বাংলাদেশে 'বিয়ের বাজার' বলে একটা অসভ্য কথা চালু আছে। সেই বিয়ের বাজারে কালো বা শ্যামলা মেয়ের অবস্থান তালিকার একেবারে নিচে। এই মেয়েদের কেউ বিবাহ করতে চায় না। বউ বা ছেলের বউ হিসেবে চায় না।
পরশু রাতে এক মেয়ে আমাকে ইনবক্স করেছে। টাইম দেখলাম, ভোর সাড়ে চারটার দিকে। আদারবক্সে ছিল, আজ চেক করে পেলাম। ম্যাসেজটা বিশাল। যার সারসংক্ষেপ হল- কালো বলে এই মেয়েকে বাবা-মা-বোন-ভাই-প্রতিবেশী-বন্ধু-আত্মীয়; প্রায় সবাই যা তা বলে। এতদিন তার মন খারাপই লাগতো শুধু। এখন বাড়িতে বিয়ের আলোচনা চলছে। তাই ঘটনা অপমানের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এমনকি পরশু সেহেরির টেবিলে বসেও তার মা তাকে এত অপমান করেছে যে মেয়ে সেহেরি না খেয়েই ঘরে চলে গেছে। তারপরই আমাকে ইনবক্স করেছে। কারণ তার মরে যেতে ইচ্ছা করছিল।
ম্যাসেজ রিকু এক্সেপ্ট করে আমি আগে নিশ্চিত হলাম সে ঠিক আছে কি না। উত্তর পেলাম। নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে যা লেখার লিখেছি। মেয়ে এখন কিছুটা শান্ত। ঢাকায় আসলে সে দেখা করবে আমার সাথে।
তো, এই রকম ম্যাসেজ এর আগেও পেয়েছি। বহুবারই পেয়েছি। শুধু তাই না, নিজের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবের জীবনেও একই জিনিস দেখেছি। কালো রঙের জন্য দুর্বিষহ অপমান, তুচ্ছতাচ্ছিল্য।
বাংলাদেশের পুরুষদের লেখা কবিতায় যে নারীরা থাকেন, সেই কবিতার নায়িকারা বেশিরভাগই কালো বা শ্যামবর্ণা হন। কিন্তু বাস্তবজীবনে এই পুরুষরা যাকে বিয়ে করেন, তিনি সাদা হন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে। অন্তত কালো তো হনই না। বউদের যতটা সম্ভব সাদা হওয়া লাগে। সাদা মেয়ে না পেলে বাংলার পুরুষরা খুশি মনে বিবাহ করেন না।
বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শাশুড়িরা ছেলের বউ খুঁজতে গেলে ফর্সা রঙ খুঁজেন। নিজের ছেলের রঙ ভাত রান্নার পাতিলের তলার চেয়ে কালো হলে আরো বেশি করে ফর্সা খুঁজেন। এর দুটা কারণ আছে।
এক, ছেলের বউ একটা সম্পত্তির মতো। পাড়া প্রতিবেশি আত্মীয়দের দেখাতে হয়। ফর্সা রঙের বউ তাদের মর্যাদা বাড়ায়। আর দুই, ফর্সা বউয়ের পেট থেকে ফর্সা বাচ্চা বেরুবে বলে তারা মনে করে।
তো, ফর্সা রঙের প্রতি এই ঔপেনিবেশিক টান বাঙালির সহজে ঘুচবে না জানি। কিন্তু এই টানের কারণে যখন কোন মেয়েকে অপমান করা হয়, ছোট করা হয়, তুচ্ছ করা হয়- তখন সেটা রীতিমত অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের জায়গায় চলে যায়।
আমি আমার এই জীবনে বহুবার গায়ের রঙের জন্য নানা ধরণের কথা শুনেছি। ইঙ্গিত পেয়েছি। ছোটবেলায় এসব শুনলে মন খারাপ লাগতো। নানা রকম কমপ্লেক্স তৈরি হতো মনে। বড় হয়ে যখন বেয়াদপ হতে শিখলাম, তখন বুঝলাম, মুখ বুজে কোনো তুচ্ছাতাচ্ছিল্যই মেনে নিতে নাই। তাই কেউ যখনই রঙ নিয়ে, চেহারা নিয়ে কিছু বলেছে, মুখের উপর জবাবটাও দিতে শিখে গেছি।
রেসিজম সব দেশেই আছে। কিন্তু গায়ের রঙ দিয়ে মেয়েদের মাপঝোকের এই হিসেব সবচেয়ে বেশি আছে এই উপমহাদেশে। এখানে ফর্সা রঙকে সৌন্দর্যের মৌলিক উপাদান ধরা হয়। সেটা যারা ধরে নেয়, তাদের নিয়া আমার কিছু বলার নাই, কারণ এটা যার যার অভিরুচির বিষয়। কিন্তু যখন রঙের প্রতি কোনো জাতির দুর্বলতা এতটাই বৈকল্যের পর্যায়ের পৌঁছে যায় যে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে তার শরীরের চামড়ার রঙের জন্য নিজের পরিবার কথা শোনায়, প্রতিবেশি আত্মীয়রা অপমান করে আর বন্ধুরা টিজ করে, তখন সেটা রীতিমত কুৎসিত একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
আমার ব্যাক্তিগতভাবে শ্যামরঙের মানুষ ভাল লাগে। ফর্সাও ভাল লাগে। কাকে কেন ভাল লাগে, তা আমি জানি না। শুধু এটুকু জানি, কেউ ফর্সা বলেই তাকে আমার ভাল লাগছে, কিংবা শ্যামলা বলে ভাল্লাগছে, বিষয়টা এত সস্তা না। একটা মানুষের অনেক কিছু মিলিয়েই তার বাহ্যিক রূপটা দাঁড়ায়। এই অনেক কিছুর মধ্যে থাকে তার ব্যক্তিত্ব, আচরণ, ব্যবহার, কথা বলা, শিক্ষা, সততা। কারো কারো শুধু শরীরের গড়ন আর মুখ চোখ দেখেও ভাল লাগে। কিন্তু কথা বলা বা মেশার পরই হুট করে সেই ভাল লাগা উবে যায় অনেক সময়। এর কারণ, যে সৌন্দর্য শুধু বাহ্যিক রূপে, তার স্থায়ীত্ব অত্যন্ত কম। মানবিক সৌন্দর্যই প্রকৃতপক্ষে স্থায়ী ইমেজ তৈরি করে। সৌন্দর্যটির প্রতি আস্থা আর বিশ্বাস জাগায়। মানে সেটা যে আসলেই সুন্দর, সেই বার্তাটা দেয়।
বাংলাদেশে 'বিয়ের বাজার' বলে একটা অসভ্য কথা চালু আছে। সেই বিয়ের বাজারে কালো বা শ্যামলা মেয়ের অবস্থান তালিকার একেবারে নিচে। এই মেয়েদের কেউ বিবাহ করতে চায় না। বউ বা ছেলের বউ হিসেবে চায় না। তবে যথেষ্ট পরিমান অর্থকড়ি খরচ করতে পারলে বাপ-মায়ের পক্ষে এদের জন্য জামাই কিনে আনা সম্ভব হয়। ফর্সা চামড়ার জন্য ব্যাকুল-আকুল পুরুষরা তখন এক বগলে টাকা আর অন্য বগলে কালো বউ নিয়ে বাড়ি যেতে রাজি হয়। বাবা-মা'র এই জামাই কেনা খরচ থেকে বাঁচাতে মেয়ে তাই পার্লারে গিয়ে পার্ল ফেশিয়াল করে, ফেয়ার এন্ড লাভলি মাখে, দুধের সর ঘষে, হলুদ দিয়ে মুখ হলুদ করে। কিন্তু ঘটনা তো মেলানিনে। তাই এসবে আদতে ফর্সা হওয়া যায় না। কন্যার দুঃখের দিনও শেষ হয় না।
যখন সারা পৃথিবীতে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির দৌড়ে ধুন্ধুমার মার মার কাট কাট চলছে, মানুষ কই থেকে কই চলে যাচ্ছে, নারী পুরুষ পার্থক্যের রেখা সরু হতে হতে মিলিয়ে যাওয়ার পথে, তখন এই বাংলাদেশের ঢাকা শহরে বসে এক মেয়ে সেহেরির সময় কান্না করছে, কারণ তার মা তাকে অপমান করেছে, কারণ কালো রঙের জন্য তার বিয়ের সম্মন্ধ একের পর এক ভেঙে যাচ্ছে।
বিয়ে যখন 'বিয়ের বাজার', তখন এসবই হওয়ার কথা। বিয়ে যখন পণ্য বেচাকেনা, তখন এসবই হওয়ার কথা। বিয়ে যখন টিপেটুপে ঘরে দাসি নিয়ে আসা, তখন এসবই হওয়ার কথা।
তাই সবার আগে বিয়ের বাজার নামের অশ্লীলতাটা বন্ধ করা অতীব জরুরি। আর তারপর? তারপর এই ফেয়ার এন্ড লাভলি নামের অশ্লীল ক্রীমটা বড় সাইজের সাপোজিটরি ক্যাপসুলে ভরে এই পুরা জাতির গুহ্যদ্বারে তিনবেলা নিয়ম করে ঢুকানো বাধ্যতামূলক- এই মর্মে একখানা আইন পাশ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প দেখি না। আপনারা যদি দেখেন, আমাকে জানাবেন। এডিট করে সংযুক্ত করে দিব এই বেলা।