স্বেচ্ছাসেবক নয়, একদল অকুতোভয় যোদ্ধার কথা বলছি!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
এই পাঁচজন যদি আক্রান্ত হন তাহলে ওদের সরিয়ে দিয়ে পরের ব্যাচ সেই জায়গা দখল করবে, আসবেন নতুন পাঁচজন, তারা আক্রান্ত হলে এরপর আরেক ব্যাচ- এভাবেই চলবে কাজ!
ছবিতে যে পাঁচজন মানুষকে দেখতে পাচ্ছেন, এদেরকে অন্য সময় হলে ভলান্টিয়ার বা স্বেচ্ছাসেবক নামেই ডাকতাম। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে যারা আর্ত মানবতার ডাকে ছুটে আসে, অন্যের বিপদে বুক পেতে দেয়। কিন্ত এই মুহূর্তে তাদেরকে স্বেচ্ছাসেবক নামের ছোট্ট শব্দটায় বেঁধে রাখা সম্ভব নয় কোনভাবেই। এই মানুষগুলো যোদ্ধা, ভয়াবহ ভাইরাসের আতঙ্ককে অগ্রাহ্য করে তারা লড়ছেন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে, এতে যদি জীবন বিপন্নও হয়, তাতেও তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই- এমনই তাদের নিবেদন!
এরা বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে আহার তুলে দিয়েছেন, অসহায়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন, বছরের পর বছর ধরে কাজগুলো করে এসেছেন নিজেদের উজাড় করে দিয়ে। কিন্ত আজ থেকে এই পাঁচজনের কেউই আর বিদ্যানন্দে ফিরতে পারবেন না। কেন? কারণ এখন থেকে তারা কাজ করবেন ফ্রন্টলাইনে। করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে দ্রুত, বিদ্যানন্দ এই সময়টায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে সর্বশক্তি দিয়ে। বাইরের সব কাজ তদারকি করবেন এই পাঁচজন। এদের মাধ্যমে যাতে বিদ্যানন্দের অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকেরা আক্রান্ত না হন, একারণেই নেয়া হয়েছে এই সিদ্ধান্ত।
এই পাঁচজন যদি আক্রান্ত হন তাহলে ওদের সরিয়ে দিয়ে পরের ব্যাচ সেই জায়গা দখল করবে, আসবেন নতুন পাঁচজন, তারা আক্রান্ত হলে এরপর আরেক ব্যাচ। এভাবেই স্বেচ্ছাসেবকদের পাঠানো হচ্ছে সম্মুখ সমরে, অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে। কোটি কোটি টাকার ত্রাণ বিতরণ নির্ভর করছে এই স্বেচ্ছাসেবকের সুস্থতার উপর। ছোঁয়াচে রোগ হওয়ায় এবং হাসপাতালের বিভিন্ন সার্ভিসে তাঁরা যুক্ত থাকায়, স্বেচ্ছাসেবকদের রোগে সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আর সবাই যদি কোয়ান্টিনে চলে যায় তবে নষ্ট হবে পুরো কার্যক্রম। সেজন্যেই বুকে পাথর বেঁধে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে বিদ্যানন্দকে, স্বেচ্ছাসেবকরাও মেনে নিয়েছেন এই সিদ্ধান্ত।
কি অদ্ভুত একটা পরিস্থিতি, তাই না? যুদ্ধের সাথে মিল খুঁজে পাচ্ছেন? সেনাবাহিনীর একটা দল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তার জায়গা নিচ্ছে আরেকটা দল। প্রস্তুত রাখা হচ্ছে ব্যাকআপ টিম, সম্মুখ সমরে কেউ আহত/নিহত হলেই তার জায়গা নেবে আরেকজন! এরপরেও এই মানুষগুলোকে কি করে ভলান্টিয়ার বা স্বেচ্ছাসেবকের মতো ছোট্ট শব্দের বাঁধনে আটকে রাখবেন, বলুন?
মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে তারা কাজ করেছেন বিদ্যানন্দের হয়ে, কাজ করেছেন মানুষের জন্যে। যে সংগঠনের জন্যে এত কিছু করা, আজ থেকে সেখানে তারা যেতেই পারবেন না, যাতে তাদের মাধ্যমে কেউ আক্রান্ত না হয়। সিদ্ধান্তটা নিতে বেগ পেতে হয়েছে বিদ্যানন্দের কর্তৃপক্ষকে, মেনে নিতেও নিশ্চয়ই কষ্ট হয়েছে সবার। কিন্ত বাকীদের নিরাপদে রাখার জন্যে এটাকেই মেনে নিয়েছেন সবাই, সুস্থ থাকা, বেঁচে থাকাটা যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এখন, নইলে মানুষের সেবা হবে কি করে?
এই পাঁচটা মানুষের কথা ভাবুন, ভাবুন এদের পেছনে অন্যান্য ব্যাচে অপেক্ষমাণ থাকা আরও কিছু যোদ্ধার কথা। যারা জানেন, অদৃশ্য এক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে চলেছেন তারা, কোন অস্ত্র নেই, গায়ে শুধু সাধারণ মানের কিছু প্রোটেকশন জড়িয়ে নামছেন অসম এক যুদ্ধক্ষেত্রে। এখানে আক্রান্ত হওয়াটা সময়ের ব্যাপার, আক্রান্ত হলে চিকিৎসা ঠিক মতো পাওয়া যাবে কিনা, সেটাও কেউ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবে না। তবুও তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানবতার ডাকে সাড়া দিতে একবারের বেশি ভাবেননি।
এই মানুষগুলোকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জানাই। একদিন যুদ্ধটা থেমে যাবে, করোনার বিপক্ষে আমরা জিতে যাব। সামনে থেকে লড়াই করা এই যোদ্ধাদের কেউ কেউ হয়তো থাকবেন না আমাদের সাথে সেদিন, কেউ রোগে ভুগে সুস্থ হবেন, দাগ থেকে যাবে কোথাও। ইতিহাসে তাদের নাম হয়তো লেখা থাকবে না, এই কীর্তিগুলো দু'দিন পরে ভুলে যাবে সবাই। আমরা ভুলব না, দুর্যোগের দিনগুলোতে বিদ্যানন্দ আর তার যোদ্ধারা কিভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, কিভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল- সেই গল্পগুলো পরবর্তী প্রজন্মকে শুনিয়ে যাব আমরা...