বিদ্যানন্দ, আমরা কি আসলেই আপনাদের ডিজার্ভ করি?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
করোনা সংক্রমণের আতঙ্কে রক্তদাতা পাওয়া যাচ্ছে না, তাই বিদ্যানন্দ এখন বাসে করে ডোনারের বাসার সামনে গিয়ে রক্ত সংগ্রহ করে আনবে। রক্তদাতা যেমন ঝুঁকিমুক্ত থাকবেন, তেমনই সেই রক্তে বিপদমুক্ত হবেন প্রসূতি মা অথবা থ্যালাসেমিয়ার কোন রোগী...
এই করোনাকালে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন যা করছে, সেটাকে অসাধারণ বললেও কম হয়ে যাবে। কোটি কোটি টাকার ত্রাণসামগ্রী নিয়ে তো অসহায় মানুষের পাশে তারা দাঁড়িয়েছেই, এমনকি রাস্তার চারপেয়ে প্রাণীরাও বাদ যায়নি তাদের ভালোবাসার রাডার থেকে। এবার তারা নেমেছে ডোনারদের বাসায় গিয়ে রক্ত সংগ্রহের মিশনে, যেহেতু রক্ত দিতে বাইরে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ। একইসাথে আরেকটা চমৎকার কাজ করছে তারা, করোনায় আক্রান্ত হয়ে গৃহবন্দী অবস্থায় মানসিক যন্ত্রণা ও একাকীত্বে ভুগছেন যে মানুষগুলো, তাদেরকে গল্পের বই, পাজল গেইম, শব্দজট এবং মৌসুমি ফল পৌঁছে দিচ্ছে তারা, যাতে তাদের বিরক্তিকর প্রহর আর একাকীত্বের যন্ত্রণাটা একটু লাঘব হয়।
মহামারীতে বিপর্যস্ত জনজীবন। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত হচ্ছে সর্বক্ষেত্রেই। তবে তাতে তো আর রক্তের চাহিদা থেমে থাকবে না। এই দূর্যোগেও প্রতিদিন ডেলিভারি পেশেন্টের জন্য রক্তের দরকার হচ্ছে, তেমনি থ্যালাসেমিয়া রোগীরা আছেন অনিশ্চয়তায়। কারণ নির্দিষ্ট সময় পরপর তাদের রক্তের প্রয়োজন হয়। কিন্ত করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে অনেক ডোনারই রক্ত দেয়ার জন্য হাসপাতাল পর্যন্ত যাওয়াটাকে নিরাপদ ভাবছেন না। তাদের এই ভয়টাকে অমূলক বলারও কোন উপায় নেই। আর এতে করে বিপাকে পড়েছেন জরুরী অপারেশনের রোগী বা থ্যালাসেমিয়ার রোগীরা।
এই দুঃসময়ে রক্ত সংগ্রহে বিদ্যানন্দ টিমও পথে নেমেছে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্টের পাশাপাশি। রক্ত সংগ্রহ করা হবে 'হোম ডেলিভারি সিস্টেমে'! রক্ত দেয়ার জন্য ডোনারকে কোথাও যেতে হবে না। ডোনারের ঘরের দরজায় বিদ্যানন্দের বাস এসে ১০ মিনিটেই রক্ত সংগ্রহ করে নেবে। করোনা দূর্যোগে রক্ত সংগ্রহের পরিমাণ খুবই কম হওয়ায় বিদ্যানন্দের পক্ষ থেকে বিশেষ এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগ্রহী রক্তদাতারা নিজেদের প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে বিদ্যানন্দের ফেসবুক পেইজ বা অফিসের নাম্বারে যোগাযোগ করলেই ছুটে আসবে বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবীরা।
এটা যে কি চমৎকার একটা উদ্যোগ, সেটা শুনে বুঝতে পারবেন না অনেকেই। করোনার কারণে অনেক কিছুই আর আগের মতো নেই। এরমধ্যে একটা জিনিস হচ্ছে ব্লাড ডোনার ম্যানেজ করা। এভেইলেবল ব্লাড গ্রুপের ডোনারও পাওয়া যাচ্ছে না এখন, কারণ বাসা থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছেন অনেকে, পাছে করোনায় সংক্রমিত হয়ে যান! আর একারণেই রক্তদাতার সংখ্যা কমেছে, বেড়েছে বিপদাপন্ন রোগীদের ঝুঁকি। এভাবে ডোনারের বাসার সামনে গিয়ে দশ মিনিটের তার রক্ত সংগ্রহ করায় রক্তদাতার ঝুঁকিও থাকলো না, তার দেয়া সেই রক্তে বিপদের হাত থেকে বেঁচে যাবেন একজন প্রসূতি মা বা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগী।
আরও একটা চমৎকার কাজ করছে বিদ্যানন্দ। করোনায় দুর্গতদের পাশে তো তারা দাঁড়য়েছে শুরু থেকেই, করোনায় আক্রান্ত মানুষকেও খাবার পৌঁছে দিয়েছে। এখন তারা খেয়াল রাখছে করোনা রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও। বাসায় আইসোলেশনে থাকা রোগীদের সময়গুলো বড্ড বিরক্তিকরভাবে কাটে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, আত্মীয়রা তাদের চিনেন না, খবরও নেয় না বন্ধুরা। যেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে বিশাল কোন পাপ করে ফেলেছেন তারা!
তাদের বন্দী জীবন কাটে ছোট একটা রুম আর গ্রিলের ফাঁকে। নিঃসীম একাকীত্ব আর তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন এই মানুষগুলো। বিদ্যানন্দ তাদের খোঁজ নিয়েছে, তাদের জন্য উপহার নিয়ে গেছে। সেই উপহারের মধ্যে আছে গল্পের বই, মৌসুমি ফল, পাজল গেইম, শব্দজট, ইত্যাদি। অসুস্থতার এই প্রহরগুলোতে মানসিক অবসাদ যাতে রোগীর ওপর চেপে বসতে না পারে, মন খারাপের বিশাল পাহাড়ের নিচে মানুষটা যাতে হারিয়ে না যায়, সেদিকে কি চমৎকারভাবেই না লক্ষ্য রাখছে বিদ্যানন্দ! যাকে তার পরিবারের সদস্যরা ঠিকমতো দেখভাল করছে না, বন্ধুরা খোঁজ নিচ্ছে না, সেই মানুষটাকে আগলে রাখছে বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবকরা!
এই করোনাকালে বিদ্যানন্দের কাজের ফিরিস্তি দিতে বসলে সেটা শেষ হবে না। গণপরিবহণ বা হাসপাতাল জীবানুমুক্ত করা থেকে শুরু করে অসহায় মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়া, সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সাহায্য নিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোটি কোটি টাকার ত্রাণসামগ্রী পাঠানো, গরীব মানুষের জন্য ট্রাকভর্তি সবজি ও মৌসুমি ফলের ব্যবস্থা করা থেকে শুরু করে এই রক্তের ব্যবস্থা করা বা করোনা রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা- এতসব অবদান কি আমরা কখনও ভুলতে পারব?
ভুলে যাব বোধহয়। আমাদের মেমোরি তো গোল্ডফিশের মতো। এই দুঃসময় শেষ হলে আমরা এসব আর মনে রাখব না, করোনার দিনগুলিতে বিদ্যানন্দ কিভাবে মায়া আর ভালোবাসার অসীম ভাণ্ডার নিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, সেটা আমাদের মাথায় হয়তো থাকবে না। মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে, বিদ্যানন্দের মতো এমন চমৎকার একটা উদ্যোগ আমরা ডিজার্ভ করি তো? মন থেকে উত্তরটা বারবার 'না'বোধক হয়েই আসে কেন যেন!