সিএমপি'র সাহায্য নিয়ে, বিদ্যানন্দের অল্প ক'জন ভলান্টিয়ার মিলে বানিয়ে ফেলেছেন আস্ত একটা হাসপাতাল, সেখানে চিকিৎসা দেয়া হবে করোনা রোগীদের। এই করোনাকালে বিদ্যানন্দের প্যান্ডোরার বাক্স থেকে আর কত জাদু বেরোবে?

জায়গাটা ছিল কমিউনিটি সেন্টার। ধুমধাম আয়োজনে বিয়ে-বৌভাত অনুষ্ঠিত হতো এখানে, মহা আয়োজনে নতুন জীবনে পা রাখতেন নবদম্পতিরা। খাবারে গন্ধে ম ম করতো চারপাশ, বাজতো বাদ্য-বাজনা, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠতো বারংবার। সেই ভবনটাকেই আমূলে বদলে দিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে হাসপাতাল হিসেবে, সেই হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হবে, ডাক্তার নার্সরা লড়বেন সংকটাপন্ন রোগীদের মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য। আর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সহায়তায় হাসপাতাল বানানোর এই দুরূহ কাজটা সম্পন্ন করেছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন, ছোট কাঁধে বড় দায়িত্বের ভার তুলে সফলতার পথে হাঁটছে তারা। 

নিজেদের ফেসবুক পেজে কিছুদিন আগেই বিদ্যানন্দ সবার কাছে জানতে চেয়েছিল, একটা হাসপাতাল বানানোর কাজে হাত দিলে তাতে সবাই সাহায্য করবেন কিনা, যে হাসপাতালে বিনামূল্যে দরিদ্র রোগীদের সেবা দেয়া হবে। কমেন্টবক্সে অনেকেই সাড়া দিয়েছেন, বলেছেন বিদ্যানন্দকে এগিয়ে যেতে। করোনার গোটা সময়টা জুড়ে অসহায় মানুষের জন্য দারুণ অবদান রেখে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি এইটুকু ভরসা পেয়েই নেমে পড়েছিল কাজে। 

মিঃ হাইজিন: জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

ঢাকার বাইরে করোনা পরিস্থিতি বিবেচনা করলে চট্টগ্রামের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। বাণিজ্য নগরী হলেও, এখানকার স্বাস্থব্যবস্থা একেবারেই ভঙ্গুর, আইসিইউ তো দূরের কথা, করোনারোগীদের সেবা দেয়ার মতো পর্যাপ্ত হাসপাতালই নেই শহরে। বিদ্যানন্দ তাই ফিল্ড হাসপাতাল বানানোর জন্য বেছে নিয়েছে চট্টগ্রামকেই। বিদ্যানন্দের এই উদ্যোগের কথা শুনে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) এর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে তাদের সঙ্গে, এই মিশনে যথাযথ সহযোগীতার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। তাতে সাহস পেয়ে আরও জোরেশোরে কাজে নেমেছে বিদ্যানন্দ।

ফেসবুক পেজেই তারা পোস্ট দিয়ে খোঁজ নিয়েছেন, ফিল্ড হাসপাতাল বানানোর জন্য কেউ কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া দেবেন কিনা। তাতে সাড়া পাওয়া গেছে, জায়গাও ম্যানেজ হয়েছে অল্প সময়ের মধ্যেই। চট্টগ্রাম শহরের পতেঙ্গা নেভাল এলাকার বাটারফ্লাই পার্কের পাশে একটি কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া নিয়ে শুরু হয়েছে সেখানে অস্থায়ী হাসপাতাল বানানোর কাজ। ভবনটা যেহেতু কমিউনিটি সেন্টার ছিল, সেটাকে করোনা রোগীদের সেবা দেয়ার উপযোগী করে তুলতে দিনরাত এক করে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে বিদ্যানন্দের ভলান্টিয়ারদের, কিন্ত মানুষের সেবা করছেন, এই ভেবে হাসিমুখে অক্লান্ত শ্রম দিয়ে গেছেন সবাই। 

কাজটা কঠিন ছিল, ভীষণ কঠিন। কারণ এরকম কাজের অভিজ্ঞতা ভলান্টিয়ারদের ছিল না। এর আগে তারা ত্রাণ নিয়ে ছুটেছেন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে, ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন, করোনাকালে অনেকে রাস্তাঘাট কিংবা হাসপাতালে জীবাণুনাশক ছিটিয়েছেন, কিন্ত একটা কমিউনিটি সেন্টারকে আমূলে বদলে দিয়ে হাসপাতাল বানানো তো অন্যরকম চ্যালেঞ্জ। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মতো সেই কাজটাই তারা সুনিপুণভাবে করেছেন।

বিদ্যানন্দের ফিল্ড হাসপাতাল

বিদ্যানন্দের একাউন্টে ডোনেশন জমা পড়েছে হাসপাতালের জন্য, সেই টাকায় রোগীদের বেড এসেছে, ভবনে সংযুক্ত করা হয়েছে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা, যাতে অক্সিজেনের অভাবে একটা প্রাণও ঝরে না যায়। জলের মতো টাকা খরচ হয়েছে, বিদ্যানন্দ সেদিকে তাকায়নি একবারও। টাকা গেলে যাক, তবু যাতে রোগীরা চিকিৎসার অভাবে মারা না যায়। হয়তো সবার প্রাণ বাঁচানো সম্ভব না, কিন্ত পঞ্চাশ জন, একশো জন, যতটা সম্ভব, রোগীর জীবন বাঁচাতে চেয়েছেন তারা। হাসপাতালের সাইনবোর্ডে লেখা আছে- অর্থায়নে, বাংলাদেশের জনগন। সাধারণ মানুুুষের ডোনেশনের টাকায় যে এই হাসপাতাল বানানো হয়েছে, এখানে যে জনগনের অধিকার সবার ওপরে- সেটাই জানিয়ে দিতে চেয়েছে বিদ্যানন্দ। 

এর মাঝে একটা মজার ব্যপার ঘটেছে। হাসপাতালের কাজ শুরু হবার পর বিদ্যানন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করে এক শুভাকাঙ্ক্ষী বলেছিলেন, তিনি একটা অ্যাম্বুলেন্স কিনে দিতে চান। বিদ্যানন্দের সবাই তখন খানিকটা দোটানায় ছিলেন, আসলেই অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যাবে কিনা। কারণ ১৮-২০ লাখ টাকার একটা অ্যাম্বুলেন্স কেউ আবেগে পড়ে কিনে দেবে- এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কিন্ত সবার ধারণাকে ভুল প্রমাণীত করে বিদ্যানন্দের হাসপাতাল উদ্বোধন হবার আগেই সেই শুভাকাঙ্ক্ষী অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেই অ্যাম্বুলেন্স চট্টগ্রাম শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, করোনা রোগীদের বহন করে নিয়ে আসছে হাসপাতালে- দৃশ্যটা কল্পনা করতেই চোখে জল এসে গেছে বিদ্যানন্দের সবার।

চলে এসেছে শুভাকাঙ্ক্ষীর পাঠানো অ্যাম্বুলেন্স

জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই সেবা দেয়ার কাজ শুরু হবে এই হাসপাতালে। প্রথমে পঞ্চাশ বেড নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও, বিদ্যানন্দের পরিকল্পনা আছে এটাকে একশো বেডের হাসপাতালে উন্নীত করার। এখানে শুধু করোনা রোগীদেরই সেবা দেয়া হবে, দরিদ্র‍্য রোগীরা প্রাধান্য পাবেন, যাদের হাসপাতালে ভর্তি হবার টাকা নেই, হাজার হাজার টাকা বিল দেয়ার সামর্থ্য নেই। ঔষধ থেকে শুরু করে চিকিৎসা- সবটাই দেউয়া হবে বিনামূল্যে। ডাক্তার-নার্সদের বেতন, ঔষধের খরচ- সবকিছু বহন করবে বিদ্যানন্দ। এজন্য তারা ডোনেশনও চেয়েছেন, কেউ যদি নগদ টাকা দিতে না চান, তাহলে বিদ্যানন্দের এই হাসপাতালে ঔষধ পাঠিয়েও সাহায্য করতে পারেন। কি কি ঔষধ তারা নিচ্ছেন, সেগুলোর নামের তালিকা তাদের ফেসবুক পেজে দেয়া আছে। সেখানে সাহায্য করার মাধ্যমে বিদ্যানন্দের এই মিশনে শরীক হতে পারেন যে কেউই।

এই করোনাকালে বিদ্যানন্দের কাজের ফিরিস্তি দিতে বসলে সেটা শেষ হবে না। গণপরিবহণ বা হাসপাতাল জীবানুমুক্ত করা থেকে শুরু করে অসহায় মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়া, সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সাহায্য নিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোটি কোটি টাকার ত্রাণসামগ্রী পাঠানো, গরীব মানুষের জন্য ট্রাকভর্তি সবজি ও মৌসুমি ফলের ব্যবস্থা করা থেকে শুরু করে থ্যালাসেমিয়া রোগী বা গর্ভবতী নারীর অপারেশনের জন্য ডোনারের বাসায় গিয়ে রক্ত সংগ্রহ করা বা করোনা রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা- এতসব অবদান কি আমরা কখনও ভুলতে পারব? 

জানিনা, এই করোনাকালে বিদ্যানন্দের প্যান্ডোরার বাক্স থেকে আর কি কি ম্যাজিক বের হবে, আর কত চমক দেখাবে তারা। হাসপাতাল বানানোর প্রায় অসম্ভব কাজটাকে সম্ভব করে বিদ্যানন্দ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, ভালো কাজ করার ইচ্ছা থাকলে উপায় একটা বেরিয়ে আসেই, শুধু সাহস করে কাজে নেমে পড়তে হয়। বিদ্যানন্দের এই অসীম সাহসের কথা আমরা ভুলব না কোনদিন...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা