যেখানে গড়পড়তা টিভি সিরিজগুলো শেষ হলে মস্তিষ্কে কোনো রেশ থাকে না, শেষ হলেই ফুরিয়ে যাওয়া যেখানে একমাত্র নিয়তি সেখানে 'ব্রেকিং ব্যাড' মাথায় ভর করে থাকে, ভাবায়, স্বজন-হারানোর অনুভূতি দেয়, জগদ্দল পাথরের মত বুকে চেপে বসে...

'ফিল্ম নোয়ার' জনরাটা বেশ জনপ্রিয় হয় চল্লিশ এবং পঞ্চাশের দশকে, আমেরিকান থিয়েটারগুলোতে। বেশ অন্যরকম, ভিন্নস্বাদের এই জনরার সাথে ডার্ক স্টোরি, শেক্সপিয়ারিয়ান ট্রাজেডি এবং ফ্যামিলি ড্রামার বেশ নির্মেদ এক মিশেল ভিন্স গিলিগ্যানের “ব্রেকিং ব্যাড।“ যে টিভি সিরিজটিকে অনেকেই দাবী করেন, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ টিভি সিরিজ বলে। 

যেকোনো নির্মাণ বিশ্বসেরা হতে গেলে সেই নির্মানের মধ্যে কিছু অতিমানবীয়, শক্তপোক্ত পদার্থ থাকতে হয়। শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিষয়টি আরেকটু দুর্বোধ্য, খানিকটা বিমূর্ত। একটা বই অথবা একটা সিনেমা পাঠকের কিংবা দর্শকের ভালো লাগে কেন? কারণ- লেখক বা নির্মাতা শব্দ অথবা ক্যামেরা দিয়ে অডিয়েন্সের হৃদয়ে একটা সূক্ষ্ম ছিদ্র করে দেন। সেই ছিদ্র ক্রমশ টেনে নেয় কিছু আশ্চর্য আবেশ। ছড়িয়ে দেয় মানসপটে।  সম্মোহনবিদ্যায় বুঁদ করে রাখে অডিয়েন্সকে। এভাবেই একটি গল্প অথবা একটি সিনেমা বা একটি টিভি সিরিজ হয়ে যায় কালোত্তীর্ণ। টিকে যায় সময়ের সব গণ্ডিতেই।

ব্রেকিং ব্যাড দেখা শুরু করে প্রথম সিজন দেখে বিরক্ত হয়ে দেখা বন্ধ করে রাখেনি, এরকম মানুষ নেহায়েত কম না। শুরুতে খুব একটা আকর্ষণ টের পাওয়া যায় না। যেখানে হালের প্রত্যেকটা টিভি সিরিজের প্রথম সীজনের প্রথম এপিসোডের শুরুতেই দমবন্ধের মকশো, সেখানে এখানে কিছুটা উল্টোরথ, স্লো-পেসড ন্যারেশন। তাই বিরক্তি চলে আসাটা স্বাভাবিক। দর্শককেও খুব একটা দোষ দেয়া যাবে না। দ্বিতীয় সিজনও মোটামুটি প্রথম সিজনের মতই। গল্প খানিকটা দ্রুত হচ্ছে, কিন্তু যথেষ্ট মোটেও না।

তৃতীয় সিজনের শুরুতে আস্তে আস্তে “ব্রেকিং ব্যাড” তার খোলস ছেড়ে বেরোতে শুরু করে, এবং এরপরই জাত চেনানোর পালা। সার্কাসের ম্যাজিশিয়ানের মতন ব্ল্যাক হ্যাট থেকে ভোজবাজির মত সাদা কবুতর বের হওয়া শুরু। এভাবে দেখতে দেখতে একদিন শেষ রাতের দিকে যখন “ব্রেকিং ব্যাড” শেষ হয়, বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে, শীতের ভোরবেলায় ঘাসের উপর নেমে আসা একখণ্ড বাউণ্ডুলে কুয়াশার মতন। মস্তিষ্ক "রিল্যাক্স মোড"-এ চলে যায়। সে কিছু ভাবতে চায় না। স্ক্রিনে ক্রেডিট টাইটেল উঠছে। অথচ ভেতরে খামচি মেরে থাকে কী যেন এক শূন্যতা। বিকেলবেলা খেলার মাঠে ধুলো উড়লে যেরকম বিপর্যস্ত শূন্য লাগে, এই সিরিজ শেষ করে ভেতরটা সেরকম শূন্য হয়ে যায়। দীর্ঘ এক ঘটনাবহুল যাত্রা শেষ হলে এরকম অবসাদ আসাই বোধহয় স্বাভাবিক।

“ব্রেকিং ব্যাড” শ্রেষ্ঠ কী না, এ বিতর্কে যাওয়াটা রীতিমত গোয়ার্তুমি হবে। সেটা তোলা থাকুক জীবনানন্দের কালো ট্রাঙ্কে। রহস্য হয়ে। বরং কথা বলা যাক এই টিভি সিরিজের অসাধারণত্ব নিয়ে।

সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে অনেকেই বলেন, তিনি সময়ের চেয়ে আগে ভাবতে পারতেন। তাঁর সিনেমা ফ্রেমিং, সেট ডিটেইলস, প্রম্পটস-প্রপস-ডায়লগে আমরা সময়ের চেয়ে এগিয়ে হাঁটা দেখেছিও। “ব্রেকিং ব্যাড” এর ক্ষেত্রেও মনে হয়েছে, সময়ের আগে আগে এসে চলতে থাকা একটি টিভি সিরিজ। ক্যামেরার কাজই বলা হোক অথবা ডায়লগের ফ্লো, ক্যারেক্টরদের স্টোরি ডেভেলপিং, সাসপেন্স, টুকরো টুকরো মেমোয়ার- এগুলো পাকা হাতের কাজ ছাড়া হয় না। এবং সময়ের আগে হাঁটতে না জানলে এরকম এপিক কিছু বানানোও বেশ অসম্ভব একটা বিষয়।

(স্পয়লার এলার্ট)

“ব্রেকিং ব্যাড” এর একপেশে অসাধারণত্বের পেছনের অন্যতম কারণ, গল্প। সোজা বাংলায় বললে এটা খুবই ছিমছাম, নিষ্পাপ একটা গল্প। রসায়নের একজন মধ্যবয়স্ক স্কুল শিক্ষক হুট করে একদিন জানতে পারেন, তার ক্যান্সার হয়েছে। বেশিদিন বাঁচবেন না। পরিবারে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, পঙ্গু ছেলে। ঘরে সঞ্চয় বলতে গড়ের মাঠ। তিনি স্কুল শিক্ষক। কী ই বা থাকবে?  কিন্তু পরিবারের ভবিষ্যতের জন্যে তার অনেক টাকা দরকার। ঘটনাচক্রে তিনি বানানো শুরু করেন ড্রাগ, এক ড্রাগ ডিলারের সাহায্যে। এই স্কুল শিক্ষক ওয়াল্টার হোয়াইট এবং ড্রাগ ডিলার জেসি পিঙ্কম্যান এর গল্পই এই “ব্রেকিং ব্যাড।“ কিন্তু আসলেই কী তাই?

না, মোটেও না। “ব্রেকিং ব্যাড” অনেকগুলো মানুষের গল্প। ওয়াল্টার হোয়াইট অথবা হাইজেনবার্গের সাথে জেসি পিঙ্কম্যান তো রইলোই। এই টিভি সিরিজ স্কাইলার হোয়াইট, হ্যাঙ্ক শ্রেডার, সল গুডম্যান, মাইক এরমান্ট্রাউট অথবা গাস ফ্রিং এর গল্পও। বলা যাক তাদের গল্পগুলোই। 

হাইজেনবার্গ এবং জেসি পিঙ্কম্যান শেষে আসুক। স্কাইলার হোয়াইট, যিনি হাইজেনবার্গের স্ত্রী, তাকে নিয়েই কলম চলুক আগে। যারা “ব্রেকিং ব্যাড” দেখেছেন তাদের অনেকেই এই চরিত্রটিকে পছন্দ করেননি। এবং ঠিক এ কারণেই এই চরিত্রটি সার্থক। যেমনটা মানুষের ঘৃণার কারণে সার্থক “গেইম অব থ্রোন্স” এর সার্সি অথবা জফ্রির চরিত্র। স্কাইলারের এখানে প্রধান কাজই ছিলো হাইজেনবার্গের কাজগুলোর বিরোধিতা করা। এবং কাহিনীতে কনফ্লিক্ট বাড়ানো। যদিও চরিত্রটিকে আরো খানিকটা ফ্লেক্সিবল, লেস সেন্সিটিভ করা যেতো। অথবা পরিচালক হয়তো ইনটেনশনালি চরিত্রের মধ্যে ক্ল্যাশ এলিমেন্ট বাড়িয়েছেন। যেটাই হোক না কেন, স্কাইলার স্ক্রিপ্টের পুরোটাই এনেছেন, ঠিকঠাকভাবে।

স্কাইলার হোয়াইট

হ্যাঙ্ক শ্রেইডারের জীবনে একটাই স্বপ্ন। সে হাইজেনবার্গকে ধরবে। অথচ হাইজেনবার্গ সম্পর্কে তার ভায়রা। মুদ্রার উল্টোপিঠ জানা হয়না কখনো। পুলের পাশে পোড়া মুরগী, বিয়ার আর পিওর এ্যামেরিকান হিউমার মিশিয়ে হাইজেনবার্গের সাথে নিয়মিতই আড্ডা দেন তিনি। আর দিনরাত এক করে হাইজেনবার্গকেই খুঁজতে থাকেন। গোলগাল এই ভদ্রলোক তার যথেষ্ট উইটি কথাবার্তা এবং একরোখা মানসিকতার জন্যেই রয়ে গেছেন “ব্রেকিং ব্যাড” এর "হল অব ফেইম" এ। একটাই টার্গেট, সেটা নিয়েই রাতদিন পড়ে থাকা, রহস্যভেদের খুব কাছে এসে আবার ছিটকে ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া... সব মিলিয়ে হ্যাঙ্ক শ্রেইডার এই সিরিজের ট্রাজিক হিরো।

হ্যাঙ্ক শ্রেইডার

সল গুডম্যান এতটাই জনপ্রিয় যে, তাকে নিয়ে আরেকটা টিভি সিরিজ করা হয়েছে। “বেটার কল সল” ভিন্স গিলিগ্যানের আরেক অনবদ্য সৃষ্টি। সে নিয়ে নাহয় পরে কথা বলা যাবে। কিন্তু, অতিরিক্ত কথা বলা এবং কথাগুলোর মধ্যে হিউমার এবং লজিকের ডেডলি কম্বিনেশন, সংকটে ঠিকঠাক উপায় বাতলে দেয়া- সল গুডম্যান এই সিরিজের জমকালো উকিল এবং পারফেক্ট কমিক রিলিফও। আবার সে সাথে গল্পের অনেক জায়গায় রয়েছে তার বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসগুলোতে প্রায়ই দেখা যেতো দুয়েকটা আধাপাগলা চরিত্র। আমাদের সল গুডম্যানও যেন সেরকম এক খ্যাপাটে চরিত্র। যে স্ক্রিনে থাকা মানেই কিছু না কিছু উদ্ভট হওয়ার সংকেত এবং দর্শকের নড়েচড়ে বসা। 

সল গুডম্যান

“ব্রেকিং ব্যাড” এর এই বুড়ো শ্যুটার মাঝেমধ্যেই আমাদের ফেলে দিতো অজানা আশঙ্কায়। ঠাণ্ডা, শীতল চোখের দৃষ্টি আর মেপে মেপে কথা বলা; মাইক কিছু কিছু মুহুর্তে ছাপিয়ে গেছেন হাইজেনবার্গ অথবা জেসি পিঙ্কম্যানকেও। মাইকের গল্পটাও কী অসাধারণ। নীরব-নিস্তব্ধ-নিস্তরঙ্গ জীবনের অন্যপাশেই বারুদে ঠাসা এ্যাডভেঞ্চার- বৈপরীত্যের অসাধারণ জংশনে এসে দাঁড়িয়ে থাকা চরিত্রের নাম মাইক এরমান্ট্রাউট।

মাইক এরমান্ট্রাউট

গাস ফ্রিং’কে নিয়ে চাইলে অজস্র শব্দ দেদারসে খরচ করে ফেলা যাবে। মাত্র একটা সীজনের চার এপিসোডের  জন্যে যাকে আনা হলেও দেখতে দেখতে সিজনের এগারোটি এপিসোডেই রয়ে যান যিনি। যার পার্সোনালিটি, চাহনি অথবা হাঁটাচলার মধ্যে কী যেন একটা রয়ে যায়... দেখলেই সম্ভ্রম চলে আসে।  এরকম বোল্ড ইমেজের চরিত্র যেকোনো টিভি সিরিজের জন্যেই এ্যাসেট। গাস ফ্রিং, তিনি মাফিয়া লিডার, তিনি ভিলেন, অথচ তাকে আমরা ঘৃণা করতে পারি না। “দ্য ডার্ক নাইট” এর জোকারই যেন “ব্রেকিং ব্যাড” এর গাস ফ্রিং। যে ভর করে থাকে ভেতরে, যাকে সরিয়ে ফেলা যায় না, যাকে মুছে ফেলা যায় না, যাকে অসম্মান করা যায় না। এবং “ব্রেকিং ব্যাড” এ যার নিজেরও একটা গল্প রয়েছে। যে গল্প প্রতিশোধের, যে গল্প আত্মসম্মানের, যে গল্প “দ্য শো মাস্ট গো অন” এর। হাইজেনবার্গ যদি এ্যাকিলিস হন, গাস ফ্রিং যেন এ মহাকাব্যের হেক্টর। গাস ফ্রিং এর একটা ডায়লগ তো পুরো সিরিজটারই সামারি-

A man provides, and he does it even when he’s not appreciated, or respected, or even loved. He simply bears up and he does it. Because he’s a man.”

গাস ফ্রিং

হাইজেনবার্গ আর জেসি পিঙ্কম্যানের রসায়ন এই টিভি সিরিজের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি। যেখানে স্নেহ আছে, ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নেয়া আছে, আবার ভালোবেসে জড়িয়ে ধরা আছে। যদিও পরিচালক চেয়েছিলেন, এক সিজন পরেই “জেসি পিঙ্কম্যান” চরিত্রটিকে মেরে ফেলবেন। কিন্তু ক্যামেস্ট্রি শুধু মিথ বানাতেই লাগেনা, সম্পর্ক বানাতেও লাগে। সেই ক্যামেস্ট্রির বণ্ডেই হাইজেনবার্গের সাথে আটকে যায় জেসি পিঙ্কম্যান। রইলেন ৫টি সীজনেই। এবং ২০১৯ সালে নেটফ্লিক্সের সিনেমা “এল কামিনো: এ ব্রেকিং ব্যাড মুভি” তেও রইলেন সরব। রগচটা, খামখেয়ালি আবার মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড ইমোশনাল হয়ে যাওয়া এ চরিত্রটি মাঝেমধ্যে বিষণ্ণ করেছে, মাঝেমধ্যে কাঁদিয়েছে, করেছে বিরক্তও কখনোসখনো। মানসিক অস্থিরতা, সুস্থ জীবন, অসুস্থ জীবন, টালমাটাল সবকিছুর মাঝখানের এক ভালনারেবল ক্যারেক্টার, জেসি পিঙ্কম্যানে উঠে এসেছে সবকিছুই। এক ফোঁটা বাড়তি আদিখ্যেতা ছাড়াই।

জেসি পিঙ্কম্যান

হাইজেনবার্গ চরিত্রটি নিয়ে মুগ্ধতার শেষ নেই। এই চরিত্রটি একেকবার একেক ভাবে ধরা দিতে পারে দর্শকের কাছে। কখনো তিনি রহস্যময় হাইজেনবার্গ, কখনো মানবিক বাবা, অসুস্থ স্বামী অথবা দুর্বোধ্য আত্মীয়। একটা চরিত্রের মধ্যে এতগুলো লেয়ার অথচ প্রত্যেকটা লেয়ারই বোঝা যাচ্ছে আলাদা আলাদাভাবে, একটির সাথে আরেকটি মিশে যাচ্ছে না। এই বিষয়টি মেন্টেইন করা খুবই কঠিন। এই চরিত্রটি নিয়ে আরেকটি অসাধারণ কাজ লক্ষ্য করি আমরা। যেকোনো গল্পের মূখ্য চরিত্রকে “অদমনীয়” করার একটা প্রবণতা সব গল্প লেখকেরই থাকে। “কিং ক্যান ডু নো রং” এর মতন “প্রোটাগনিস্ট ক্যারেকটার ক্যান ডু নো রং” এই নীতিতেই গল্পগুলো এগোয়। কিন্তু ভিন্স গিলিগ্যান এখানে চলেছেন উল্টো মার্জিনে। এখানে হাইজেনবার্গকে আমরা ক্রমশ ভুল করতে দেখি, মানসিকভাবে যুঝতে দেখি পরিস্থিতির সাথে, বিপর্যস্ত হতে দেখি, পরিবারকে বাঁচানোর নির্মম আকুতিও দেখি। আমরা  বুঝতে পারি, হাইজেনবার্গ কোনো ফ্যান্টাসি না, যিনি অসাধারণ হবার চেষ্টা করছেন শুধু তার পরিবারের জন্যে। নিজে মাথা উঁচু করে শেষ বিদায় নেবার জন্যে। কী অসাধারণ!

ওয়াল্টার হোয়াইট- হাইজেনবার্গ

মুখ্য চরিত্রগুলোর পরে পার্শ্ব-চরিত্রগুলো যে সাপোর্ট দিয়েছে পুরো সিরিজে, তা অনবদ্য। ম্যারি, ওয়াল্টার জুনিয়র, স্টিভেন গোমেজ, ম্যাট, স্কিনি পিট, জেইন, টড, লিডিয়া... নিজ নিজ এ্যাঙ্গেল থেকে সবারই গণ্ডি স্পষ্ট, সবাই রেশ রেখে গিয়েছে নিজের মত করেই। আরোপিত মনে হয়নি কিছুই। অতি-অভিনয় তো নয়ই। সহজপাচ্য এবং নিটোল গল্পগুলো নিয়মিত ভাবে পরিণত হয়েছে। দর্শককেও আক্ষেপ রাখার জায়গা দেয়নি একবিন্দু।

“ব্রেকিং ব্যাড” এর সবচেয়ে উজ্জ্বল দিক যদি বলা হয় এর গল্প, তাহলে সেই গল্পটার ভেতরে দর্শককে নিমেষে বিভাজ্য করার ক্রেডিট অবশ্যই পাবে চরিত্রগুলো। এত ছিমছাম, নিঁখুত এক্সিকিউশন করতে আসলে ভেতরে প্রচুর দম লাগে। সেটাই দেখতে পাওয়া যায় এখানে । প্রত্যেকটা চরিত্রকে যত্ন নিয়ে নিয়ে তিলে তিলে বানানো, কোনো চরিত্র শেষ হয়ে গেলেও এন্ডিং টা খুব গভীরভাবে দেখানো, এই সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ বিষয়গুলো আস্তে আস্তে ব্যবধান বাড়ায়, যাত্রা শুরু করে "ভালো" থেকে "অসাধারণ" এর দিকে। দর্শকদের চাহিদার মুখে যেখানে অধিকাংশ টিভি সিরিজই বছরের পর বছর ধরে এগোতে থাকে কোনো কাহিনী বা ঘটনা ছাড়াই, সেখানে “ব্রেকিং ব্যাড” থেমে যায় পাঁচ সিজনেই। পরিচালক স্বীকার করে নেন, তিনিই চাননি আর বাড়ুক এই সিরিজ।

এই টিভি সিরিজে চরিত্রগুলো যেমন পাল্লা দিয়ে ভালো অভিনয় করেছে, সিজনগুলোও তেমনি। প্রত্যেক সিজন ছাড়িয়ে গিয়েছে আগেরটিকে। প্রথম দুই সিজনের মন্থরগতির কথা তো বলাই হলো। কিন্তু আস্তে আস্তে গতি বাড়িয়ে  সেই টিভি সিরিজের শেষ সিজনই যেন হয়ে গেলো বিস্ফোরকে ভরা বোমা। শেষ সিজনের চৌদ্দ নাম্বার এপিসোড আইএমডিবির ইতিহাসেরই এক নাম্বার এপিসোড, পারফেক্ট ১০/১০ রেটিং পেয়ে। শেষমেশ আইএমডিবিতে ৯.৫/১০ রেটিং নিয়ে যাত্রা শেষ করেছে পুরো “ব্রেকিং ব্যাড।“ ক্রমশ রেটিং কমে যাওয়ার এ যুগে “ব্রেকিং ব্যাড” এখানেই হয়ে গেছে বিপরীতধর্মী কিছু।

দর্শকের মোরালিটি, কন্সায়েন্সকেও এক প্যান্ডোরার বক্সে ঠেলে দেয় এই টিভি সিরিজ। দর্শক পর্দায় দেখছে,  হাইজেনবার্গ ড্রাগ বানাচ্ছে, অবৈধভাবেই টাকা ইনকাম করছে। মানুষ মারছে। তবুও তার জন্যে দর্শকের একটা সফট কর্ণার থেকেই যায়। পরিচালক প্রথমেই সেই সিম্প্যাথির ফিল্ডগুলো ওপেন করে দেন। তাই হাইজেনবার্গের দাম্ভিক উক্তি- 

“I am not in Danger, I am the Danger”

শুনে দর্শক হাততালি দেয়, খুশি হয়, ভয় পায় না। ঠিক এভাবেই মোরালিটির লিটমাস টেস্টে সবাইকে হারিয়ে দেয় ভিন্স গিলিগ্যান এবং তার স্ক্রিপ্ট।

দুর্দান্ত স্টোরিটেলিংয়ের এক নজির হয়ে থাকবে এই সিরিজটি

এরকম সহজ-সরল অথচ ঠাসা ক্রাইসিস এবং অনেক চরিত্রের টিভি সিরিজগুলোর এন্ডিংটা একটু মুন্সিয়ানায় করতে হয়। নাহয় চরিত্রগুলোর ওপরে সুবিচার করা যায় না। গল্পটাও দলা পাকিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। দর্শক বিরক্ত হয়ে পড়ে। ভালো টিভি সিরিজগুলোর ঝামেলা আরও বেশি। এমনিতেই দর্শকদের প্রত্যাশার পারদ মনুমেন্টের ডগায় থাকে। তাই এক চুল ভুল হলেই লেজেগোবরে অবস্থা। সেদিক দিয়ে বলতে গেলে আর কোনো টিভি সিরিজে এরকম পারফেক্ট এন্ডিং, এরকম মেলানকোলিক স্নোফল ব্যক্তিগতভাবে চোখে পড়েনি। পর্দার চরিত্রগুলোর ক্রমশ জীবনের সাথে মিশে বিলীন হয়ে যাওয়ার এই ৬২ পর্বের জার্নি, যার পরতে পরতে রয়ে যায় ছোট ছোট চরিত্র, টুকরো টুকরো গল্প, বিষণ্ণ সময়। কাউকে বিশ্লেষণ করার আগে তাই দু’বার ভাবতে হয়। হিমশিম খেতে হয়, কে ঠিক আর কে ভুল তা নির্ধারণ করতে। এরকম প্যারাডক্সিকাল ন্যারেশনের মধ্যে আটকে থাকে সবাই।

সিরিজের নামটাও এসেছে প্যারাডক্সিকাল এক কলোকুইয়ালিজম থেকে। ভিন্স গিলিগ্যান ভার্জিনিয়ার যে অংশে থাকতেন, সেখানে এই “ব্রেকিং ব্যাড” টার্মটা বেশ ব্যবহার করা হতো। কেউ উচ্ছন্নে গেলে যেমন বলা হয়- গোল্লায় গিয়েছে। ওখানে বলা হতো- ব্রেকিং ব্যাড। সেখান থেকেই এই এপিকের নামকরণ। ভিন্স গিলিগ্যান যেটার অন্য অর্থ বলেছেন- To Raise Hell.

একজন লেখক, একজন পরিচালক একটা জিনিস তৈরী করেন অনেকগুলো জিনিস ভেবে। এরমধ্যে কর্মাশিয়াল পারস্পেক্টিভটা খুবই উজ্জ্বল। শিল্পকে ছাপিয়েও কর্মাশিয়াল সাইডটা বেশি স্ট্রং হয়ে যায় যেকোনো কন্টেন্ট এর ক্ষেত্রে। এরমধ্যেও কিছু কিছু ক্রিয়েশন এমন হয়, সময়ের পর সময় চলে যায়। জেনারেশন চেঞ্জ হয়, কিন্তু ক্রিয়েশনের কদর ঠিক একইরকম রয়ে যায়। এদেরকেই বলা হয় কালোত্তীর্ণ অথবা কালজয়ী সৃষ্টি। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে- ব্রেকিং ব্যাড নিঃসন্দেহে এক অস্থির সময়ের কিছু অস্থির মানুষের বিক্ষিপ্ত পথচলার গল্প। যাদের লক্ষ্য ভিন্ন, গতিপথ ভিন্ন, কাজের ধরণ ভিন্ন। কিন্তু সবমিলিয়ে তারাই আবার এক মলাটের বই। যে বই নিয়ে মাতামাতি, গুনমুগ্ধ আলোচনা-সমালোচনা হয় আজও। এবং ভবিষ্যতেও হবে। যেখানে গড়পড়তা টিভি সিরিজগুলো শেষ হলে মস্তিষ্কে কোনো রেশ থাকেনা, শেষ হলেই ফুরিয়ে যাওয়া যেখানে একমাত্র নিয়তি- সেখানে "ব্রেকিং ব্যাড" মাথায় ভর করে থাকে, ভাবায়, স্বজন-হারানোর অনুভূতি দেয়, জগদ্দল পাথরের মত বুকে চেপে বসে।

এবং এভাবেই মাস্টারপিসের জন্ম হয়! এভাবেই তৈরী হওয়া কাল্টগুলো টিকে থাকে সময়ের সীমানাকে থোড়াই কেয়ার করে।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা