ছিলেন পাকিস্তানী বাহিনীর চৌকস অফিসার। ছুটিতে দেশে এসেছিলেন, সেখান থেকে সরাসরি যুদ্ধে। মাত্র দেড়শো জন ইপিআর সৈন্য নিয়ে স্বাধীন করলেন সিলেটকে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের তাঁর বীরত্বের অনেক গল্পই আমাদের অজানা...

মুক্তিযুদ্ধে যারা সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের জন্যে আমার একটা আলাদা শ্রদ্ধার জায়গা বরাবরেই আছে। বোধ করি, বাংলাদেশকে যারা ভালোবাসেন, তারা প্রায় প্রত্যেকেই এই মানুষগুলোকে মন থেকেই শ্রদ্ধা করেন। যুদ্ধ হয়ে গিয়েছে আজ থেকে উনপঞ্চাশ বছর আগে। সময়ের নিয়মেই অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে আমরা হারাচ্ছি নিয়মিত। দেশের কোনো প্রান্তেই যখন কোনো মুক্তিযোদ্ধার প্রয়াণ সংবাদ শুনি, প্রবল শোক অনুভব করি। আজ যেমন প্রয়াত হলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল, বীরবিক্রম চিত্তরঞ্জন দত্ত, যাকে  সিআর দত্ত নামেই বেশি চেনেন বাংলাদেশিরা। তাঁর প্রয়াণ শুধুমাত্র প্রয়াণ হয়েই থেকে যায় না। ক্ষতির পরিমাণ হিসেব করতে বসলে যে ক্ষতির আসলে কোনো মাপজোক নেই। ইতিহাসের, বাংলাদেশের, মুক্তিযুদ্ধের এক জীবন্ত অংশেরই সমাপ্তি ঘটে গিয়েছে তাঁর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে।

তাঁর জন্ম ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি  আসামের শিলংয়ে। যদিও পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে। বাবা উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত ও লাবণ্য প্রভা দত্তের সন্তান চিত্ত রঞ্জনের ছোটবেলা কাটে শিলং এ। পড়াশোনা শুরু করেন শিলংয়ের লাবান গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে। অবশ্য এখানে বেশিদিন পড়াশোনা করা হয় না। বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে যখন ফিরে আসেন বাপের ভিটে হবিগঞ্জে, পুরো পরিবারকেও সেখানে আসতে হয় তখন। হবিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে ভর্তি হন বালক চিত্তরঞ্জন। এখান থেকেই মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর পড়াশোনা করতে যান কলকাতায়। কলকাতার বিখ্যাত আশুতোষ কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। সেখানের পড়াশোনা শেষ করার আগেই দেশভাগ। কলকাতা থেকে চলে আসেন খুলনায়। খুলনার দৌলতপুর কলেজের বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হন। এই কলেজ থেকেই বিএসসি পাশ করেন চিত্ত রঞ্জন দত্ত।

পড়াশোনার পাট চুকিয়ে যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। সেখানের শুরুটা বেশ ভালোই হয়। চৌকষ বাঙ্গালী অফিসার হিসেবে কৃতিত্বের ছাপ রাখেন সবখানেই। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের হয়ে অংশগ্রহণও করেন। পাকিস্তানের আসালংয়ে একটি কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন তিনি। তার কোম্পানি বেশ সাফল্য পায় এই যুদ্ধে। তাঁর অবদানে খুশি হয়ে পাকিস্তান সরকার তাকে পুরস্কৃতও করেছিলো তখন।

সব ঠিকঠাক থাকলে হয়তো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাই র‍্যাঙ্কের কোনো অফিসার হতে পারতেন। কিন্তু হুট করেই শুরু হয় ডামাডোল। ঠিক হুট করেও না। দানা তো বাঁধছিলো অনেকদিন ধরেই। ১৯৭১ সালে এসে তা মুখোমুখি বিরোধে রূপান্তরিত হয়। যুদ্ধের একেবারে প্রথমদিকেই সিআর দত্তের কিছু  অজানা গল্প আছে, যা আমরা অনেকেই জানিনা। আমরা সর্বোচ্চ জানি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেট অঞ্চলে যে ৪ নম্বর সেক্টর গঠন করা হয়, সেই সেক্টরের কমান্ডার হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন সিআর দত্ত। যুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন তিনি। সেজন্যে তিনি বীর উত্তম খেতাব পান। কিন্তু কী সেই কৃতিত্বপূর্ণ অবদান, তা কী আমরা জানি? ঠিক কী করেছিলেন তিনি, তা কী আমাদের জানা আছে? যুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশকে এগারোটি সেক্টরে ভাগ করার আগেরও তো কিছু সময় ছিলো। সে সময়ে তাঁর ভূমিকা কী ছিলো, তা কী আমাদের জানা আছে?

মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ছুটিতে হবিগঞ্জের বাড়িতে এসেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসেছেন খুব বেশিদিন হয়নি। অলস সময় কাটাচ্ছেন। এরমধ্যেই ২৬ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট। পুরো দেশের সামনে খসে পড়েছে পাকিস্তানিদের মুখোশ। পুরো দেশেই পঙ্গপালের মত ছড়িয়ে পড়ছে পাকিস্তানি আর্মি। সব দখল করে নিচ্ছে তারা। অপারেশন সার্চলাইটের পরেরদিন ২৭ মার্চ তারিখে আওয়ামী লীগের দুই নেতা মানিক চৌধুরী ও জেনারেল রব সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানীদের হাত থেকে সিলেট শহর দখল করবেন তারা। শুরু করবেন হবিগঞ্জ থেকে। সিলেট থেকে শুরু করে এরপর ছড়িয়ে পড়বেন পুরো দেশে। বলাই বাহুল্য, ততক্ষণে সিলেট শহর ছেয়ে গিয়েছে বুট, হেলমেট আর সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনীতে।

সিলেটকে মুক্ত করার প্ল্যান করা হলো। প্ল্যান করলেন জেনারেল রব। নেতৃত্বে রইলেন চিত্তরঞ্জন দত্ত। হবিগঞ্জ ট্রেজারি থেকে নিয়ে আসা রাইফেল, দেড়শোজন অসমসাহসী বাঙালী ইপিআর পুলিশকে সাথে নিয়ে চিত্তরঞ্জন দত্ত চললেন হবিগঞ্জ হয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে। পথে পথে মানুষ যোগ দিতে লাগলেন তাদের সাথে। যার সাথে যা আছে তা নিয়েই তারা মিছিলের সংখ্যা বাড়াতে লাগলেন। পাকিস্তানী আর্মির সাথে সম্মুখ যুদ্ধ হলো শেরপুর আর সাদীপুরে। সেসব জায়গাতে পাকিস্তানীদের দমন করে চিত্তরঞ্জনের নেতৃত্বে বাহিনী এগোতে লাগলো। শ্রীমঙ্গলে এসে তাঁর সাথে যোগ দিলেন শফিউল্লাহ বাহিনীর ক্যাপ্টেন আজিজ৷ একদিকে সি আর দত্ত, আরেকদিকে ক্যাপ্টেন আজিজ। তাঁরা দুইজন দুইপ্রান্ত দিয়ে শহরে ঢুকলেন। তাদের পেছনে কয়েকশো সেনা, পুলিশ, সহস্র সাধারণ মানুষ। সবাই সশস্ত্র। গুলি ছুটলো আতশবাজির মতন। পুরো শহর ত্রস্ত, সতর্ক, স্থানু। সবাই মিলে সিলেট শহর দখল করলেন তাঁরা। পাকিস্তানীরা তখন পিছু হটে আশ্র‍য় নিয়েছে এয়ারপোর্টে। সেখানে চার্জ করলেন ক্যাপ্টেন আজিজ। সিলেট পুরোপুরি পাকিস্তান-মুক্ত হলো সে রাতেই।

যুদ্ধের প্রথমদিকে পাকিস্তানিদের এই মরন-কামড় দেয়ার নেতৃত্বের কাজটা বেশ ভালোভাবেই সামলেছিলেন সিআর দত্ত। এই ঘটনা পাকিস্তানিদের মনোবলেও খানিকটা ফাটল ধরিয়েছিলো। যদিও এর কিছুদিন পরে পাকিস্তানীরা আবার দখল করে সিলেটকে। পাকিস্তানীরা যখন দখল করছে সিলেটকে, তখন সিআর দত্ত ভারতের শিলচরে। ভারতীয় বাহিনীর কাছ থেকে অস্ত্র আনতে গিয়েছেন। ক্যাপ্টেন আজিজ একা ছিলেন। অতর্কিতে হামলা চালিয়ে পাকিস্তানিরা দখল করে নিয়েছিলো সিলেটকে।

এর কিছুদিন পরেই এগারোটি সেক্টরে ভাগ করা হয় বাংলাদেশকে। সিলেট জেলার পূর্বদিকের খোয়াই শায়েস্তাগঞ্জ রেললাইন বাদে পূর্ব ও উত্তরদিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় ৪ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরে কমান্ডারের দায়িত্বে পালন করেন তিনি। সেক্টর কমান্ডার হওয়ার পরেই প্রথমে তিনি সিলেটের রশিদপুরে ক্যাম্প তৈরি করেন। চা বাগানের আড়ালে এই ক্যাম্প ক্যামোফ্লেজের মত কাজ করে। অজস্র পাকিস্তানীদের ঘায়েল করেন তাঁরা এই ক্যাম্প থেকেই। এরপর তিনি মৌলভীবাজারেও ক্যাম্প স্থাপন করেন। যুদ্ধের শেষভাগ পর্যন্ত সিআর দত্ত ও তার বাহিনীর তৎপরতা বজায় থাকে। যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্যে তাকে 'বীরউত্তম' উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

যুদ্ধের পরে তিনি সেনাবাহিনীর রংপুর ব্রিগেড কমান্ডার হিসাবে নিযুক্ত হন। এরপর তিনি বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী গঠনের কাজে নিয়োজিত হন। বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) গঠনের পর তিনি বিডিআর এর প্রথম মহাপরিচালকও ছিলেন। বিডিআর থেকে অবসর গ্রহণ করার পর তিনি যুক্ত হন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন- বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদও।

সিআর দত্তের যুদ্ধকালীন অবদানের পরিধি শুধুমাত্র কাগজে কলমে অথবা ঢাকার কাঁটাবন থেকে কারওয়ান বাজার সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কের নামকরনেই শেষ হয়ে যাবেনা মোটেও। প্রখ্যাত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর বিখ্যাত বই 'হাজার চুরাশির মা' বইয়ে এরকম একটি লাইন ছিলো- বিপ্লবীরা মারা গেলেও তাদের হৃদয়ের আগুন মারা যায় না। সে আগুন স্থানান্তরিত হয় এক হৃদয় থেকে আরেক হৃদয়ে।

বীরউত্তম সিআর দত্তের সেই বিপ্লবী সত্তা যেন আমরা ধারণ করতে পারি, সে সাথে ভালোবাসতে পারি যেন নিজেদের দেশকে, সেটিই আমাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। তাহলেই ভালো থাকবে দেশ, বাংলাদেশ।

বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি রইলো, কমান্ডার।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা