ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর: বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
'ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর' শুনলেই হয়তো আমাদের চোখে ভেসে উঠে জর্ডানের গৃহযুদ্ধের কথা, জর্ডানের ফিলিস্তিনি অধিবাসীদের সাথে সম্রাট হুসেনের নেতৃত্বে সশস্ত্রবাহিনীর এক রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের গল্প। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের ফুটবল পাড়াতেও একটি কলঙ্কময় 'ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর'-এর তকমা লেগে আছে। যে কালো অধ্যায়ের গল্প আজও এর প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীরা শোনাতে ভীষণ ভয় পায়, অস্বস্তিতে ভোগে। এজন্য প্রতিদিনকার ফুটবল চর্চায় এমন দিনের আলোচনাটি ক্রমশঃ ফুরিয়ে গেছে।
ইদানীং ফুটবল নিয়ে হাহাকার প্রচন্ড। খা খা দর্শকশূন্য মাঠে বছরের পর বছর জৌলুশহীন পেশাদার ফুটবলের দেখা মিলছে। পাশাপাশি ফুটবলকেন্দ্রিক কাঠামো আজ কেবল ধ্বংসস্তুপই, অবশ্য ফুটবলপ্রেমী বাঙালিরা যে ফিনিক্স পাখির আশায় বসে আছে একথা তো বলাই বাহুল্য। তবে একথা আমরা প্রত্যেকেই জানি, এমন সংকট ও দৈন্যতা সবসময় ছিল না।
আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথের অসংখ্য গল্প আমরা শুনেছি বাবা মায়ের মুখেই, সেই গল্পগুলোর কোনো কোনো দিনে কালিমাও লেগে আছে, তেমনই এক দিনের কথা আজ বলি।
১৯৮২ সালে ফিরে যাওয়া হোক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ চলছে। মার্চেই ক্ষমতা দখল করেছে হুসেন মুহম্মদ এরশাদ। দেশে মার্শাল-ল জারি হয়ে গেছে। ফুটবলেও এর প্রভাবটা পড়েছিলো একটু অন্যভাবে। দিনটি ছিল ২১শে সেপ্টেম্বর, তবে অন্যদিনের মতো সাধারণ কোনো দিন নয়। কেননা সেদিন যে ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম) চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী ও মোহামেডানের ম্যাচ ছিল। এটি ছিল লীগে তাদের শেষ লড়াই। সকাল হতেই ঠাসা মাঠ, দু-দলের সমর্থকদের গর্জনগুলো হয়ে উঠছিলো গগণবিদারী। আবাহনী তখন গাজী সালাউদ্দিন, আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু, গোলাম রাব্বামী হেলালের সাথে বিদেশী পাকীর আলি, আশোকার ম্যাজিকে উড়ছে।
কিন্তু ম্যাচ শুরু হলে মোহামেডানই প্রথম লিডটা নেয়। ১-০ স্কোরলাইনে খেলা এগিয়ে যাচ্ছিলো, উত্তেজনার পারদও তখন আকাশচুম্বী। ম্যাচের শেষ বাঁশির মিনিট দশেক আগে আবাহনীর অধিনায়ক কাজী আনোয়ারের নেয়া জোড়ালো শট মোহামেডানের গোলকিপার মহসিন বেশ দক্ষতায় ফিরিয়ে দেন। তবে পরক্ষণেই আবাহনী ফুটবলাররা দাবী করে বসলো বলটি গোল লাইন অতিক্রম করেছে। রেফারি এই দাবী মানলেন না।
উত্তেজনা ও চাপ সইতে না পেরে কয়েকজন আবাহনী ফুটবলার মারতে উদ্ধত হলেন রেফারিকে। মাঠের সবুজ ঘাসের লড়াইয়ের বাতাস তখন গ্যালারিতেও, সমর্থকদের মুখোমুখি সংঘর্ষ ও আনুষাঙ্গিক ক্ষোভে পুরো স্টেডিয়াম পাড়া রণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে উঠলো মুহুর্তেই৷ পরিস্থিতি সামলাতে লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেলের নিক্ষেপের বাইরে পুলিশের আর করণীয় বা কী ছিল। আহতের সংখ্যা অনেক। তাও অনেক বিপত্তি পেরিয়ে মাঠের পরিস্থিতি নাহয় নিয়ন্ত্রণে এলো, কিন্তু ঘটনার রেশ তখনো ফুরোয়নি।
এই ঘটনার জের ধরে রাতেই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের হোস্টেল ও স্ব স্ব বাড়ি থেকে বেশ কয়েকজন দেশি খেলোয়াড়, আবাহনী ক্লাব থেকে তিন বিদেশি খেলোয়াড়কে গ্রেফতার করে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হয়৷ কিংবদন্তি খেলোয়াড় চুন্নুর ভাষায় পরে সেখান থেকে তাদের রমনা থানায় নিয়ে গিয়ে ওসির রুমে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়।
পরে শাহবাগে পুলিশ কন্ট্রোলে নিয়ে যাওয়া হলে চুন্নুরা দেখতে পান গোটা পঞ্চাশেক আবাহনী সমর্থককেও পুলিশ ধরে এনেছে। বুঝতে বাকি রইলো না, তাদের গ্রেফতারের খবর রটে যাওয়ায় বাইরে কী চলছে! ভয়াবহ মার্শাল-ল এর কঠিন পরিস্থিতিতে বাঁচার তো উপায় নেই, এর মধ্যে আবার রেফারিকে লাঞ্চনা, সরকারি ও জন সম্পদ নষ্ট- এসবের মতো গুরুতর সব অভিযোগ আনা হলো। শ্রীলংকান দূতাবাসের সহায়তায় দুই বিদেশী তারকা পাকীর আলী ও অশোকা ছাড়া পান, কয়েকজনকে অর্থদন্ড ও মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। বাকিদের প্রেরণ করা হয় আদালতে!
হাতকড়া পড়া মিন্টো রোডের মার্শাল কোর্টের কাঠগড়ায় গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছে দেশসেরা ও আজকের বিবেচনায় কিংবদন্তী সব ফুটবলাররা। রেফারি আবদুল আজিজ অভিযোগকারী ও সাক্ষী হিসেবে দাঁড়াতেই 'হত্যা চেষ্টার' অভিযোগ আনে তাদের বিরুদ্ধে। একে একে অধিনায়ক কাজী আনোয়ারকে এক বছর, হেলালকে ছয় মাস এবং সালাউদ্দিন ও চুন্নুকে এক মাসের জেল দেয়া হয়। বাকিদের বেকুসুর খালাস।
হতাশা ও লজ্জায় নিমজ্জিত এই চারজন শাস্তির খবর শোনার পর বেদনার কান্নায় ভেসে যান। হাতকড়া পড়িয়ে তাদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে অবশ্য খবর আসে, নিরাপত্তাহেতু তাদের ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়া হবে। চুন্নু ও সালাউদ্দিন যশোর এবং আনোয়ার ও হেলালের গন্তব্য হবে রাজশাহীর কেন্দ্রীয় কারাগার।
আজকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার দামামা না থাকলেও, ঢাকা শহরজুড়ে এই খবর ছড়িয়ে গেল। প্রাণের প্রিয় ফুটবলারদের পাশে দাঁড়াতে হাজার হাজার লোক নেমে এলো রাস্তায়। এক ভারাক্রান্ত রাতের সূচনাই যেন হলো ঢাকার রাজপথে, পুরো কমলাপুর ষ্টেশনে বেদনার অশ্রুতে একাকার হয়ে যাচ্ছে সমর্থকরা। পরদিন তাদের চারজনের সারিবদ্ধভাবে বসে হাতকড়া পড়া অবস্থায় একটি ছবি দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হলে দেশজুড়ে তা আলোড়ন তৈরি হয়।
আজও সেদিনের ঘটনার সাথে শুধু ফুটবলের ন্যায্য গোল বাতিলের প্রতিবাদ নয়, বরং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বিদঘুটে আভাস পাওয়া যায়। ওই ম্যাচে মোহামেডানকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়, এবং তারা লীগও জিতে নেয়। অভিযোগ আছে ফুটবল ফেডারেশনে কিছু কর্মকর্তার হিংসা ও সংকীর্ণতায় পর্যবসিত হয়ে তাদের গ্রেফতার করার ইন্ধন দিয়েছিলেন এরশাদকে।
সতেরো দিন পরেই জনতার প্রতিবাদ ও নানামুখী চাপে ক্ষমতাবলে সাধারণ ক্ষমা দেখিয়ে তাঁদের ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলো এরশাদ। তারপরেও সেদিনের তীব্র কষ্টের অনুভূতি আজকের দিনেও স্পর্শ করে সালাউদ্দিন, চুন্নু, পাকীর আলীকেও৷ তাদের ভাষায়, ফুটবল খেলতে গিয়ে এমন নজির অকল্পনীয়। যদিও প্রতিকূল সময়ে দেশের মানুষের অপার ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা তাঁরা প্রতিক্ষণ অনুভব করেছিলেন, কিন্তু ফুটবল খেলে সামরিক শাসনের একতরফা হস্তক্ষেপে জেলে যাওয়াকে তারা একদমই মেনে নিতে পারেন না। এজন্য এই মর্যাদাহানিকর ব্যাপারটা তারা বরাবরই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
ভাবতেই অবাক লাগে, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়িয়েছিল। আশির দশকের ফুটবলের সোনালি দিন আমরা ফিরে পেতে চাই রোজ৷ ফিরে পেতে চাই, সেই আবাহনী-মোহামেডানের পুরোনো দ্বৈরথ। তবে অবশ্যই চাইবো না, এমন ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর বা ব্ল্যাক ডে-র পুনরাবৃত্তি হোক, চাইবো খেলোয়াড়দের আত্মগরিমা যেন সামান্যটুকুও আঘাতপ্রাপ্ত না হয় কখনো!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন