জিততে এবার হবেই এবং বাস্তবতার নিরিখে কার্যকর ফুটবল খেলেই। সুন্দর ফুটবল বা রূপুর দিকে তাকাবার সময় নেই!

ফুটবলে হোম এডভান্টেজের উপকরণ এতটা বৈচিত্রময় যে তা রীতিমত গবেষণার বিষয়বস্তু। ভ্রমণ দূরত্ব/সময়, ঋতু, ভৌগলিক উচ্চতা, দিন-রাত্রি থেকে শুরু করে থাকা-খাওয়া, মাঠের প্রস্তুতি প্রভূত ক্ষেত্রে তা আমরা দেখি। এবং সেক্ষেত্রে এশিয়া মহাদেশের চেয়ে বেশি ফুটবল বৈচিত্র্য আর কোথাও নেই। সুবিশাল আয়তনের এই মহাদেশে মধ্য ও পূর্ব এশিয়ার হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা অঞ্চল থেকে শুরু করে পশ্চিমের নিদারুণ গরম এবং আসিয়ান ও দক্ষিণ এশিয়ার অসহ্য আর্দ্রতাও আছে। নেপাল-ভূটানের মত সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে কয়েকশো মিটার উপরে থাকা স্টেডিয়াম যেমন আছে, তেমনি আছে গুয়ামের সমুদ্র সমতলের সমান অবস্থানের স্টেডিয়াম।

২০০৩ সালে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের হোম ম্যাচে মঙ্গোলিয়াকে ১২ গোলে হারিয়েছিল মালদ্বীপ অথচ এওয়ে ম্যাচে গিয়ে মাত্র ১-০ তে জিতে আসে তারা। সেখানে তুষারপাতের ফলে এত ঠান্ডা পড়েছিল যে মালদ্বীপ তাদের টিম বাস নিয়ে স্টেডিয়ামের ডাগআউটে চলে আসে এবং একাদশ বাদে বাকি সবাই ম্যাচের পুরোটা সময় ছিল বাসের ভেতরেই! স্লোভাকিয়ান কোচ যোজেফ জাঙ্কেচ প্রয়োজনে বের হয়ে কিছু নির্দেশনা দিয়ে আবার ঠাস করে বাসে ঢুকে যেতেন!

২০০৭ সালে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে তাজিকিস্তানের বিপক্ষে হোম ম্যাচ ১-১ এ ড্র করেছিল বাংলাদেশ। এওয়ে ম্যাচের প্রথমার্ধ গোল শূন্য রাখি আমরা। সেখানে ঠান্ডা বেশ ভালোভাবেই সামলে নিচ্ছিলাম। কিন্তু বিরতিতে শুরু হয় তুষারপাত। দ্বিতীয়ার্ধের প্রচন্ড ঠান্ডায় রীতিমত ঠায় দাঁড়িয়ে পড়ে পুরো দল। নড়াচড়া করাই দায়। এই সুযোগে প্রথম ৫ মিনিটেই ৩ গোল দিয়ে ম্যাচটা হাতে নিয়ে নেয় তাজিকরা। তাজিকদের ডেরায় এরপর যতবারই গিয়েছি আমরা, প্রত্যেকবার ভুগতে হয়েছে।

আরব অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়ার ভোগান্তি প্রায় নিয়মিত। জর্ডান কিংবা ওমানের মত দেশ অজিদের বিপক্ষে দুপুরের রীতিমত খাড়া রোদে ম্যাচ ফেলে। ২০১২ সালে বিশ্বকাপ বাছাইতে যুক্তরাস্ট্রের বিপক্ষে গুয়াতেমালা নিজেদের হোম ম্যাচটি খেলে এস্তাদিও মাতেও ফ্লোরেস স্টেডিয়ামে যা প্রায় সমুদ্র সমতলে এবং ১-১ এ রুখে দেয়। যুক্তরাস্ট্রের দলকে খুব বাজে এক হোটেলে রেখেছিল এবং ম্যাচের আগের মধ্যরাত পর্যন্ত সমর্থকরা হোটেলের বাইরে উচ্চস্বরে বাদ্য-বাজনা করে ও আতশবাজি পোড়ায়!

ভ্রমণ দূরত্ব বলে একটা কথা বলেছিলাম শুরুতে। ভারতের গুয়াহাটিতে ঢাকা আবাহনীর রেকর্ড খুব ভালো, ২০১০ থেকে সেখানে খেলা সর্বশেষ ৩ ম্যাচের ৩টিতেই জয়! ২০১৮ ও ২০১৯ সালে যথাক্রমে আইজল ও মিনারভা পাঞ্জাবকে এএফসি কাপে হারায় আকাশী নীলরা। যে কোন কারণেই হোক নিজেদের হোম ভেন্যুতে খেলবার সুযোগ হয়নি উভয় দলেরই। আইজল ও ঢাকা আবাহনীর জন্য গুয়াহাটি প্রায় সমান দূরত্বে। আমাদের জন্য যা ২৫৩ কিলোমিটার সেখানে পাঞ্জাবের দলটির জন্য দূরত্ব প্রায় ২,২০০ কিলোমিটার! এবং গত বছর এই গুয়াহাটিতে তাদের হারিয়ে ঢাকা আবাহনী ইতিহাস গড়ে প্রথমবারের মত টুর্নামেন্টটির নক আউটে পৌছায়। ঢাকা আবাহনীর ২০১০ সালের জয়টি এসেছিল বরদলই কাপের ফাইনালে নেপালের থ্রি স্টার ক্লাব কে ৩-০ তে পরাজিত করে।

বার্সেলোনার পাসিং ফুটবলে বাঁধা তৈরি করতে মাঠের ঘাস ছেটে প্রায় ধান ক্ষেতের মত ন্যাড়া/অসমান করে ফেলতে দেখা গিয়েছে কিছু ক্লাবকে। উইং প্লে তে বিপজ্জনক দলকে রুখতে মাঠের ওয়াইড এরিয়া তথা কর্নার ফ্ল্যাগের দিকের জায়গা ছোট করে আনবার কাহিনী আছে। এই অঞ্চলে এরকমটা একবার ইস্ট বেঙ্গল করেছিল মোহন বাগানের সনি নর্দেকে সামলাতে।

যে কোন ম্যাচে দর্শক প্রভাব নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। ভারতের কলকাতা, ইন্দোনেশিয়া, ইরানের দর্শক সংস্কৃতি অবিশ্বাস্য ও পৃথিবী বিখ্যাত। ইউরোপের বুরুশিয়া ডর্টমুন্ড কিংবা রিয়াল মাদ্রিদের সমর্থক গোষ্ঠীর অন্যরকম নিজস্বতা আছে। সারবিয়ান জায়ান্ট রেড স্টার বেলগ্রেডের স্টেডিয়ামে খেলোয়াড়দের মাঠে প্রবেশের যে লম্বা আলো-আধারের টানেল পথ, এর ভেতর দিয়ে যাবার সময় মাঠ থেকে আসা দর্শকদের গগনবিদারী আওয়াজ মিলিয়ে ভ্রমণকারী দলের জন্য ভূতুড়ে হয়ে দাড়ায় পরিস্থিতি। ২০১৮ সালে সেখানে খেলতে গিয়ে চ্যাম্পিয়নস্ লীগের ম্যাচে হেরেছিল লিভারপুল। আমি নিজের এক অভিজ্ঞতা বলি। ২০১৭ সালে নিজ দল নোয়াখালী মেডিক্যাল কলেজের হয়ে আন্তঃমেডিক্যাল ফুটবল খেলতে গেলাম কিশোরগঞ্জের জহুরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজে। কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা পড়লো স্বাগতিকদের দ্বিতীয় দলটির সাথে। মাঠের চারপাশে তো বটেই, এর এক পাশের যে ছাত্র হোস্টেলটি আছে সেটির বারান্দা-জানালাগুলো দিয়ে সমর্থকদের তুমুল হৈচৈ ম্যাচের আগে আগে। আমরা মাঠে গিয়ে উপস্থিত হতেই 'নোয়াখালী বিভাগ চাই!' স্লোগানে স্লোগানে তীব্র রেষ নিয়ে আমাদের মানসিকভাবে ভড়কে দিতে শুরু করলো তারা সকলে!

তো এত সব কিছুর ভীড়ে বাংলাদেশের অবস্থান কিরকম? সত্যি তো এই যে, বাফুফের কোন ধারণাই নেই হোম এডভান্টেজ কী! বৃষ্টি হবার পর মাঠ পুরোপুরি শুকিয়ে না আনা কিংবা শীতপ্রধান কোন দেশের বিপক্ষে দুপুরের কড়া রোদে ম্যাচ রাখা ইত্যাদি কোন বুদ্ধিই তাদের মাথায় খেলে না। ২০১৫ কিংবা ২০১৬ সালে কিরগিজিস্তান বা তাজিকিস্তানের বিপক্ষে তারা খুব সুন্দর করে মাঠে জমে থাকা পানি সরিয়ে নেয়। ২০১৫ সালে অলিম্পিক বাছাইতে তারা দেখলো যে দুপুরের রোদে উজবেকিস্তান কি পরিমাণ ভুগেছে ভারতের বিপক্ষে। ভারত বেশ কিছু সুযোগ হারিয়ে ৮০ মিনিটের পর ২ গোল হজম করে হারে। অথচ উজবেকদের বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচটা খেলা হলো সন্ধ্যায় এবং আমরা খুব বাজেভাবে খেলে হারলাম ৪ গোলে। অথচ ২০১২ সালেই এএফসি অ২৩ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইতে নেপালে দুপুরে হওয়া ম্যাচে উজবেকিস্তান কোনরকম ২-১ এ জিতেছিল আমাদের বিপক্ষে। কিন্তু না! আমরা সন্ধ্যাতেই খেলবো! আমরা স্বাগতিক কিনা!

আমার একটাই কথা। আগামী ৮ অক্টোবর সিলেটে আফগানিস্তানের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের হোম ম্যাচ আমরা খেলবো দুপুর বেলার কড়া রোদে। তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি বা এর চেয়েও বেশি হতে পারে। এবং আর্দ্রতা থাকতে পারে ৭০% এরও বেশি। ইউরোপ/আমেরিকায় ক্লাব ফুটবল খেলা আফগানরা নিশ্চিতভাবেই ভুগবে। আমি চাই তারা ঢাকাতে এয়ারপোর্টে নেমে সড়কপথে সিলেট যাবে। হ্যাঁ, এরপরও যে আমরাই জিতবো এমন কোন কথা নেই। এটা ফুটবল। এখানে যে কোন কিছু হতে পারে। কিন্তু জেতার সম্ভাবনা বাড়িয়ে নিতে হবে।

আগে দুপুরের রোদে ম্যাচ খেলবার কথা উঠলে অনেকে বলতো আমাদের খেলোয়াড়রাই উল্টো ভুগবে। আমি এটা কখনোই মানি নাই। আমরা ভুগলে প্রতিপক্ষ আরও বেশি ভুগবে। এমন কোন বাংলাদেশি ফুটবলার আছে যে মার্চ থেকে জুনের দুপুরে নিয়মিত খেলেনি? এবং আমাদের বর্তমান দলটির দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখা যাবে বাংলাদেশ ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে ফিট কিছু খেলোয়াড় আছে দলটিতে যাদের অনেকের ফিটনেস বৈশ্বিক মানের। অতএব এখন কোন সন্দেহ ছাড়াই আফগানদের বিপক্ষে ম্যাচটি দুপুরের কড়া রোদে ফেলবার আহ্বান জানাই আমি।

এবারে ফুটবল সাইকোলজির বিষয়ে আসি। আসলে এর তো কোন সীমা পরিসীমা নেই। তাই নির্দিষ্টভাবে স্বাগতিক দলের মানসিকতায় আসি। আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, আমার লেখা সেই সব স্বাগতিক দলকে নিয়ে যারা প্রতিপক্ষের তুলনায় দুর্বল।

কিছু উদাহরণ দিলে আপনারা বুঝতে পারবেন আমি কোন দিকে নিতে চাচ্ছি লেখাটা। এবারের চ্যম্পিয়নস্ লীগের গ্রুপ পর্বে বার্নাব্যু তে ২-২ তে ড্র করে আসে বেলজিয়ামের ক্লাব ব্রুগা। স্বভাবতই ঘরের মাঠে এরকমই বা এর চেয়ে ভালো ফল তাদের সমর্থকরা আশা করতে পারে কি না? কিন্তু ব্রুগা হেরে যায় ১-৩ এ। এ সকল উদাহরণের ক্ষেত্রে তুলনমূলক দুর্বল দলগুলো যাদের হোম ম্যাচ দ্বিতীয় লেগে তাদের উদাহরণই ব্যবহার করবো শুধু। ২০১৫ এর চ্যাম্পিয়নস্ লীগে আর্সেনাল কে এওয়ে ম্যাচে ৩-২ তে হারিয়ে আসে গ্রিক ক্লাব অলিম্পিয়াকোস। গ্রুপের শেষ ম্যাচে ইংলিশ দলটির বিপক্ষে ঘরের মাঠে ড্র করলেই নক আউট নিশ্চিত অপর দিকে আর্সেনালের জিততেই হবে। অলিম্পিয়াকোস হেরে যায় ০-৩ এ। ২০১৫ সালে বিশ্বকাপ বাছাই এর ম্যাচে জাপানে গিয়ে স্বাগতিকদের গোলশূন্য ভাবে আটকে আসে সিঙ্গাপুর। কিন্তু নিজেদের মাটিতে হেরে যায় ০-৩ এ। ২০১১ সালে বিশ্বকাপ বাছাই এর প্লে অফে সিরিয়াতে গিয়ে এক গোলের ব্যবধানে হেরে আসলেও মূল্যবান ১টি এওয়ে গোল নিয়ে আসে তাজিকিস্তান। কিন্তু হোম ম্যাচে ০-৪ এ হেরে যায় তারা।

২০১৫ সালে বিশ্বকাপ বাছাইতে আর্জেন্টিনাতে গিয়ে ২-০ তে জিতে আসে ইকুয়েডর। ২০১৭ সালে শেষ ম্যাচের দিন ডু অর ডাই পরিস্থিতিতে ইকুয়েডরে যায় আর্জেন্টিনা। এই ম্যাচে ড্র বা জিতলেও ইকুয়েডরের বিশেষ লাভ হতো না তবে ইকুয়েডর জিতবে এমন আশা করে ম্যাচটির দিকে চেয়ে ছিল চিলি ও প্যারাগুয়ে। আর্জেন্টিনার মত ফুটবল শক্তিকে বিশ্বকাপে যাওয়া থেকে বঞ্চিত করবার ইচ্ছা থাকা স্বাভাবিক ইকুয়েডরের। কিন্তু ম্যাচটি জিতে নিয়ে বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করে আর্জেন্টিনাই।

২০০৫ এর এএফসি কাপে গ্রুপ পর্বের ৩ ম্যাচ তথা অর্ধেক শেষে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সমান ৪ পয়েন্ট পেয়ে গোল গড়ে তুর্কমেনিস্তান এর ক্লাবের পেছনে ৩য় স্থানে ছিল। জর্ডানের এক ক্লাব ৭ পয়েন্ট নিয়ে ১ম ও ভারতের ইস্ট বেঙ্গল ১ পয়েন্ট নিয়ে শেষ স্থানে। তুর্কমেন ক্লাবটিকে এওয়ে ম্যাচে আমরা ১-০ তে হারালেও ঘরে হেরে যাই ১-২ তে। ইস্ট বেঙ্গলের বিপক্ষে সল্ট লেকে ড্র করলেও ঢাকায় হেরে যাই ০-১ এ। আমরা গ্রুপ পর্ব শেষ করি তলানিতে থেকে।

প্রথমত, তুলনামূলক অধিক শক্তির এওয়ে দল জিততেই পারে। কিন্তু এওয়ে ম্যাচে ভালো ফল করে হোম ম্যাচে খারাপ করতে চাইবে কোন দুর্বল দল? বিশেষ করে যখন পরবর্তী ধাপে কোয়ালিফাই করবার সুযোগ থাকে? এক্ষেত্রে দুর্বল দলগুলোর মূল যে ভুলটা হয় বলে আমার সব সময় মনে হয়েছে তা হচ্ছে এওয়ে ম্যাচে ভালো করবার সুবাদে অধিক আত্মবিশ্বাসে অধিক আক্রমণে ওঠবার চেষ্টা যার ফলশ্রুতিতে প্রতিপক্ষকে একটু বেশি স্পেস দিয়ে দেয়া। সাইকোলজির খেলাটা এখানেই। মরিয়া প্রতিপক্ষ সেই সুযোগটা অবশ্যই নিয়ে নিবে। সব কিছু বুঝে নিয়ে, হাতে কি আছে জেনে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে অল আউট এটাক, বিল্ড আপ ফুটবল আপনি কতটা প্রয়োগ করবেন। কারণ ম্যাচ জেতার আরও ভালো পথ আছে। প্রতিপক্ষ চতুরতার সাথে প্রেসিং কমিয়ে আপনাকে উপরে আনবার ফাঁদ পাতলে আপনি সেই সুযোগ কতবার নিবেন তা বিবেচনার বিষয়। এমনিতে হোম ম্যাচে পজেশন কেমন পাবেন তা বলা মুশকিল, কিন্তু আক্রমণের সংখ্যা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বেশি বা এওয়ে ম্যাচের সমান পাবেন। তবে এর জন্য আপনার ফোকাস হতে হবে আক্রমণের সুযোগ নেবার ক্ষেত্রে, আক্রমণ গড়তে নয়। কারণ আপনার প্রতিপক্ষ তো মরিয়া হয়েই আছে। অতএব আক্রমণের স্পেস আপনি পাবেনই। সেক্ষেত্রে ব্যবধান গড়ে দেবে আপনার দলের গোল করবার সক্ষমতা। আবার বিল্ড আপে আক্রমণ গড়বেনই না, এমন কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। আপনার যদি মিডফিল্ডের খেলা ধরার মত কেউ থাকে তাহলে অবস্থা বুঝে অবশ্যই খেলা ধীর করে দেয়া বা বিল্ডআপ ফুটবলের চেষ্টা করতেই পারেন। অন্যথায় কোন পরিকল্পনা ও পর্যাপ্ত গোলা বারুদ ছাড়া সুন্দর ও আক্রমণাত্বক ফুটবল খেলা হবে আত্মহত্যার সামিল। এখানে আমি নেগেটিভ ফুটবলের কথা বলছি না। নেগেটিভ ফুটবল মানেই ডিফেন্সিভ ফুটবলের অবধারিত উপস্থিতি কিন্তু ডিফেন্সিভ ফুটবল মানেই যে সব সময় তা নেগেটিভ ফুটবল এরকম না। নিজের সক্ষমতা চিন্তা করে খেলতে হবে। অতি আগ্রহ কখনই ভালো না।

তাহলে সিলেটে আফগানিস্তান ও ভারতের বিপক্ষে আমাদের ফরমেশন ও ট্যাকটিক্স কেমন হওয়া উচিত হবে? এমনিতে জেমি ডে খেলাতে পারেন ৪-১-৪-১ এ যা তার প্রিয় ৪-২-৩-১ ফরমেশনের ভিন্ন রূপ। প্রতিপক্ষের অর্ধে ডিফেন্ডিং এর সময় তা হয়ে যায় ৪-৪-১-১ বা ৪-৪-২। ডিপ ডিফেন্ডিং এ হয়ে যায় ৪-৫-১ এবং এটাকের সময় ৪-৩-৩।

১৯৭৮ সালের এশিয়ান গেমসে ভারতের বিপক্ষে ০-৩ এ হারবার ম্যাচটি ছাড়া গত বছরের আগ পর্যন্ত আর কোন ম্যাচেই বাংলাদেশ বোধকরি এতটা ট্রু আন্ডারডগ হিসেবে খেলেনি। ২০১৯ এর আগে ভারতে খেলা ৭ ম্যাচের ৫টিতেই হেরেছিলাম আমরা। ১৯৯৯ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে হারবার আগে গ্রুপ পর্বে ড্র করেছিলাম। ২০১৪ সালে ফিফা ফ্রেন্ডলিতে ড্র ২-২ তে। এবং গত বছরের বিশ্বকাপ বাছাইতে কলকাতায় খেলতে নামার আগে ভারতের সাথে ফিফা র‍্যাংকিংয়ে ব্যবধান ছিল ৮৩! এত বড় ব্যবধানে এগিয়ে থাকা কোন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে এওয়ে ম্যাচে পরাজয় এড়াবার নজির নেই বাংলাদেশের।

ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষে ৩ ম্যাচে ১টি করে জয়, ড্র ও পরাজয়। ড্র ম্যাচটি আমরা টাইব্রেকারে হেরেছিলাম। যে ম্যাচটি জিতেছিলাম সেখানে গোল্ডেন গোল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ভারত বনাম বাংলাদেশ

অনেকেই ধন্য ধন্য করেছে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের কাউন্টার এটাকিং খেলা দেখে। আমি বলবো ডিফেন্ডিংয়ে আমরা সুন্দর কাঠামোবদ্ধ খেলা দেখালেও কাউন্টারে এমন কোন খেলা খেলিনি যা নিয়ে সমালোচক হিসেবে আলোচনার টেবিলে আগ্রহের সহিত কাটাছেড়া বা গবেষণা করা যাবে। কাউন্টারগুলো ছিল উল্টা-পাল্টা এবং ওই নির্দিষ্ট দিনে ইব্রাহিম অতিমানবীয় না হয়ে ওঠলে কটি কাউন্টার দাগাতে পারতাম আমরা তা বলা মুশকিল। কিন্তু ভালো-মন্দ সব এক করে যদি ফলাফলের ভিত্তিতে বলতে হয় তাহলে বলবো, জেমি ডে অনন্যসাধারণ এক খেলা দেখিয়ে ফল এনে দিয়েছেন। যে কোন দিন আপনি 'ফলহীন সুন্দর/গোছানো ফুটবল' বনাম 'যে কোন মূল্যে ফল' বিতর্ক নিয়ে আমার সামনে আসুন, আমি চোখ বন্ধ করে নির্দ্বিধায় ফল বেছে নিব।

অনেকে হয়তো ধরতে শুরু করেছেন যে, হোম ম্যাচে আফগানিস্তান বা ভারতের বিপক্ষে আমি সেই একই ডিপ ডিফেন্স ও কাউন্টার এটাকের বস্তাপচা ট্যাকটিক্স চাইছি। একদম ঠিক ধরেছেন। কারণ ফল পেতে এর বিকল্প আমাদের নেই। এবং ফল ছাড়া আমি আর কিছু ভাবছি না। ভারতের বিপক্ষে কলকাতার ম্যাচটিতে যদি আবার ফিরে তাকাই, সুনীল ছেত্রীসহ ভারতের আপফ্রন্টকে আমরা কার্যকরভাবে আটকে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম। পরিষ্কার সুযোগ তারা খুব কম পেয়েছিল। কিন্তু আমাদের মিডফিল্ডের বল হোল্ড করবার ব্যর্থতায় তারা ঠিকই বারে বারে আমাদের ডিফেন্সে এসে আছড়ে পড়ছিল। যার জন্য অমানবিক ভাবে চাপ নিতে হয়েছিল ডিফেন্সকে। যদি ইমন বা জোসেফ রহমানের মত সেন্টার মিডফিল্ডার খেলাতে পারতাম আমরা তাহলে দেখা যেত চাপ অনেক কমে আসতো ডিফেন্সের ওপর থেকে। সেই সাথে কাউন্টার এটাকের ট্রানজিশনাল টাইমে তারা প্রয়োজনীয় সময় নিয়ে বল ছেড়ে খেললে আক্রমণগুলো অধিকতর শক্তিশালী হতো এবং অধিক সংখ্যক খেলোয়াড় আক্রমণে অংশ নিতে পারতো। কিন্তু রূপু তো কাজের খেলোয়াড় খেলাবে না জেমিকে বাধ্য করে। তাই ট্যাকটিক্সও বস্তাপচা রাখতেই হচ্ছে।

বল পায়ে আক্রমণাত্বক ফুটবল খেললে মনের স্বাদ মিটতে পারে অনেকের, মিডিয়ার তালি পেতে পারি কিন্তু হারলে কি লাভ বলুন? ফুটবল হচ্ছে যুদ্ধ। হামলা আপনি সামনে থেকে না করে গেরিলা হয়ে করেও জিতে যেতে পারেন। হোম ম্যাচে আমরা কাদের বিপক্ষে খেলতে যাচ্ছি দেখুন। আনিরুধ থাপা, সাহাল আবদুল সামাদ, ব্রান্ডন ফারনান্দেসদের সমন্বয়ে ভারতের মিডফিল্ডকে তাদের ইতিহাসের অন্যতম সেরা বলা হচ্ছে। আছে ৭২ গোল নিয়ে ইতিহাসের সর্বকালের ১০ম সেরা স্কোরার সুনীল ছেত্রী। ওদিকে আফগানদের একেক ফুটবলার শারিরীকভাবে ও ট্যাকনিক্যালি অত্যন্ত শক্তশালী। ইমন বা জোসেফের মত খেলোয়াড় ছাড়া মরিয়া দল দুটির বিপক্ষে সুন্দর আক্রমণাত্বক খেলা হবে বাজে সিদ্ধান্ত। প্রায় দুই যুগ ধরে বাংলাদেশ ও এশিয়ান ফুটবল দেখে আসা আমি আমাদের ফুটবল ও এসকল প্রতিপক্ষকে নিজের হাতের তালুর মত চিনি। ইমন বা জোসেফকে নিয়ে খেললেও সম্ভাবনা কমই থাকছে কারণ ইমনকে আমরা সারা জীবন অনিয়মিত খেলিয়েছি জাতীয় দলে, আর জোসেফ তো সিন্ডিকেটের ঠেলায় ক্লাবেই খেলবার সুযোগ পায় না ঠিকমত। ধরে নিলাম তাদের খেলানো হলো কিন্তু জেতার চাপ দিলে তা হয়ে যেতে পারে হিতে বিপরীত। যদি মামুনুলের ব্যাচটা থাকতো তাহলে আমিও সুন্দর বিল্ড আপ ফুটবল খেলাবার পক্ষেই মত দিতাম, তাও যদি তাদের সেরা সময়টা থাকতো। বর্তমান প্রজন্মের ফিটনেস অসাধারণ হলেও টেকনিকে তারা খানিক পিছিয়ে।

আগামী মাসে ইউরোপ/আমেরিকা থেকে কিছু খেলোয়াড় আসছে ট্রায়ালে। পার্থক্য গড়ে দেবার মত কাউকে পেলে জেমি নিজে থেকেই তার ট্যাকটিক্স পরিবর্তন করে নিবেন। এমনিতে আমার মনে হয় না যে আমার কথাগুলোর বিপরীতে তার ভিন্ন কোন পরিকল্পনা মাথায় আছে। আমি চাই আমরা হোম ম্যাচেও যেন ট্রু আন্ডারডগের মতই খেলি। জেমিও সেভাবেই খেলাবে বলে আমার শক্ত ধারণা। টিটু যেমন মুখে যদি জেতার কথা বলে, কিন্তু খেলবে ম্যাচ বাঁচাতেই, জেমি মুখে যাই বলুক তার চিন্তা ম্যাচ জেতার দিকেই থাকে। গত দুই বছর তাকে দেখে এসে আমার উপলব্ধি এমনই।

বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের কোচ জেমি ডে

কোচ জেমি ডে'কে বলতে চাই, আপনার হারাবার কিছু নেই। দক্ষিণ এশিয়ায় যে চর্চাটা খুবই কম- কোচকে বেশি সময় না রাখা এবং যেখানে বাংলাদেশে এই নজির একদমই নেই সেখানে আপনি ২+২= ৪ বছর পূরণ করবার চুক্তি করে ফেলেছেন। অর্জন করে নিয়েছেন উয়েফা প্রো লাইসেন্স, যা কোচদের সর্বোচ্চ কোচিং সার্টিফিকেট। রূপুকে পাত্তা দেবার আর কোন কারণ আমি দেখি না। নিজের পছন্দমত খেলোয়াড় খেলিয়ে সর্বনাশ হলেও অন্তত আগামী বছরের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের আগে আপনার বরখাস্ত হবার কোন সুযোগই দেখি না। এবং নিজের মত করে খেলালে বরখাস্ত হবার কোন সুযোগও নেই আপনার। আমি খুব ভালোভাবেই জানি আপনি আমাদের সাধারণ সমর্থকদের মতই কোন খেলোয়াড়ের সামর্থ্য কেমন তা ভালো করেই জানেন বরঞ্চ আমাদের চেয়ে অবধারিতভাবেই কয়েক গুণ ভালো জানেন। বসুন্ধরা কিংস্ এর সভাপতি ইমরুল হাসানও প্রকাশ্যে বেশ কয়েক বার বলেছেন আপনার ওপর দল নির্বাচনে অযাচিত হস্তক্ষেপের কথা। আপনি দয়া করে আর ভয় পাবেন না। রূপুসহ যে বা যারাই আপনার কাজে বাধা দিবে, তাদের ছুঁড়ে ফেলুন। জীবন, রায়হান, মামুনুলদের মত কাউকে আর খেলাবার মানেই হয় না।

যাদের নাম বললাম তাদের সাথে আমার ব্যক্তিগত কোন সমস্যা নেই এবং আমি জানি যে একজন খেলোয়াড়ের সীমাবদ্ধতা থাকতেই পারে যা আমি শ্রদ্ধা করি। সেই হিসেবে তুলনামূলক ভালো ফর্মে থাকা খেলোয়াড়ই খেলবে। কিন্তু রূপু আর কত দিন জীবনদের এই দর্শক সমর্থকদের কাছে খলনায়ক হিসেবে দাঁড় করাবে? জীবন এখন গোল করে ক্যামেরার সামনে এসে চুপ করবার ভঙ্গি করে মুখে আঙুল তুলে দেখালেই কি অতীতের অসংখ্য ম্যাচ যেখানে যোগ্য খেলোয়াড় বসে থাকতে তার ব্যর্থতায় দল জিততে জিততে ড্র করেছিল বা হেরে এসেছিল তা কি পোষাবে? কিংবা জীবনের ওই সম্ভাব্য এক গোলে যোগ্য কাউকে বসিয়ে রেখে তাকে পরের দশ ম্যাচে খেলিয়ে আবারও সমূহ বিপদ কেইবা ডেকে আনতে চাইবে? মাঝখানে ভূটানের বিপক্ষে এক ম্যাচ বাদ দিলে সিনিয়র ও অলিম্পিক দল মিলিয়ে জীবন তার শেষ ২২ ম্যাচে কোন গোল এমনকি এসিস্ট পর্যন্ত পায়নি। প্রায় শূন্য হেড ওয়ার্ক ও বাতিল বাম পায়ে তার দলগত খেলায় প্রভাব একেবারেই নিম্নমানের। অতএব কোন যুক্তিতেই জীবনের এখন একাদশ তো দূরের কথা, স্কোয়াডেই থাকার কথা না। মতিন বা সুফিলের একজন কে একাদশে রেখে মান্নাফ রাব্বির মত স্বপ্নের সাবস্টিটিউট দলে রাখুন।

২০১৭ সালে অনবদ্য এক অ-১৯ ব্যাচের আবির্ভাব হয়েছে আমাদের ফুটবলে। তারা এএফসি অ-১৯ বাছাইতে অসাধারণ খেলেছিল, অ-১৯ সাফে ভারতের বিপক্ষে ৩ গোলে পিছিয়ে ৪ গোল দিয়ে ম্যাচ জিতে নিয়েছিল। তাদের কয়েক জনকে নিয়ে গঠিত অলিম্পিক দল প্রথমবারের মত এশিয়ান গেমসের নক আউটে কোয়ালিফাই করতে ভূমিকা রেখেছিল। ভারতের মাটি থেকে মহাদেশীয় বাছাইয়ের খেলায় পয়েন্ট নিয়ে আসবার মত সক্ষমতা দেখিয়েছে তারা। কাতার, বুরুন্ডির বিপক্ষে হারলেও ক্ষুরধার খেলা দেখিয়েছে। তাদের ক্ষমতা আছে ১৯৮০ সালের পর প্রথমবারের মত দেশকে এশিয়া কাপে নিয়ে যাবার। এ জন্য আমাদের পরবর্তী ৩টি হোম ম্যাচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি এশিয়া কাপ বাছাইয়ের গ্রুপে সরাসরি কোয়ালিফাই করা সম্ভব নাও হয়, তবুও বাছাইয়ের গ্রুপে ঢোকবার জন্য যে প্লে অফ হবে তাতে সামর্থ্যের ভেতর প্রতিপক্ষ পেতে হলেও এসব ম্যাচ থেকে ভালো পয়েন্ট দরকার।

আমি জিততে চাই, জেমিও জিততে চায়। জিততে এবার হবেই এবং বাস্তবতার নিরিখে কার্যকর ফুটবল খেলেই। সুন্দর ফুটবল বা রূপুর দিকে তাকাবার সময় নেই!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা