
দক্ষিণ ভারতের একমাত্র অভিনেতা হিসেবে পাঁচটা আলাদা ইন্ডাস্ট্রির সিনেমায় আলাদা আলাদাভাবে নন্দী অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন, জিতেছেন ফিল্মফেয়ার সাউথে সেরা কমেডিয়ানের পুরস্কারও। তবে সবচেয়ে বেশি যেটা ব্রহ্মানন্দম জিতেছেন, সেটা মানুষের মন। দক্ষিণ ভারতে তার জনপ্রিয়তা নায়কদের চেয়ে কম কিছু নয়।
ব্রহ্মানন্দম কান্নেগান্তি- নামটা হঠাৎ শুনলে মনে হতে পারে, এই ব্যাটা আবার কে রে! কিন্ত বাজী ধরে বলতে পারি, এই লোককে আপনি চেনেন। তার অভিনয় আপনি দেখেছেন, এবং তার ডায়লগ শুনে, কমিক টাইমিং দেখে হেসে গড়িয়েও পড়েছেন। হ্যাঁ, দক্ষিণী সিনেমার জনপ্রিয় মুখ, কমেডিয়ান ব্রহ্মানন্দমের কথাই বলা হচ্ছে। আমাদের দেশে এখন সাউথের সিনেমার দর্শক প্রচুর, আর তাই ব্রহ্মানন্দমও ভীষণ পরিচিত একজন হয়ে উঠেছেন অনেক আগে থেকেই।
তবে সিনেমায় হাসিঠাট্টায় মাতিয়ে রাখা এই মানুষটা যে পদ্মশ্রী সম্মাননায় ভূষিত হয়েছে, কিংবা তিনি যে একটা গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের মালিক, সেটা আমরা ক'জনে জানি? দক্ষিণ ভারতের পাঁচটি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি মিলিয়ে এখন পর্যন্ত এগারোশো'র বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন ব্রহ্মানন্দম। সংখ্যাটা চোখ কপালে তুলে দেয়ার মতো।
আর এটাই ব্রহ্মানন্দমের নামটা তুলে দিয়েছে গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে। বিশ্বের আর কোন জীবিত অভিনেতা এত সিনেমায় অভিনয় করেননি। ব্রহ্মানন্দমকে ছাড়িয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, তার ধারে কাছে যাওয়াটাও আর কারো পক্ষে সম্ভব হবে না হয়তো কখনও। পঞ্চাশ-একশো তো নয়, সংখ্যাটা যে এগারোশোর বেশি! এবং সেটা এখনও বাড়ছে।

দক্ষিণী সিনেমার নিয়মিত দর্শকেরাই জানেন, নায়ক-নায়িকা যে-ই হোক, সিনেমার বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে ব্রহ্মানন্দমের উপস্থিতি থাকবেই। বিশেষ করে তেলুগু সিনেমা তো ব্রহ্মানন্দমকে ছাড়া ভাবাই অসম্ভব। কোন নায়কের সঙ্গে ব্রহ্মানন্দম কাজ করেননি, সেটা খোঁজার জন্যে খড়ের গাঁদায় আতসী কাঁচ নিয়ে নামতে হবে, তাতেও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
রজনীকান্ত থেকে শুরু করে চিরঞ্জীবি, পাওয়ান কল্যান, হালের মহেশ বাবু, জুনিয়র এনটিআর, রামচরন, আল্লু অর্জুন, ধানুশ- সবার সঙ্গেই স্ক্রীন শেয়ার করেছেন তিনি, এবং নিজের প্রতিভার ছাপটা রেখে এসেছেন পর্দায়, জায়গা করে নিয়েছেন দর্শকের মনে। সাউথের ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে যে পরিমান প্রভাব তার, কমেডিয়ানের চরিত্রে অভিনয় করা আর কোন ভারতীয় এমন ক্রেজ তৈরি করতে পারেননি।
পর্দায় তার উপস্থিতি মানেই বাড়তি বিনোদনের খোরাক, আর সিনেমায় ব্রহ্মানন্দমের না থাকা মানেই একটা অপূরণীয় শূন্যতা। কোটি মানুষকে নির্মল বিনোদন দেয়া এই মানুষটা অভিনয়ে আসার আগে শিক্ষকতা করতেন, তেলুগু ভাষার শিক্ষক ছিলেন তিনি। জন্ম হয়েছিল অন্ধ্র প্রদেশের তেলেঙ্গানায়। তামিল, তেলুগু, কন্নড় সহ পাঁচ-ছয়টা ভাষায় তিনি অনর্গল কথা বলতে পারেন।
শিক্ষক থাকাকালীন সময়েই তেলুগু পরিচালক জান্ধল্য সুব্রহ্মন্যম শাস্ত্রীর সঙ্গে এক ঘরোয়া আড্ডায় পরিচয় হয় তার। ব্রহ্মানন্দমের দুর্দান্ত সেন্স অফ হিউমারে মুগ্ধ হয়েছিলেন সুব্রহ্মন্যম, তার হাত ধরেই সিনেমা জগতে পা রাখেন ব্রহ্মানন্দম। প্রথম সিনেমার নাম 'আহা না পেলান্ত্রা'।
সেটা ১৯৮৬ সালের কথা। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু, অভিনয়ের রেলিগাড়িটা ঝিকঝিক শব্দে চলছে আজও। বয়সের ঘড়ির কাঁটা একে একে পেরিয়ে গেছে বাষট্টিতে, পেশাদার অভিনেতা হিসেবে বত্রিশ বছরেরও বেশি সময় লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের এই জগতে কাটিয়ে ফেলেছেন ব্রহ্মানন্দম, নামের পাশে যোগ হয়েছে এগারোশো'র বেশি সিনেমায় অভিনয় করার বিরল এক কীর্তি। ভারত সরকার ২০০৯ সালে তাকে ভূষিত করেছে পদ্মশ্রী সম্মাননায়।
দক্ষিণ ভারতের একমাত্র অভিনেতা হিসেবে পাঁচটা আলাদা ইন্ডাস্ট্রির সিনেমায় আলাদা আলাদাভাবে নন্দী অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন, জিতেছেন ফিল্মফেয়ার সাউথে সেরা কমেডিয়ানের পুরস্কারও। তবে সবচেয়ে বেশি যেটা ব্রহ্মানন্দম জিতেছেন, সেটা মানুষের মন। দক্ষিণ ভারতে তার জনপ্রিয়তা নায়কদের চেয়ে কম কিছু নয়। ক্যারিয়ারের তিন দশক পার করেছেন, কোন নারীঘটিত স্ক্যান্ডালে নাম আসেনি তার।
তবে একবার আনুশকা শেঠীকে 'গরম জিলাপি' বলায় সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। নায়কপ্রধান ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে কাজ করেছেন বরাবর, সেখানে হিরোর হিরোগিরি দেখতেই লোকে সিনেমা হলে ভীড় জমায়। ব্রহ্মানন্দম তবুও আলাদাভাবে নজর কেড়েছেন বরাবরই, পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন সবার সঙ্গে, নিজের একটা আলাদা ব্র্যান্ডভ্যালু তৈরি করে ফেলেছেন।
ব্রহ্মানন্দম হচ্ছেন ভারতের ইতিহাসে সিনেমায় সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া কমেডিয়ান, বলিউডের সবার চেয়েও এই জায়গাটাতে অনেক এগিয়ে তিনি! একটা সিনেমায় অভিনয়ের জন্যে এক কোটি রূপি পারিশ্রমিক নেন তিনি! বত্রিশ বছরের। ক্যারিয়ারে কম টাকা আয় করেননি তিনি, তার মোট সম্পত্তির মূল্যমানও প্রায় সাড়ে তিনশো কোটি রূপির বেশি! গ্যারেজে অডির লেটেস্ট মডেলের বেশ কয়েকটা গাড়ি আছে তার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যে, আছে মার্সিডিজ বেঞ্জের একদম আপডেটেড সিরিজের গাড়িও।
গাড়ির ব্যাপারে ব্রহ্মানন্দমের সৌখিনতার কথা দক্ষিণের ইন্ডাস্ট্রিগুলোর সবাই জানে। এই মানুষটাই আবার অবসরে মাটির মূর্তি বানাতে ভালোবাসেন, রান্না করাটা তার প্রিয় শখ, এবং রাঁধুনি হিসেবে তিনি চমৎকার। তার বাড়িতে এসেছেন, অথচ তার হাতের রান্না না খেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন, এমন অতিথি পাওয়া যাবে না একজনও। দক্ষিণী নায়ক রামচরন আর জুনিয়র এনটিআর তো তার রান্নার বিশাল ভক্ত!
সন্ধ্যার পরে বাড়ি থেকে বের হন না ব্রহ্মানন্দম, পরিবারকে সময় দেবেন বলে। আপাদমস্তক 'ফ্যামেলি পার্সন' তিনি। অভিনয়ের ব্যস্ততায় স্ত্রী আর ছেলেদের থেকে অনেকটা সময় দূরে থাকতে বাধ্য হয়েছেন, এখন তিনি দাদা হয়ে গিয়েছেন, নাতির থেকে দূরে থাকাটা সয় না এখন। আর তাই কাজের পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছেন আগের চেয়ে।
শরীরে বাইপাস সার্জারী হয়েছে তার, বয়সটা তো থেমে নেই, তাই শরীরের সঙ্গে আপোষ করতেই হয়। তবে এই বয়সেও তার সঙ্গে অভিনয়ে পাল্লা দেয়ার মতো কমেডিয়ান শুধু দক্ষিণে কেন, পুরো ভারতেও বোধহয় একজনও নেই। ব্রহ্মানন্দম তো একজনই! তিনি হচ্ছেন পকেট ডায়নামাইটের মতো, সাইজে ছোট, কিন্ত ফাটলে বোঝা যায়, জিনিসটার তেজ কত!