ্যবিত্ত নারীরা গোলাপের পাপড়ির রস ব্যবহার করতেন ঠোঁট রাঙাতে। ভেজা চুল আগরের ধুপ দিয়ে শুকোতেন সুগন্ধী হিসেবে। এছাড়াও, আতর ও ফুলের  সুগন্ধীর ব্যবহার ছিল সর্বজনবিদিত। গয়না হিসেবে তারা পরতেন হাঁসুলি, কানপাশা, নোলক ইত্যাদি। উচ্চবিত্তের নারীরা শাড়ির সাথে রেশমের ওড়না ও রুমাল ব্যবহার করতেন। চন্দন ছিল তাদের প্রতিদিনকার ব্যবহার্য প্রসাধন।

প্রতিদিনকার ব্যবহার্য প্রসাধনের মধ্যে চন্দন ছিল অন্যতম

এছাড়াও কাঁঠাল পাতার উপর বিশেষ উপায়ে তৈরিকৃত কাজল তারা চোখের প্রসাধন হিসেবে ব্যবহার করতেন। ছিল আগর, ধুপ ও সুরমার ব্যবহারও। চুলের যত্নে হাতির দাঁতের চিরুণির ব্যবহার ছিল অন্যতম। ঠোঁট রাঙাতে গোলাপ পাপড়ির চূর্ণ ও এক প্রকার ভেষজ রঞ্জক ব্যবহৃত হত। অভিজাত শ্রেণীর নারীরা গয়না দিয়ে নিজেকে সাজাতে পছন্দ করতেন। শীতলা হার, কঙ্কন, বালা, রুলি, বাজু, মাথাপাটি, অঙ্গুরি ছিল তাদের বহুল ব্যবহৃত আভরণ সামগ্রী।

কালক্রমে এসব সাজের অনুষঙ্গ বেড়েছে, এসেছে নতুনত্ব। ঔপনিবেশিক সময়ে বাইরের সংস্কৃতির সাথে বাঙালি নারীদের পরিচয় ঘটে। গালে গোলাপী আভা আনার জন্যে মোম জাতীয় রুজ ব্যবহার ও মুখমন্ডলে লেডের প্রলেপ দিয়ে সাজানো, পিতলের কাজলদানীতে তেল ও কাপড় পুড়িয়ে কাজল তৈরি, চুলে সাবান ও নারকেল তেলের ব্যবহার ইত্যাদি নতুন আঙ্গিকে যোগ হয়। সেই সাথে পোশাকের আদলেও আসে পরিবর্তন। তবে গয়নার ব্যবহারে প্রচলিত স্বর্ণ ও রুপার বদলে আসে লোহা, তামা, কাঁচ ও পিতলের ব্যবহার।  

ষাট থেকে সত্তরের দশকে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখা যায় নারীদের সাজের ক্ষেত্রে। পোশাক যে ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক, এটি তখনকার হাল আমলের নারীরা বুঝতে পারেন বেশ ভালো করেই। গয়নার প্রচলন সে সময়ে শুধু বিবাহিত নারীদের মধ্যেই কিছুটা সীমিত রয়ে গিয়েছিল। পশ্চিমা বিশ্বের অনুকরণে তখন অনেক নারীরাই শাড়ি ছেড়ে পশ্চিমা পোশাকে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছিলেন। তবে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে শাড়ি ও কামিজের প্রচলন কখনোই চলে যায়নি। ত্বক ও চুলের যত্নে এসেছিল পরিবর্তন। চুল বাধার ক্ষেত্রেও শুধু খোঁপায় আবদ্ধ না থেকে তাঁরা বেণীও করতেন। ক্রিম, পাউডার, আইলাইনার, ঠোঁটের যত্নে ব্যবহৃত পেট্রোলিয়াম জেলি প্রভৃতি এ সময়েরই অবদান। নারীরা এ সময় সাজের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে ঘড়ি পরতে অভ্যস্ত হন।

এবার আসি বর্তমানে। আবহমান কাল ধরে চলা নারীদের সাজের ঐতিহ্য বর্তমানে যেন পূর্ণতা পেয়েছে। শুধু সৌন্দর্য বর্ধনই এখন নারীর সাজের একমাত্র অনুষঙ্গ নয়। এর সাথে প্রাত্যহিক জীবনে খাবারের নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্যবিধি, শরীরচর্চা, ত্বকের যত্ন, চুলের ও নখের যত্নও সাজের প্রধান অঙ্গ বলে বিবেচিত। নিজেকে অপরূপ করে তুলতে মেয়েরা এখন ব্যবহার করেন ত্বকের ধরন অনুযায়ী ক্রিম ও ফাউন্ডেশন, ব্লাশ, পেন্সিল কাজল ও বিভিন্ন রঙের লিপস্টিক। সেই সাথে সুগন্ধি হিসেবে বডি স্প্রে ও পারফিউম তো আছেই আলাদা মাত্রা যোগ করতে। পরিপূর্ণ একটি সাজের জন্য এখন প্রয়োজন হয় বিভিন্ন রকম মেকাপ ব্রাশ, কমপ্যাক্ট পাউডার, আইলাইনার, মাশকারা, হাইলাইটার, ইত্যাদি। নিত্যদিনের যত্নে ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের  সাবান, শ্যাম্পু, শাওয়ার জেল, ক্রিম, সানব্লক লোশন, অলিভ অয়েল ও লোশন।  

নারী অনন্য। নিজেদের গৃহস্থালি কাজ ও বাইরের সমস্ত কাজ সামলেও নারীরা নিজেদের রেখেছেন সৌন্দর্যের প্রামাণ্য সংজ্ঞা হিসেবে। বিশ্বায়নের এই যুগে তাই প্রতিনিয়তই বদলাচ্ছে নারীর পরিপাট্যের ধরন। তবে সাজগোজের ধরন কিংবা সামগ্রী যতই বদলাক, দিনশেষে বাঙালি  নারী স্বমহিমায় উদ্ভাসিত, আলোকিত।  

তথ্যসূত্র:

১. প্রাচীন বাংলার সামাজিক ইতিহাস; এস এম রফিকুল ইসলাম
২. ঔপনিবেশিক বাংলায় মেয়েদের সাজগোজ; জয়িতা দাস

৩. খোঁপা: বঙ্গকন্যার সাজের অনবদ্য ঐতিহ্য

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

আরও পড়ুন-


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা