একজন মানুষ, ২০ বছর আর ১০,০০০ লাশের অবিশ্বাস্য আখ্যান!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
গত ২০ বছরে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সাথে হাত মিলিয়ে দশ হাজারেরও বেশি মৃতদেহ সৎকার করেছেন এই মহান হৃদয়ের মানুষটা। কিন্ত কেন? চলুন শুনে আসি 'বডি মিয়া'র গল্পটা!
আজ যার কথা বলব তার নাম বডি মিয়া। একজন ভারতীয় মুসলমানের জন্য নামটা বেশ অদ্ভূতই বটে। কিন্তু গত দুই দশক ধরে নিজের কাজের মাধ্যমে এই খেতাব জুটিয়েছেন তিনি। এবং এখন অবস্থাটা এমনই দাঁড়িয়েছে যে তার পিতৃপ্রদত্ত প্রকৃত নামটা যে কী ছিল তা স্মরণে আছে খুবই কমসংখ্যক মানুষের। কিন্তু কীভাবে এমন একটা নামের মালিক হলেন বডি মিয়া? চলুন জেনে আসি সেই গল্প।
মাইসোরের বাসিন্দা আইয়ুব একদিন নিজের জন্য একটা গাড়ি কিনবেন বলে কর্ণটকের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে তিনি দেখতে পান, একটা নাম-পরিচয়হীন লাশকে ঘিরে জটলা করে আছে অনেক মানুষ। সেই মুহূর্তে তাড়া থাকায় ব্যাপারটাকে খুব একটা আমলে নেননি তিনি। কিন্তু দশ ঘন্টা পর ওই একই রাস্তা দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময়ও যখন দেখলেন যে লাশটা সেই আগের জায়গাতেই পড়ে আছে, তখন আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না তিনি। নিজেই উদ্যোগী হয়ে, সকলের বারণ অগ্রাহ্য করে, লাশটাকে কোলে তুলে ঢুকালেন নিজের সদ্যকেনা গাড়ির মধ্যে। তারপর সেটাকে পৌঁছে দিলেন একটা মর্গে।
কিন্তু এই কাজের পরিণতি যে কী হবে তা একবারও চিন্তা করেননি তিনি। নিজের শহরে ফিরে এসে টের পেলেন, সকলের প্রচন্ড ক্রোধ তার ওপর। এক প্রকার সমাজচ্যুতই করা হলো তাকে।
তার কিছুদিন পরের ঘটনা। আইয়ুব একটা কাজের জন্য ব্যাঙ্গালোর যান। সেখানেও একই ঘটনার সম্মুখীন হন তিনি। আর সবাই অচ্ছুৎ মনে করে একটা অজ্ঞাত পরিচয় লাশকে এড়িয়ে গেলেও, তিনি সেটাকে উদ্ধার করে সৎকারের ব্যবস্থা করেন। এবং এ কাজের মাধ্যমেই তিনি টের পেলেন, জীবনে তিনি আসলে কী করতে চান।
তাই তিনি আবার বাড়ি ফিরে আসলেন বাবা-মায়ের দোয়া নিতে। তারা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, 'তোমার যা মন চায় তুমি তাই করো।' তারপর থেকে আইয়ুব আর কখনো ফিরে তাকাননি। গত দুই দশক ধরে বিভিন্ন লাশ উদ্ধার করে সেগুলোর সৎকারের যাবতীয় কাজ বেশ নিষ্ঠার সাথে পালন করে আসছেন তিনি। এবং এভাবেই বর্তমানে ৩৮ বছর বয়সী আইয়ুবকে সকলে এক নামে চেনে বডি মিয়া হিসেবে।
যদিও আইয়ুব যে কাজটা করছেন তা খুবই মহৎ সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু প্রথম প্রথম তাকে লোকের কম কটু কথা শুনতে হয়নি। 'মানুষ আমাকে ঘেন্না করত, আমাকে আজেবাজে কথা বলত। এজন্য রাতের বেলা আমি একা একা কাঁদতাম,' বলেন আইয়ুব। শুধু তাই-ই নয়, রাস্তায় আইয়ুবের সাথে দেখা হলে অনেকে এমনকি মুখ ঘুরিয়েও চলে যেত। অচ্ছুৎ লাশের সদগতি করতে গিয়ে এভাবে আইয়ুব নিজেই মানুষের কাছে অচ্ছুৎ হয়ে যান। কিন্তু তারপরও এ কাজ বন্ধ করার কথা তিনি ভাবতেও পারেন না। এর বিনিময়ে অপমান বৈ ফুটো পয়সাটাও কেউ তাকে না দিলেও।
মাত্র ক্লাস টু পর্যন্ত পড়া আইয়ুবকে তাই জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্যান্য কাজ করতে হয়। কখনো তিনি ফলের বাজারে কুলির কাজ করেন, আবার কখনো বা তিনি ট্যাক্সি চালান। এবং তা থেকে যে অতি সামান্য পরিমাণ আয় হয় তার, সেটাকেই আবার তিনি সমান তিন ভাগে ভাগ করেন। এক ভাগ তার পরিবারের জন্য, এক ভাগ মৃত লাশের সৎকারের জন্য, আর বাকি অন্য ভাগ রাস্তার ফুটপাতে বাস করা অসহায় দুঃস্থদের জন্য। আইয়ুব রাস্তার গৃহহীনদের জন্য খাবার ও পোশাকের ব্যবস্থা করেন, এতিম শিশুদের স্কুলে পাঠান, এবং তারা বড় হলে তাদের বিয়ের বন্দোবস্তও করে দেন।
তিনি মনে করেন, তিনি যে এত সব কাজ একা হাতে করতে পারছেন তার পুরোটাই সম্ভব হয়েছে তার স্ত্রীর জন্য, যিনি দর্জির কাজ করে সংসার চালানোর কাজে সমান অবদান রাখেন। নিজেদের বিয়ের রাতের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, 'সেই রাতেও আমাকে একটা লাশ সৎকার করতে যেতে হয়েছিল। আমি প্রথমে তা তাকে জানাইনি। শুধু বলেছিলাম একজন পরিচিত লোক খুবই অসুস্থ, তাকে দেখতে যাচ্ছি। পরবর্তীতে যখন সে আমার প্রকৃত পেশার কথা জানতে পারল, একটিবারের জন্যও সে কোন আপত্তি তোলেনি।'
আইয়ুবের কাছে মোট ছয়টা মোবাইল আছে, আর সেগুলো দিনের পুরোটা সময়ই চালু থাকে, যাতে বিপদে পড়ে কেউ তাকে কল দিলে যেন অবশ্যই পায়। শুধু নামাজ পড়ার সময় কিছুক্ষণের জন্য সেগুলো বন্ধ রাখেন তিনি। এভাবে গত ২০ বছরে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সাথে হাত মিলিয়ে দশ হাজারেরও বেশি মৃতদেহ সৎকার করেছেন তিনি। সম্প্রতি আইয়ুবকে তার এই নিঃস্বার্থ মহান কাজের জন্য সম্মাননা দিয়েছে দুবাই সরকার। পাশাপাশি তার গলায় উঠেছে সোনার মেডেলও।
কিন্তু এই মেডেল প্রাপ্তি তাকে যতটা না আনন্দিত করেছে, তার থেকে বেশি করেছে আবেগাপ্লুত। 'আমার মা আমাকে একদিন বলেছিলেন, জীবনে যেন একবারের জন্য হলেও কোন কিছুতে মেডেল জিতি। কিন্তু যখন আমার সময় আসল, তখন আর তিনি এই পৃথিবীতে নেই।' এবং তাকে যে দুবাই সরকার সম্মানিত করছে, এ নিয়েও তার যথেষ্ট আপত্তি ছিল। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, 'খামোকা আমাকে সম্মামনা প্রদান করে টাকা খরচ করার চেয়ে, এই টাকা যদি দুঃস্থ গৃহহীনদেরকে দেয়া হতো তাহলে তারা অনেক বেশি উপকৃত হতো।'
এমনই আইয়ুবের মানসিকতা। যেই মানুষের কাছ থেকে তিনি আজীবন অপমান আর লাঞ্ছনা পেয়ে এসেছেন, তাদের জন্যই তার এত মায়া। কারণ তিনি মনে করেন, 'মানুষই হোক আর পশু, কাটলে সেটার ভিতর দিয়ে তো রক্তই পাওয়া যাবে।' জগতের আর সবার মঙ্গল কামনার পাশাপাশি আইয়ুব নিজেও সুস্থ শরীরে অনেকদিন বেঁচে থাকতে চান। কেননা তা না হলে তিনি মানুষের উপকার করবেন কীভাবে! তাই সকলের কাছে তার একটাই চাওয়া, 'আমার জন্য দোয়া করবেন।'
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন