হামলাকারী খুনির বিচার করেছে নিউজিল্যান্ড, আমরা কি কখনও করতে পারব?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মসজিদে হামলা চালিয়ে পঞ্চাশজন মুসলমানকে খুন করা উগ্রপন্থী ব্রেন্টন টারান্টের সর্বোচ্চ শাস্তি মাত্র দেড় বছরে নিশ্চিত করেছে নিউজিল্যান্ড, অথচ আমাদের দেশে ব্লগারদের কুপিয়ে মারার মামলাগুলো পড়ে আছে হিমঘরে...
গত বছরের মার্চে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে হামলা করে প্রায় পঞ্চাশজন নিরীহ মুসলমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল উগ্রপন্থী খ্রিস্টান ব্রেন্টন টারান্ট। ঘটনার প্রায় দেড় বছর পর গতকাল নিউজিল্যান্ডের আদালতে সেই মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে টারান্টকে। নিউজিল্যান্ডে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই, দেশটির আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তিই পেয়েছে টারান্ট। রায়ে আদালত বলেছেন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের এই সাজায় ব্রেনটন কোনো প্যারোল পাবেন না। নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হলো। অর্থাৎ, ঘৃণ্য এই অপরাধীকে বিন্দুমাত্র অনুকম্পা উপহার দেয়নি বিচার ব্যবস্থা।
আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে ব্রেন্টন টারান্ট স্বীকার করেছিল, কেন সে এমন জঘন্য ঘটনা ঘটিয়েছিল। পুরো ব্যাপারটা তার কাছে ছিল একটা প্রতিশোধের মতো। ২০১৭ সালের এপ্রিলে উজবেকিস্তানের এক জঙ্গী একটা বিয়ারভর্তি ট্রাক ছিনতাই করে সেটা উঠিয়ে দিয়েছিল ফুটপাথের ওপরে, নিহত হয়েছিল আটজন নিরপরাধ মানুষ, তাদের একজন ছিল এবা অকারলাউন্ড। ১১ বছর বয়সী এবা অকারলান্ড কানে শুনতে পেতো না। রাস্তা পারাপারের সময় মা ওর হাত ধরে রাখতেন, মেয়েটা শ্রবণ প্রতিবন্ধী, কথাবার্তাও খুব একটা বলে না, কি থেকে কি হয়ে যায় কোন ঠিক ঠিকানা নেই। মায়ের এত সতর্কতাও বাঁচাতে পারলো না এবাকে, ঘাতক এক ট্রাক কেড়ে নিয়েছিল তার প্রাণপ্রদীপ। টারান্ট দাবী করেছিল, এবার হত্যার প্রতিশোধ নিতেই নাকি সে গুলি করে নিরীহ মুসলমান হত্যার মিশনে নেমেছিল!
যে শটগানটা দিয়ে বেন্টন পাখির মতো গুলি করে মানুষ মেরেছে, সেটার ওপরের অংশে ইংরেজীতে লেখা ছিল একটা বাক্য, যেটার বাংলা করলে দাঁড়ায়- 'এবা'র মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে...' পুলিশের কাছে ধরা পড়ার পরেও এই একই কারণটাই বলেছে বেন্টন, তার ধারণা, মুসলমানদের হত্যা করলেই নাকি এবা মেয়েটার আত্মা শান্তি পাবে! মানসিকতা কতটা বিকৃত হলে এক-দুইজন মানুষের কৃতকর্মের দায় পুরো একটা জাতির ওপরে দিয়ে তাদেরকে এভাবে পিশাচের মতো খুন করা যায়, সেটা ভাবতেই অবাক লাগে!
শুধু তা-ই নয়, খুনের আগে ৭৩ পৃষ্ঠার একটা ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেছিল বেন্টন, সেটার প্রতিটা পাতাজুড়ে লেখা ছিল মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা। এই জাতিটাকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করা দিতে হবে, এমনটাই ছিল বেন্টনের অভিমত। নিজের টুইটার একাউন্টে এবা'র একটা ছবি ঝুলিয়ে রেখেছিল সে, নিচে লিখে দিয়েছিল, 'এদেরকে(মুসলমানদের) নিশ্চিহ্ন করা ছাড়া আমাদের থামা উচিত নয়!' এবা মরে গেছে, বেঁচে থাকলে এই দৃশ্যটা দেখে হয়তো আরেকবার মরে যাওয়ার ইচ্ছে হতো ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়েটার।
ব্রেন্টন টারান্ট সাজা পেয়েছে, তার বাকি জীবনটা কাটবে জেলে, আপনজন কেউ মারা গেলে বা সে নিজে গুরুতর অসুস্থ হলেও প্যারোলে বের হতে পারবে না জেল থেকে। ব্রেন্টনের সাজা পাওয়ার ঘটনাতেই মনে পড়লো, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার নামে এই দেশে ভিন্ন মতাবলম্বীদের রাস্তায় ফেলে কুপিয়ে মারা হয়েছে একের পর এক, দিন গেছে, মাস গেছে, বছর গেছে, ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টেছে কেবল; আমরা তো হতভাগ্য সেই মানুষগুলোকে বিচার এনে দিতে পারিনি।
হুমায়ূন আজাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছিল টিএসসির সামনে, সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের পাশে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে অভিজিৎ রায়কে, মেধাবী মানুষটার মগজ পড়েছিল রাস্তায়, আহত হয়েছিলেন তার স্ত্রী বন্যা আহমেদও। তদন্ত হয়েছে, সন্দেহভাজন কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল, এরপর শীতনিদ্রায় গেছে ব্যাপারটা। এর আগে পরে মৌলবাদীদের হাতে মৃত্যুর মিছিলে নাম লিখিয়েছেন ব্লগার রাজীব, ওয়াসিকুর, অনন্ত বিজয়, নিলয় নীলরা। প্রাণের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে দেশ ছেড়েছেন অনেক ব্লগার। শুধুমাত্র লেখালেখির জন্য কাউকে বোধহয় এতটা শাস্তি পেতে হয়নি।
এদেশে ব্লগার হত্যার পরে অজস্র অমানুষকে আমরা খুশিতে বগল বাজাতে দেখেছি। নাস্তিক পেলেই কতল করতে হবে- এরকম মানসিকতা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো লোকজন তো আশেপাশেই আছে অজস্র। এরা সরাসরি কোপায় না হয়তো, কুপিয়ে মেরে ফেলাটাকে জাস্টিফাই করে খুব সুচারুভাবে। এই মানসিকতার সঙ্গে ব্রেন্টন টারান্টের মানসিকতার খুব একটা পার্থক্য নেই। একজন উগ্রপন্থীর করা হামলার দায় গোটা সম্প্রদায়ের ওপর চাপিয়ে টারান্ট চেয়েছিল পুরো মুসলমান জাতিটাকে সে ধ্বংস করে দেবে, এতে নাকি এবা'র আত্মা শান্তি পাবে! আর আমাদের দেশের মৌলবাদিরা বিশ্বাস করে, ধর্ম নিয়ে কেউ আলোচনা-সমালোচনা করলে তাকে মেরে ফেলতে হবে, তাহলে পাওয়া যাবে জান্নাত!
অনেকেই বলবেন, নিউজিল্যান্ড উন্নত রাষ্ট্র, সেখানকার বিচার ব্যবস্থা ভালো, পুলিশিং ভালো, সেখানে দেড় বছরে হত্যাকান্ডের বিচার হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমি এটা মানতে মোটেই রাজী নই যে বাংলাদেশে পুলিশ বহির্বিশ্বের তুলনায় কোন অংশে পিছিয়ে আছে; বরং সীমিত সম্পদ আর নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দারুণ কাজ করছে তারা। চাইলেই যে কোন অপরাধীকে গ্রেপ্তার করাটা তাদের জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাহলে বাংলাদেশে কেন গণ্ডায় গণ্ডায় ব্লগার হত্যা হলেও সেসবের বিচার হচ্ছে না? কেন তদন্ত পড়ে আছে হিমঘরে? ঠিক এখানেই সদিচ্ছার প্রশ্নটা আসে। ব্লগার হত্যার বিচার করতে গিয়ে সরকার মৌলবাদিদের ক্ষেপিয়ে দিতে চায় কিনা- এই প্রশ্নটাই বড় হয়ে ওঠে মাঝেমধ্যে।
ব্যক্তিগতভাবে দুটো ব্যাপারে সবচেয়ে খারাপ লেগেছে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের অবস্থান দেখে। নিউজিল্যান্ডে মুসলিম কমিউনিটির ওপরে হামলার পরপরই সেদেশের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরদার্ন জোর গলায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, টারান্ট নামের এই খুনি জঙ্গিকে সর্বোচ্চ শাস্তিই দেয়া হবে। জেসিন্ডা পুরো সময়টা জুড়ে মুসলমানদের পাশে থেকেছেন, শোকসভায় অংশ নিয়েছেন, পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে অসাম্প্রদায়িকতার ডাক দিয়েছেন, নিউজিল্যান্ডের পার্লামেন্টে সেই ঘটনার পর কোরআন তেলাওয়াত করা হয়েছে, জেসিন্ডা এবং তার সরকার সর্বতোভাবে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন, মুসলমানরা মাইনোরিটি নয়, তাদের পাশে পুরো দেশ আছে।
অথচ আমাদের দেশে ব্লগারদের ওপর একের পর এক হামলা হলেও, রাষ্ট্রযন্ত্র খুব একটা আমল দেয়নি ঘটনাগুলোতে। বরং রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তিরা বলেছেন, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়, লেখালেখির মাধ্যমে কারো অনুভূতিতে আঘাত দিলে সেটা মেনে নেয়া হবে না। মৌলবাদিদের আস্ফালনের মুখে 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত' দেয়ার অভিযোগে ব্লগাররা গ্রেপ্তার হয়েছেন, জেলও খেটেছেন। একটা রাষ্ট্র যখন হত্যাকান্ডের বিচার করার চাইতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার বিচারটা আগে করতে চায়, সেই দেশে মৌলবাদিদের যে বাম্পার ফলন হবে, সেটা অনুমেয়। আফসোস, এই মৌলবাদিরা সরকারের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য কতটা ক্ষতিকর হয়ে উঠবে একটা সময়ে, সেটা রাষ্ট্রযন্ত্র বুঝতেও পারছে না হয়তো!
খুব সামান্য একটা ব্যাপার কারো মাথায় ঢোকে না, একটা মানুষের লেখনীর জবাব তাকে লেখা দিয়েই দেয়া উচিত। কেউ যুক্তি দিয়ে ধর্মের ভুল বের করতে চাইলে তাকেও পাল্টা যুক্তির মাধ্যমেই উত্তর দিতে হবে। সেটা না করে কলমের বদলে কেউ যখন বন্দুক বা চাপাতি তুলে নেয় হাতে, তাও আবার ধর্মের নাম করে- সেটার চেয়ে ন্যাক্কারজনক আর কিছুই হতে পারে না। এতে করে ধর্মকে অপমান করা হয়। ধর্মের নাম নিয়ে কাউকে হত্যা করা হলে ধর্মের মাহাত্ম্য বাড়ে না, বরং সবার মধ্যে একটা ভীতির সঞ্চার হয়- অথচ ধর্ম কোন আতঙ্কের বিষয় নয়, হবার কথাও ছিল না!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন