বিথী রানীর পোড়া শাড়ি, তানিয়ার পোড়া বই অথবা হাজারো পোড়া কপালের গল্প
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বস্তিতেই কেন বারবার আগুন লাগে, নাকি লাগানো হয়- এর চাইতে অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং টপিক হচ্ছে সাকিব আল হাসানের তথাকথিত পূজা উদ্বোধন করতে যাওয়ার ভুয়া খবর, চলুন, সেটা নিয়েই নাহয় তর্ক করি...
আরও একবার আগুনে পুড়েছে শত শত মানুষের ঘর, পুড়েছে অসহায় মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই, শেষ সম্বল, পুড়েছে সঞ্চয়, পুড়েছে স্বপ্ন। মহাখালীর সাততালা বস্তিতে আগুন লেগেছিল গতকাল রাতে। ফায়ার সার্ভিসের চেষ্টায় সেই আগুন তো নিভেছে, কিন্ত ঘরবাড়ি হারানো মানুষগুলোর ঠাঁই মেলেনি কোথাও। ছবিতে যে মহিলাকে দেখেছেন, তার নাম বিথি রানী। তিনি আগুনে পুড়ে যাওয়া ধ্বংস্তুপের ভেতর থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন ব্যবহারের উপযোগী কিছু খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। খুঁজে পেয়েছেন নিজের দুই মাস আগে কেনা বিয়ের বেনারসি শাড়িটা। তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিনের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে থাকা সেই শাড়িটা পুড়ে গেছে, তার ঘরের মতো, তার কপালের মতো।
আপনাদেরকে একটা মজার হিসেব দেই। ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালের দেশজুড়ে মোট ১৬৫ বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে শুধু ঢাকায়ই ৩৩ বার বস্তিতে আগুন লাগে। ২০১৯ সালের প্রথম মাসেই ২৪বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছিল বিভিন্ন বস্তিতে। এসব আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়েছে শত শত কোটি টাকা। প্রতিটা ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে সেসবের রিপোর্ট কোথায় কেউ জানে না, আগুন লাগার পেছনে কারো হাত ছিল কিনা সেটাও অজানা থেকে যায় প্রতিবার। আগুন নিভে গেলে বস্তিবাসীর কাছে পরনের কাপড়টা ছাড়া কিছুই থাকে না, সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যায় শুধু কয়েক বেলার খাবারের চাল-ডাল, কখনও মাথাপিছু হাজারখানেক করে নগদ টাকা, আর সাহায্যের মিথ্যে আশ্বাস।
জানিয়ে রাখি, গত ১০ বছরে শুধু কড়াইল বস্তিতেই আগুন লেগেছে ১৭ বার! কখনও কি মনের মধ্যে প্রশ্ন জেগেছে, কেন বারবার বস্তিতেই আগুন লাগে? আর এই আগুন লাগার ঘটনাগুলো কেন রাতের বেলাতেই ঘটে? না জাগাটাই স্বাভাবিক। বাঙালি যে পরিমাণ ইস্যুপ্রিয় জাতি, ইস্যুর স্রোতে বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনা চাপা পড়বে- এটাই এখানে নিয়তি। বস্তির আগুনের চাইতে আমাদের কাছে অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং টপিক হচ্ছে সাকিব আল হাসানের তথাকথিত পূজা উদ্বোধন করতে যাওয়ার ভুয়া খবর, সেসব নিয়ে মাতামাতি করাতেই আমাদের আগ্রহ। বস্তিতে কি হলো, কে আগুনে পুড়ে মরলো- এসব নিয়ে ভাবার কি আছে?
বাংলা সিনেমায় ভিলেন মিশা সওদাগর জিপ গাড়িতে চড়ে দলবল নিয়ে এসে বস্তি উচ্ছেদের চেষ্টা করতেন। কখনও সফল হতেন, কখনও আবার নায়কের হাতে পিটুনি খেয়ে পালাতেন। বাস্তবে তো আর এমন খুল্লাম-খুল্লা মামদোবাজি করা সম্ভব নয়, করতে হয় একটু রেখেঢেকে, তাই বস্তি উচ্ছেদ করার সহজ রাস্তা হচ্ছে আগুন লাগিয়ে গোটা জায়গাটাকেই ছাই বানিয়ে ফেলা। সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙলো না। বলছি না যে প্রতিটা বস্তিতে আগুনের ঘটনার পেছনে একই কারন থাকে, কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, বেশিরভাগ বস্তিতে আগুন লাগানো হয় সেই জায়গা থেকে বস্তি উচ্ছেদ করার জন্য।
রূপনগর, কড়াইল, সাততালা সহ ঢাকা শহরে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় একশ বস্তি আছে। এটা সিটি কর্পোরেশনের হিসেব। রেলওয়ের জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে ৭০টা বস্তি। অন্যান্য বস্তিও সরকারী জায়গা বা খাসজমির ওপরে গড়ে ওঠা। এসব বস্তিতে প্রায় আশি লাখ থেকে এক কোটি মানুষ বাস করেন। অর্থাৎ ঢাকা শহরের প্রায় অর্ধেক মানুষের বাস এসব বস্তিতে। গত চার বছরের মধ্যে ছোট আকারের অন্তত দশটি বস্তি হারিয়ে গেছে মানচিত্র থেকে। খোঁজ নিলে দেখবেন, স্থানীয় প্রভাবশালীরা সেই জায়গাটা দখল করে নতুন কোন ব্যবসা খুলে বসেছে, অথবা ভীষণ ক্ষমতাধর কেউ সেই জায়গায় আকাশচুম্বী ভবন অথবা মার্কেট বানাচ্ছে।
বস্তিতে আগুন লাগলে লাভ কাদের? এটা খুব জটিল একটা প্রশ্ন। ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটা বস্তিতেই আধিপত্য নিয়ন্ত্রণের বড়সড় কিছু সমীকরণ আছে, ব্যবসার হিসেব-নিকেশ আছে, আছে প্রভাব বিস্তারের মারপ্যাঁচও। একটু আগেই যে বললাম, স্থানীয় বা জাতীয়ভাবে প্রভাবশালীরা তো বস্তি উচ্ছেদের সঙ্গে জড়িত থাকেনই, অনেক সময় পুরনো বস্তি ভেঙে নতুন বস্তি বানানোর জন্যেও আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় সব কিছু। নতুন ঘর ওঠে, দোকান বসে, ভাড়ার অঙ্কটা বাড়ে, সিকিউরিটি মানি নেয়া হয় নতুন করে- দরকার শুধু জায়গামতো আগুনটা লাগিয়ে দেয়া। ভালোভাবে সরে যেতে বললে তো কেউ সরবে না, হাঙ্গামা করবে, তাহলে আগুন না লাগিয়ে আর উপায় কী!
বস্তিতে বাস করা এই লোকগুলো যে ফেরেশতা, এমনটাও না। আপনি তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করুন, ফ্ল্যাট বানিয়ে দিন, দেখবেন তারা সেই ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে নিজেরা আবার বস্তিতেই ফিরে এসেছে। কারন টাইলস করা ফ্ল্যাটে থাকার চেয়ে সেটা ভাড়া দিয়ে নগদ দশ হাজার টাকা কামানোটা তাদের কাছে বেশি যুক্তিযুক্ত। এই রাষ্ট্র তাদের আয়ের ব্যবস্থা করতে পারেনি, চাকরির যোগান দিতে পারেনি, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকায় তারা শিক্ষার অধিকার থেকেও হয়েছে বঞ্চিত- তাদের কাছে টাকার মূল্যটা অনেক বেশি, যেটা হয়তো আমার-আপনার কল্পনার বাইরে। আর তাই আমরা যখন আগের বছরের জ্যাকেটটা এই শীতে গায়ে জড়াতে অস্বীকৃতি জানাই, তখন এই ভদ্রমহিলাকে পোড়া শাড়িটা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে হয়।
আগুনে ঘরপোড়া বিথি রানীর ছবিটা দেখে মন খারাপ হতে পারে, মন খারাপ করবেন না প্লিজ। এগুলো সাময়িক আবেগ, দৃষ্টিভ্রম। নিউজফিড স্ক্রল করতে থাকুন, মাথা ঘামানোর অনেক ইস্যু পেয়ে যাবেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে হুমকি দেয়ায় নাকি সিঙ্গাপুর থেকে পনেরোজন বাংলাদেশীকে বহিস্কার করা হয়েছে। বস্তিতে কেন আগুন লাগলো, কেন আগুন লাগে, সেসব ভাবার চেয়ে সিঙ্গাপুরকে বয়কটের ডাক দেয়াটা বরং ভালো। বিশ্বাস করুন, এই মানুষগুলো, এই আগুন, ঘর পুড়ে যাওয়া, কিংবা বিথি রানী- এরা সবাই আমার কাছেও শুধুমাত্র একটা টপিক। লেখাটা শেষ হলেই আমি তাদের কথা ভুলে যাব, আগামীকালের জন্য আমাকে অন্য বিষয় খুঁজতে হবে, সেটা নিয়ে জানতে হবে, বস্তির আগুন নিয়ে পড়ে থাকার সময় আমারও নেই।
আমরা খবরে পড়ি, অমুক বস্তিতে আগুন লেগেছে, টিভিতে ব্রেকিং নিউজ পাই, বস্তির আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কিন্ত যে মানুষগুলো মাথা গোঁজার ঠাঁই হারালো, তাদের জীবন কি নিয়ন্ত্রণে আসে কখনও? সেই খবর তো কেউ দেয় না। এই রাষ্ট্রে গরীব হয়ে জন্মানোটা পাপ, বস্তিতে থাকাটা অভিশাপ; আপনি যদি সেই পাপে পাপী হয়ে না থাকেন, এই অভিশপ্ত জীবন যদি আপনার না হয়, তাহলে আপনি বরং এসব খবর থেকে দূরেই থাকুন। শুধু মনে রাখবেন, নগর পুড়লে দেবালয় রক্ষা পায় না, অল ইজ ওয়েল বলে বালিতে মুখ গুঁজে রাখলেই প্রলয় থামানো যায় না...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন