ময়মনসিংহের কৃষ্টপুরের দুটি কলোনির নারীরা মিলে ভাবলেন, স্বামীর গলগ্রহ হয়ে থাকা আর নয়। তারা নিজেরা মিলে শুরু করলেন স্বাবলম্বী হওয়ার লড়াই। জন্ম নিলো বউ বাজার, যেখানে সব ব্যবসায়ীই নারী...

হাতিবাগানে কী হাতি পাওয়া যায়? ভূতের গলি'তে কী পাওয়া যায় ভূত? গুলিস্তানে কী এখনো আছে ফুলের বাগান? কলাবাগানে কয়খানা কলাগাছ আছে? লেখা পড়তে পড়তে পাঠক নিশ্চয়ই বিরক্ত হচ্ছেন- কোনো এক জায়গার নাম যা খুশি হতে পারে, কিন্তু সে নামের সাথে জায়গাটির বিভিন্ন উপকরণের সাদৃশ্য খোঁজার জন্যে কেন এত আদিখ্যেতা! ঠিক আদিখ্যেতা না, তবে আজকে যে জায়গার গল্প লিখছি, সে জায়গার নামকরণের সাথে জায়গার উপকরণগত সাদৃশ্য বেশ চোখে পড়ার মতন।

জায়গাটির নাম বৌবাজার। ময়মনসিংহের কৃষ্টপুরের দুই কলোনির জন্যে গড়ে ওঠা এক বাজার এই বৌবাজার। এই দুই কলোনির বিভিন্ন পরিবারের বৌ'রাই চালান এ বাজারের দোকানগুলো। এই বৌবাজার শুরুর গল্পটাও একটু অন্যরকম। জানা যাক সেটিই। ঘটনার শুরু আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে। প্রেক্ষাপট ময়মনসিংহের কৃষ্টপুরের দুই স্থানীয় কলোনি মালঞ্চ ও আদর্শ। বলে রাখি, এই দুই কলোনিতে যারা বাস করেন, তারা সমাজের একেবারে নীচের প্রকোষ্ঠে কায়ক্লেশে জীবন নির্বাহ করা মানুষ। অধিকাংশই তারা দিনমজুর বা রিক্সাচালক। পরিবারে নিত্য অভাব, অনটন। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। দুর্দশার মধ্য দিয়ে দিনানিপাত করতে করতে দুই কলোনির স্থানীয় মহিলারা ভাবলেন, কিছু একটা করা দরকার তাদের। এভাবে বসে বসে স্বামীর গলগ্রহ হয়ে থাকলে কোনো কিছুই হবেনা। তাদেরকেও স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে হবে। নিজের জন্যে। পরিবারের জন্যে।

ভাবনাচিন্তা করে তারা সিদ্ধান্তে এলেন, কলোনির জন্যে একটা বাজার করা হবে। যে বাজারে শুধু নারীরাই দোকান দেবেন। শুধু নারীরাই হবেন বিক্রেতা। প্রথমে অল্প কয়জন নারী  মিলে শুরু করলেন এই বাজার। আস্তে আস্তে সেখানে যুক্ত হতে শুরু করলো আরো নারী। কালক্রমে বাজারের নামই হয়ে গেলো- বউ বাজার। যে বাজারে এখন দোকানের সংখ্যা ১৩০! এখানে ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হয়েছে অজস্র নারী ব্যবসায়ী। তাছাড়া এই বাজারকে স্থানীয় খদ্দেররাও বেশ পছন্দ করেন। খুব কম খরচে জিনিসপাতি পাওয়া যায় এখানে। এই বাজারের পেছনে মানুষের তীব্র আগ্রহের যেটা সবচেয়ে বড় কারন।

বৌবাজারের বিক্রেতা নারীরা আজ আর পরনির্ভরশীল নন, তারা স্বাবলম্বী!  

বউ বাজারে কঠোরভাবে এখনো এই নিয়ম মানা হয়, কোনো পুরুষ দোকানদার থাকতে পারবে না এ বাজারে। তবুও মাঝেমধ্যে দুয়েকজন পুরুষ দোকানদারকেও দেখা যায় এখানে৷ যখন এই বাজারের কোনো নারী ব্যবসায়ী, সাংসারিক বা অন্য  কোনো কাজের ব্যস্ততার জন্যে দোকানে আসতে পারেন না, তখন তিনি তার স্বামী অথবা ঘরের পুরুষ সদস্য'কে পাঠিয়ে দেন দোকানে। এই পুরুষেরা এসে সাময়িক সময়ের জন্যে দোকান আগলান। মূল ব্যবসায়ী ফিরে এলেই তারা ফিরে যান অন্য কাজে। সে কারনেই মাঝেমধ্যে পুরুষ ব্যবসায়ীদেরও দেখা যায় এ বাজারে।

এই বাজার ফিরিয়ে দিয়েছে স্থানীয় মানুষজনের ভাগ্য। নারীরাও যেমন স্বাবলম্বী হয়েছেন, সংসারের ঘানি টানার পেছনে স্বামীর সাথে তারাও দিতে পারছে যোগ্য সমর্থন। অনেকেই হয়েছেন সফল ব্যবসায়ী। ঘরে এসেছে স্বাচ্ছন্দ্য। স্বামী মারা যাওয়ার পরও অনেকে সংসার টানতে পারছেন এই বাজারের বদৌলতে। একটি ভালো উদ্যোগ  যে একটি এলাকাকে এবং সে এলাকার মানুষকেই বদলে দিতে পারে চিরতরে, ময়মনসিংহের কৃষ্টপুরের 'বউ বাজার' যেন তার সবচেয়ে বড়সড় উদাহরণ।

নারীকেন্দ্রিক এরকম উদ্যোগ যত বেশি নেওয়া হবে, ততই এ সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে তাঁরা । এরকম উদ্যোগ ক্রমশ বাড়ুক, প্রত্যাশা আমাদের।

তথ্য ও ছবিসূত্রঃ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, বাংলা 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা