ভালোবাসার 'অপরাধে' ২৫ বছর অন্ধকার কক্ষে তালাবদ্ধ রাখা হয়েছিল যে নারীকে!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে পালিয়ে যেতে চাইলে বাড়ির একটি ছোট রুমে আটকে রাখে ব্লাঞ্চের মা। কড়াভাবে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়- সেদিনই এ ঘর থেকে মুক্তি পাবে ব্লাঞ্চ, যেদিন তার মায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিবে সে।
১৮৪৯ সালের ১লা মার্চ। ফরাসী ধনী ও সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে জন্ম নেয় ফুটফুটে এক মেয়ে। মনিয়ের পরিবার তাদের পদবী অনুসারে মেয়ের নাম রাখে ব্লাঞ্চ মনিয়ের। ১৮৭৯ সালে পিতা এমিল মনিয়েরের মৃত্যুর পর মা মাদাম মনিয়ের পরিবারের মাথা হন। দানশীলতার জন্য এলাকায় এমনিতেই বেশ নাম-ডাক ছিল মাদাম মনিয়েরের, এমনকি উদারতার স্বীকৃতিস্বরুপ কম্যিউনিটি এওয়ার্ড পর্যন্ত পেয়েছিল সে। মেয়ে ব্লাঞ্চ মনিয়ের ছাড়াও এক ছেলে ছিল তার। নাম- মারসেল মনিয়ের, পেশায় একজন স্বনামধন্য উকিল। মোদ্দাকথা বেশ বনেদি পরিবারেই বড় হতে লাগলো ব্লাঞ্চ মনিয়ের। ছোটবেলায় যত না সুন্দর ছিল ব্লাঞ্চ, বড় হবার সাথে রুপ যেন সমানুপাতিক হারে বাড়তে থাকে তার। মেয়ের রুপ নিয়ে অহংকারের শেষ নেই মায়ের।

মেয়ে তখন পূর্ন যুবতী, ২৫ বছর বয়স। এবার যোগ্য ছেলে দেখে বিয়ে দেবার পালা। দূর-দূরান্ত থেকেও বিয়ের প্রস্তাব আসতে লাগলো সুন্দরী ব্লাঞ্চের জন্য, মা অনেক বাছ-বিচার করে অভিজাত পরিবারের এক পাত্রের সাথে বিয়ে ঠিক করলো মেয়ের। কিন্তু বিধিবাম! ব্লাঞ্চ যে এদিকে মন দিয়ে বসে আছে অন্য একজনকে! পেশায় সে সাধারণ একজন উকিল, পরিবারও ভীষণ সাদামাটা, আড়ম্বরহীন। মা বিয়ের ব্যাপারে মেয়েকে জানাতেই মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায় ব্লাঞ্চ এবং তার পছন্দের মানুষটিকে মায়ের সামনে নিয়ে আসে। কিন্তু এমন সাদামাটা ঘরের ছেলেকে মানবেন কেন মাদাম মনিয়ের! তার উপর ছেলের বয়স ব্লাঞ্চের চেয়ে ঢের বেশি। তাদের পরিবারের সম্মানটাই যে চলে যাবে! অতএব, তার পছন্দ করা পাত্রকেই বিয়ে করতে হবে ব্লাঞ্চকে, শেষ কথা এটিই- সাফ সাফ জানিয়ে দেয় সে। মায়ের এই সিদ্ধান্ত মানতে রাজি হয় না ব্লাঞ্চ, ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে পালিয়ে যেতে চাইলো সে। এ কথা জানতে পেরে বাড়ির একটি ছোট রুমে আটকে রাখে তার মা। কড়াভাবে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়- সেদিনই এ ঘর থেকে মুক্তি পাবে ব্লাঞ্চ, যেদিন তার মায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিবে সে। কিন্তু মায়ের মতো মেয়েও নিজ সিদ্ধান্তে অটল। বিয়ে যদি করতেই হয়, ভালোবাসার মানুষটিকেই করবে সে, অন্য কাউকে নয়! বছরের পর বছর চলে যায়, ব্লাঞ্চ তার সিদ্ধান্তে থাকে অনড়; মায়ের অহংকারী-জেদী মনও গলে না, ফলে মুক্তিও আর মেলে না।
১৮৮৫ সাল। নিখোঁজ ব্লাঞ্চকে খুঁজতে খুঁজতে ব্লাঞ্চের ভালোবাসার মানুষটি মারা যায়। কিন্তু তারপরও মুক্তি মেলে না ব্লাঞ্চের, সেই ছোট রুমেই তালাবদ্ধ করে রাখা হয় তাকে! এদিকে ব্লাঞ্চের মা আর ভাই সমাজে এমন ভান করে থাকে যে ব্লাঞ্চকে হারিয়ে তারা শোকে কাতর! বাড়ির কাজের লোকেরা এই ব্যাপারে জানলেও কাউকে জানাতে ভয় পেত মনিয়েরদের সামাজিক প্রভাবের কারণে। এইভাবে কেটে যায় পঁচিশটি বছর!

অতঃপর, ২৫ বছর পর, ১৯০১ সালে, প্যারিসের অ্যাটোর্নি জেনারেলের কাছে বেনামে একটি চিঠি পৌছে। কে বা কারা চিঠিটি পাঠিয়েছে, তা জানা যায়নি কখনোই। তবে চিঠিটি পড়ে আঁতকে উঠে অ্যাটোর্নি জেনারেল। সে চিঠিটিতে লেখা থাকে- মনিয়ের পরিবার বহু বছর ধরে তাদের বাড়িতে আটকে রেখেছে এক ব্যক্তিকে, যে কিনা রীতিমত নিজের বিষ্ঠার উপর বসবাস করে আসছে!
মনিয়ের পরিবারের সামাজিক অবস্থান ততদিনে আরও উঁচুতে, মোটা অঙ্কের অনুদান দিয়ে সকলের কাছেই সুপরিচিত মাদাম মনিয়ের। তার সামাজিক অবস্থানের কথা ভেবে প্রথমে না চাইলেও পরে তদন্ত চালাতে নির্দেশ দেন জেনারেল। বাড়ি তল্লাসি করতে চায় শুনে রাজি হয়নি মাদাম মনিয়ের, বরং চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেন। এতে সন্দেহ বেড়ে যায় অফিসারদের এবং জোরপুর্বক বাড়িতে ঢুকে পড়েন। পুরো বাড়ি তল্লাসি চালিয়ে কিছুই খুঁজে না পেয়ে যখন ফিরে যাবে সৈন্যরা, তখনই একজন সেনার নাকে আসে বোটকা এক পঁচা গন্ধ। সেই গন্ধ অনুসরণ করে চিলেকোঠায় পৌছালে সেখানে একটি অন্ধকার তালাবদ্ধ রুম দেখতে পায় তারা। রুমটিতে কেবলমাত্র একটি ছোট বন্ধ জানালা ছিল, তাও মোটা পর্দা দেওয়া, কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না বাইরে থেকে। সন্দেহ হওয়ায় জানালার কাঁচ ভেঙে ফেলে এক সেনা। ভাঙা কাঁচের ভেতর দিয়ে আবছা আলোয় রুমের এক কোনায় শেকলাবদ্ধ এক নারীকে দেখতে পায় তারা। দ্রুত দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করলে যা দেখতে পেল সেনারা, তার জন্য প্রস্তুত ছিল না কেউই!

ছোট কক্ষটির সারা দেওয়াল জুড়ে বারবার লেখা ছিল একটি মাত্র শব্দ, Liberte, অর্থাৎ মুক্তি। ঘরের একমাত্র আসবাব একটি ছোট বিছানা, যার উপর পঁচা খাবার আর কোটি কোটি কীটের মধ্যে শুয়ে আছে ব্লাঞ্চ মনিয়ের! সেই ব্লাঞ্চ মনিয়ের, যে ২৫ বছর আগে নিখোঁজ হয়েছিল। কিন্তু চেনার কোনো উপায় নেই আর তাকে, কেননা তিনি আর সেই সুন্দরী রমণী নেই, বরং অপুষ্টিতে ভোগা বিকৃত চেহারার এক নারীতে পরিণত হয়েছেন। তৎক্ষণাৎ উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে, সে সময় তার ওজন ছিল মাত্র ২২ কেজি!
এই ২৫ বছরে বাইরের আলো-বাতাস থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন থাকায়, আলোতে অভ্যস্ত হতে অনেক সময় লেগেছিল ব্লাঞ্চের। শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ হলেও বিগত ২৫বছরের ভয়াবহ স্মৃতি মাথা থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারেনি সে। ফলে, গুরুতর মানসিক সমস্যা দেখা দেয় তার, ভর্তি করা হয় ফ্রান্সের এক সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালে। আর কোনোদিনই সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে পারেনি ব্লাঞ্চ মনিয়ের। ১৯১৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, জীবনের বাকিটা সময় এখানেই কাটায় সে। ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করতে চাওয়ার 'অপরাধে' এই শাস্তি পেতে হলো তাকে।

আর ব্লাঞ্চের মা আর ভাই-এর পরিণতি? ব্লাঞ্চকে উদ্ধারের পর এরেস্ট করা হয় তার মা ও ভাইকে। ততদিনে শহরের সবাই কাহিনী জেনে গেছে এবং ধিক্কার জানায় মনিয়েরদের। এরমধ্যে কারাগারে মাদাম মনিয়ের অসুস্থ হয়ে গেলে জামিন পেয়ে বাসায় যায়, খবর পেয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা ভিড় করে তাদের বাসার সামনে। আতঙ্কিত হয়ে হার্ট এটাক করে সেদিনই মারা যায় মিসেস মনিয়ের। অতিরিক্ত অহংকার আর ইগো এভাবেই শেষ করে দেয় একটি সাজানো গোছানো সংসারকে।