মেক্সিকান বর্ডারে যদি আমেরিকান সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক একজন মানুষও মারা যায়, সাথে সাথে তুলকালাম কান্ড সৃষ্টি হয়, প্রতিটা পত্রপত্রিকায় সে খবর প্রধান শিরোনাম হিসেবে প্রকাশিত হয়। কিন্তু ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী যে প্রতি বছর এত এত সাধারণ বাংলাদেশীকে নির্বিচারে হত্যা করে চলেছে, এ নিয়ে কারও কোন হেলদোল নেই। 

সীমান্তে ভালো বেড়া দিলেই কি প্রতিবেশীদের মাঝে সম্পর্ক ভালো হয়? অন্তত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ক্ষেত্রে তা সত্য নয়। এখানে, ভারত ইতিমধ্যে ২,০০০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে সীমান্ত-বেষ্টনী তৈরি করে ফেলেছে। যে দুই অঞ্চল মিলে আগে ছিল বৃহত্তর বঙ্গ জনপদ, তার মধ্যিখানে ভারত এখন বসিয়ে দিয়েছে 'বাইরে থাকুন' চিহ্ন। উদ্দেশ্য- অবৈধ অভিবাসন, চোরাচালান ও সরকারবিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ রোধ করা। বিশ্বব্যাপী যখন অবৈধ অভিবাসন একটি বিশাল বড় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, তখন এই ব্যাপারটি খুব একটা ব্যতিক্রমধর্মী কিছু নয়। কিন্তু সীমান্ত রক্ষার্থে ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) যা করছে, তা অবিশ্বাস্য। তারা 'দেখামাত্র গুলি করা' নীতি অনুসরণ করছে, এমনকি নিরীহ নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের ক্ষেত্রেও। গত ১০ বছরে তারা প্রায় ১,০০০ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে, যার অধিকাংশই বাংলাদেশী। এবং এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার এই সীমান্ত অঞ্চলকে তারা 'হত্যাপুরী'তে পরিণত করেছে। কিন্তু যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে এখন পর্যন্ত এ ধরণের কাজের ফলে একজনকেও যথাযোগ্য আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।

কিন্তু তারপরও এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ খুব কমই আছে যে সীমান্ত এলাকার নিরস্ত্র এসব মানুষের ওপর এসব হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে খুবই ঠাণ্ডা মাথায়, পরিকল্পিতভাবে। বিস্ময়ের ব্যাপার, কিছু কিছু ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা অবৈধভাবে সীমান্ত পার হতে যাওয়া মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোকে উৎসাহিতও করেন। এমনকি মানুষগুলোর কাছে আত্মরক্ষা বা পাল্টা আক্রমনের জন্য কোনপ্রকার অস্ত্র না থাকলেও। এবং এরচেয়েও বেশি বিস্ময়ের ব্যাপার, বিদেশী বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, যাদেরকে অন্য নানা বিষয়ে সরব থাকতে দেখা যায়, তারা সীমান্তের এই হত্যাকান্ড নিয়ে টু-শব্দটিও করে না। মেক্সিকান বর্ডারে যদি আমেরিকান সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক একজন মানুষও মারা যায়, সাথে সাথে তুলকালাম কান্ড সৃষ্টি হয়, প্রতিটা পত্রপত্রিকায় সে খবর প্রধান শিরোনাম হিসেবে প্রকাশিত হয়। কিন্তু ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী যে প্রতি বছর এত এত সাধারণ বাংলাদেশীকে নির্বিচারে হত্যা করে চলেছে, এ নিয়ে কারও কোন হেলদোল নেই। 

সীমান্তে এ ধরণের হত্যাকান্ড যেন দৈনন্দিন রীতিতে পরিণত হয়েছে। 'হিউম্যান রাইটস ওয়াচ'-এর কাছে এমন একটি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দিয়েছিলেন আলাউদ্দিন বিশ্বাস, ২০১০ সালে যার ২৪ বছর বয়সী ভাতিজা গরু চরাতে গিয়ে বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারায়। "সে যখন মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, তখন তারা এসে তার ঠিক কপালে গুলি চালায়। যদি সে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত, তাহলে তো গুলিটা তার পেছন দিকে লাগত। তারা তাকে স্রেফ 'খুন' করেছিল।" বিএসএফ ওইসময় 'আত্মরক্ষা'র অজুহাত দেখিয়েছিল, যদিও মৃতের আশেপাশে কোথাও কোনপ্রকার অস্ত্র পাওয়া যায়নি। এদিক থেকে আরেক বাংলাদেশী নজরুল ইসলাম অবশ্য কিছুটা সৌভাগ্যবান। নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, "রাত তিনটার দিকে আমরা সিদ্ধান্ত নিই ভারতীয় সীমান্ত পার হওয়ার।" কি জন্য এ কাজ করতে যাচ্ছিলেন তারা? উত্তরটা খুব সহজঃ নিজেদের পালিত গরুগুলোকে ফিরিয়ে আনতে। "কিন্তু বিএসএফ যেই না আমাদের দেখল, হুট করেই তারা আমাদের দিকে গুলি চালাতে শুরু করে দিল।" সেই গুলির একটি লেগেছিল নজরুলের হাতে। কিন্তু ভাগ্য ভালো, তিনি প্রাণে বেঁচে যান। 

এমনকি ছোট ছোট শিশুরাও ছাড় পায় না বিএসএফের পাশবিকতার হাত থেকে। এক বাবা জানান কিভাবে বিএসএফের কর্মকর্তারা তার ছোট ছেলেকে পিটিয়েছিল। "বিএসএফের লোকেরা চারদিক থেকে আমার ছেলেকে ঘিরে ধরে, আর কোন কারণ না দেখিয়েই অযথা রাইফেলের বাঁট দিয়ে তাকে পেটাতে থাকে। এছাড়াও চড়, থাপ্পড় আর লাথি তো চলছিলই। নয়জন মিলে তারা আমার ছেলেকে মেরেছিল। এমনকি আমার ছেলে যখন এক পর্যায়ে মাটিতে পড়ে যায়, তখনও তারা পাষন্ডের মত ছেলেটার বুকে আর গোপনাঙ্গে লাথি মারা থামায়নি।" সীমান্ত এলাকাটি দীর্ঘদিন ধরেই স্থানীয় মানুষের ব্যবসা বাণিজ্যের পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এমনকি ১৯৪৭ সালে যখন ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক দেশভাগ হয়েছিল, তখনও সাধারণ মানুষ এই সীমানা পার হয়েই এক দেশ থেকে আরেক দেশে স্থানান্তরিত হয়েছিল।

যেমন আমেরিকায় হচ্ছে মেক্সিকান সীমান্তের ক্ষেত্রে, ঠিক তেমনই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তও পরিণত হয়েছে ভারতীয় রাজনীতির একটি অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে। লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী এখন অবৈধভাবে ভারতে বাস করে। এবং ভারতও তাদের শোষণ করে সস্তা শ্রমের বিনিময়ে। ভারতের অবশ্যই অধিকার আছে নিজেদের সীমান্তের কর্তৃত্ব রক্ষা করা। কিন্তু তাদের এই অধিকার নেই যে তারা যখন খুশি, কোন কারণ ছাড়াই সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালাবে, নির্বিচারে শত শত প্রাণ কেড়ে নেবে। কিছু কিছু ভারতীয় কর্মকর্তাও এ কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেন যে তারা সত্যিই নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে হত্যা করছেন। বিএসএফ প্রধান রমন শ্রীবাস্তব দাবি করেন, সীমান্তে মারা যাওয়াদের জন্য দুঃখিত বা সহানুভূতিশীল হওয়ার কিছু নেই। কারণ তারা অবৈধভাবে অন্য দেশে প্রবেশের চেষ্টা করে, এমনকি রাতের অন্ধকারেও, আর তাই তাদেরকে 'নিরপরাধ' ভাবার কোন কারণ নেই, এবং তাদেরকে যে মেরে ফেলা হচ্ছে সেটিও একদমই আইনসঙ্গত। যদিও ভারত একটি আদালত-শাসিত রাষ্ট্র, কিন্তু তিনি মনে করেন বিএসএফের অধিকার আছে নিজেদেরই বিচারকের ও বিচার সম্পাদকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার। এবং তা করতে গিয়ে তারা কোনকিছুরই তোয়াক্কা করে না। এমনকি ১৩ বছরের আবদুর রাকিবের ক্ষেত্রেও, যেই ছেলেটি কোন আইনই ভাঙেনি। তার একমাত্র 'অপরাধ' এই যে তাকে সীমানার কাছে দেখা গেছে, আর সেই কাজেরই 'সাজা' হিসেবে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।

দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীরও এধরণের হত্যাকান্ডের বিপক্ষে বিশেষ কিছু বলার নেই। তারা মনে করে, কোন ব্যক্তি যদি চোরাচালানের সাথে জড়িত থাকে, তবে তার সাথে এমন কিছু হওয়াটা ঠিকই আছে! উইকিলিকস থেকে প্রকাশিত কাশ্মীর সংক্রান্ত এক সাম্প্রতিক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ভারতীয় সৈন্য ও পুলিশেরা নিয়মিতই মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে, কিন্তু এজন্য তাদের কোন বিচার হচ্ছে না। এমনকি বিএসএফের মত সংস্থায় কর্মরত কোন সৈন্যের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করতে চাইলেও একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু সেটা নেয়া খুব কম ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়। 'দেখামাত্র গুলি' নীতির ব্যাপারে ভারতের সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে যে প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় তা খুবই বিভ্রান্তিকরঃ আমরা সীমান্তে গুলি চালাই তাদের ওপর যারা আইন ভাঙে, আমরা সীমান্তে গুলি চালাই না, আমরা কেবল আত্মরক্ষার জন্যই গুলি চালাই, আমাদের গুলিতে কেউ কখনো মারা যায়নি! এতসবের পরও কিছুটা হলেও আশার আলো দেখা যায়। চাপের মুখে পড়ে কিছু উচ্চপদস্থ ভারতীয় কর্মকর্তা আশ্বাস দিয়েছেন যে তারা বিএসএফের ব্যবহার পরিবর্তনের ব্যাপারে কাজ করবেন, এবং 'দেখামাত্র গুলি' নীতিতে যাতে পরিবর্তন আনা হয় সে ব্যাপারে নির্দেশ পাঠাবেন। সরাসরি হত্যাকান্ড না ঘটিয়ে অন্য কোন উপায়ে যাতে সীমান্তে অপরাধীদের ধরা যায়, সে ব্যাপারেও তারা ভেবে দেখার কথা জানিয়েছেন।

কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, এসব আশ্বাস কি আদৌ পূরণ হবে? এর আগেও কাশ্মীর ইস্যুতে নির্যাতনকারী সৈন্যদের ক্ষেত্রে 'জিরো টলারেন্স' নীতি মানার কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু কাজে সে কথার রূপান্তর কখনোই হয়নি। যেহেতু ভারতের অর্থনীতি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ছে, তাই দেশটিতে মানবাধিকার কতটুকু মানা হয় বা আদৌ মানা হয় কিনা সেগুলোর ব্যাপারে অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে বেশি কথা উঠছে। কিন্তু ভারত একইসাথে পেশিশক্তির ক্ষেত্রেও উপরে উঠে আসছে, এবং সর্বত্র প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছে। তবে তাদের বোঝা উচিৎ, এরকম ব্যবহারের জন্য একসময় তাদেরকে ঠিকই জবাবদিহি করতে হবে। নিয়মিতভাবে নিরীহ, নিরস্ত্র, হতদরিদ্র গ্রামবাসীদের ওপর গুলিবর্ষণ - বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সাথে এসব কাজ একদমই মানায় না। 

তথ্যসূত্র- দ্য গার্ডিয়ান 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা