মোটরবাইকে চড়ে কেউ বিয়ে করতে গেলে ধর্মান্ধদের ইজ্জত যায়, বোরকা পরে কেউ ক্রিকেট খেললে প্রগতিশীলদের আঁতে ঘা লাগে। কেউ বলে ধর্ম গেল, সংস্কৃতি গেল রে, আবার কেউ বলে দেশটা পাকিস্তান-আফগানিস্তান হলো রে...

১১ বছরের শিশু শেখ ইয়ামিনকে নিয়ে প্র‍্যাকটিস গ্রাউন্ডে এসেছিলেন মা ঝর্ণা আক্তার। পল্টন ময়দানে কবি নজরুল ইসলাম একাডেমির হয়ে ক্রিকেট অনুশীলন করে ইয়ামিন। ক্রিকেটের প্রতি ছেলেটার অগাধ ভালোবাসা, হতে চায় সাকিব আল হাসানের উত্তরসূরি। ছেলে স্বপ্ন দেখে, পেছন থেকে সাহস যোগান মা। নিজেই ছেলেকে নিয়ে আসেন অনুশীলনে। সেদিনও এসেছিলেন, কিন্ত আগেভাগে এসে দেখেন, কোচ বা ইয়ামিনের সতীর্থ ক্রিকেটাররা কেউই তখন আসেননি। 

ঝর্না আক্তার তখন নিজেই ছেলের প্র‍্যাকটিস পার্টনার হয়ে গেলেন। ইয়ামিন বল করে, ঝর্না আনাড়ি হাতে ব্যাট চালান, কিন্ত বলের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে পারেন না। মাকে আউট করার পরে ইয়ামিনের সে কি উল্লাস! পরে ঝর্না বোলিংটাও করলেন, দৌড়ে এসে বল ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন ছেলের জন্য। কঠোর ইসলামিক অনুশাসন মেনে চলেন ঝর্না আক্তার, বাসা থেকে বের হবার সময় বোরকা-নেকাব ছাড়া বের হন না। ক্রিকেট মাঠে বোরকা পরে একজন মহিলা ব্যাটিং-বোলিং করছে, এটা আমাদের দেশের বাস্তবতায় অবাক করার মতোই দৃশ্য। ডেইলি স্টারের আলোকচিত্রী ফিরোজ আহমেদ এবং ঢাকা ট্রিবিউনের আলোকচিত্রী মোঃ মানিক তখন সেখানেই ছিলেন, ক্যামেরায় সেই মুহূর্তগুলোকে বন্দী করতে ভুল করেননি তারা। 

ঝর্না আক্তার ও ইয়ামিনের ছবিগুলো অনলাইনে ছড়িয়ে পড়তে না পড়তেই ভাইরাল হওয়া শুরু করলো, কারণ এমন দৃশ্য তো নেটিজেনরাও কখনও দেখেনি! বোরকা-নেকাবে আচ্ছাদিত একজন মা তার ছেলের ক্রিকেট খেলার সঙ্গী হয়ে যাচ্ছেন, সমাজ-সংসারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ছেলের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন, ধর্ম মেনে, পর্দা করেও যে সবকিছু করা যায়, সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছেন- প্রশংসা আর হাততালি ঝর্না আক্তারের প্রাপ্য ছিল। 

ছেলের ক্রিকেট খেলার সঙ্গী হয়েছেন মা। ছবি- ফিরোজ আহমেদ

কিন্ত সব ইস্যুতেই দুই ভাগ হয়ে যাওয়া আমাদের পুরনো অভ্যাস। এখানেও দুই ভাগ হতে সময় লাগলো না খুব বেশি। অনেকে বলা শুরু করলেন, ঝর্না আক্তারের পোশাকে কোথাও বাঙালীয়ানার ছাপ নেই, এই আরব্য পোশাক পরিহিতা নারীকে নিয়ে এত মাতামাতির কিছু নেই। অদ্ভুত ব্যাপার! ঝর্না আক্তার ছেলেকে ক্রিকেট প্র‍্যাকটিস করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন, 'এসো বাঙালী নারী সাজি' টাইপের কোন রিয়েলিটি শো-তে তো অংশ নিতে যাননি! তার পোশাক নিয়ে কেন এত আলোচনা? তিনি বোরকা পরে আছেন নাকি শার্ট-প্যান্ট- সেটা নিয়ে কেন এত কথা হবে? এসব কথা বলার অধিকারই বা আমাদের কে দিলো?

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঝর্নার পোশাকের দিকে যারা আঙুল তুলেছেন, তাদের নিরানব্বই শতাংশই নিজেদের প্রগতিশীল হিসেবে দাবী করেন, পোশাকের স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে বড় বড় বুলি কপচান। অথচ সেই মানুষগুলোকেই দেখলাম হিপোক্রেটের মতো নিজেদের নিয়ম-নীতি বিসর্জন দিয়ে সেই মায়ের সমালোচনায় মেতে উঠলেন, ঠিক যেমনটা প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধরা করে,।ধর্ষনের পেছনে পোশাকের দোষ খুঁজে পায়, কেউ নিজের মন মতো পোশাক পরলে তাকে নিজের গরজে পর্দা করার সবক দিয়ে আসে। 

অথচ কথা হতে পারতো বোরকা পরেও ঝর্না আক্তারের মাঠে নামা নিয়ে। ধর্মভীরু এই নারী সমাজ আর পরিবারের হাজারটা প্রতিবন্ধকতার শেকলে আবদ্ধ থেকেও ছেলের স্বপ্ন পূরণে নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছেন, যেটা অনেক প্রগতিশীল বা 'তথাকথিত' আধুনিক মনস্ক বাবা-মায়ের মধ্যেও দেখা যায় না। বোরকা পরে তিনি মাঠে নেমেছেন, ব্যাট-বল হাতে তুলে নিয়ে ছেলের খেলার সঙ্গী হয়েছেন, এদেশের কয়জন বাবা-মা পারেন এটা করতে? বাংলা মায়ের হার না মানা চেহারাটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নেকাবের আড়ালে ঢাকা ঝর্নার মুখে। অথচ 'প্রগতিশীল' আর 'নারীবাদী' লোকজন সেসব ওভারলুক করে গিয়ে পড়ে রইলেন ঝর্নার পোশাক নিয়ে, যেমনটা ধর্মান্ধরা করে। তারা বললেন, বাঙালি চেতনা আজ হুমকির মুখে, দেশ তো আফগানিস্তান-পাকিস্তান হয়ে যাচ্ছে! 

মা-ছেলের আনন্দ। ছবি- মোঃ মানিক

এই ছবিতে বাঙালি চেতনা বাস্প হয়ে উড়ে হাওয়ায় মিশে গেল কিনা, এটা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই। আমি দেখি এই বাচ্চাটার খুশি, ছেলেকে সঙ্গে দিতে পেরে মায়ের তৃপ্তি। কেউ বিকিনি পরলে যেমন দেশ ইউরোপ-আমেরিকা হবে না, কেউ বোরকা-নেকাব হাতমোজা-পা মোজা পরলেও দেশ আফগানিস্তান বা পাকিস্তান হবে না। বোরকা-নেকাব যেমন এদেশীয় পোশাক না, জিন্স-টিশার্টও বঙ্গদেশীয় না। ব্যক্তিস্বাধীনতার চর্চাটা ঠিক এই জায়গায় ভীষণ দরকার। স্বাগত জানাতে কেউ বলেনি, শুধু অন্যের ক্ষতি করে না- এমন ব্যাপারে যার যার পছন্দটাকে মেনে নিতে শেখা প্রয়োজন। 'মাই লাইফ মাই রুলজ' ব্যাপারটা শুধু আপনার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ভাবলে ভুল করবেন; তাদের জীবনে তাদের নিয়ম চলবে, আপনার বা আমার নিয়মে না।

এই প্রসঙ্গেই একটা ঘটনার কথা মনে পড়লো। কিছুদিন আগে যশোরের এক তরুণী গায়ে হলুদের দিন মোটরসাইকেলে চড়ে তার কাজিন ও বন্ধুদের নিয়ে একটা শো-ডাউন করেছিলেন। ফারহানা আফরোজ নামের সেই তরুণী মোটরসাইকেল চালাতে জানেন, অনেক আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন, নিজের বিয়েতে বাইকে চড়ে ফটোগ্রাফি করবেন। সেই ছবি অনলাইনে আসামাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়লো 'ফেসবুক মুমিনেরা', ফারহানাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা হলো, বলা হলো, এই তরুণীর জন্য নাকি সমাজ উচ্ছন্নে যাচ্ছে, সংস্কৃতি ধ্বংস হচ্ছে, ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত আসছে! 

মোটরসাইকেলে চড়ে গায়ে হলুদের ফটোসেশন করেছিলেন ফারহানা

এতসব অভিযোগ শুনে যে কেউই মাননীয় স্পিকার হয়ে যেতে বাধ্য। ফারহানা কারো ক্ষতি না করে নিজের টাকায় মোটরবাইক নিয়ে শোডাউন করছেন, ছবি তুলছেন, তাতে সমাজ-সংসার আর ধর্ম রক্ষাকারীদের কেন এত আঘাত লাগছে? যেটা নিয়ে ফারহানার পরিবার বা তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের আপত্তি নেই, সেটা নিয়ে ফেসবুক ইউজারদের কেন এত আপত্তি? ফারহানার সমালোচনা করতে হলে তার মাথায় হেলমেট কেন নেই, মুখে মাস্ক কেন নেই, সেটা নিয়ে করা যেতো। প্রশ্ন করতে চাইলে গায়ে হলুদ বা বিয়ের অনুষ্ঠানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা হয়েছিল কিনা, সেটা জানতে চাওয়া যেতো। মোটরসাইকেলে চড়ে বিয়ে করাটাকে ইস্যু করা মানেই মূল বিষয় ছেড়ে বাজে উদ্দেশ্যে জিনিসটাকে অযথা বিতর্কিত করা, ঝর্না আক্তারের বেলায় যেটা সো কল্ড প্রগতিশীলরা করেছেন। 

অদ্ভুত একটা অবস্থা; মোটরবাইকে চড়ে কেউ বিয়ে করতে গেলে ধর্মান্ধদের ইজ্জত যায়, বোরখা পরে কেউ ক্রিকেট খেললে প্রগতিশীলদের আঁতে ঘা লাগে। কিছু কিছু ব্যাপারে দুই প্রজাতি প্রায় একই রকমের রিয়্যাকশন দেখায়। নিজেদের প্রগতিশীল বা আধুনিক দাবী করা লোকজন যখন প্রতিক্রিয়াশীলদের মতো আচরণ করেন, তখন হতাশা চেপে রাখা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়, 'সব রসুনের এক কোয়া' প্রবাদটাকে সত্যি বলে মনে হয়। প্রগতিশীল হওয়াটা মুখের কথা নয়, প্রোফাইলে অভিজিৎ রায়ের ছবি ঝুলিয়ে দিলেই প্রগতিশীল হওয়া যায় না। পরমত সহিষ্ণুতা ব্যাপারটা আয়ত্ব করা খুব কঠিন। যতোই লোকদেখানো প্রগতিশীলতার চর্চা করা হোক, নারীবাদী হয়ে নারীর নামে ত্রৈমাসিক পত্রিকা চালানো হোক, সেই মানুষগুলোও যে মনের মধ্যে অযৌক্তিক ঘৃণার ভিসুভিয়াস পুষে রাখেন- সেটাই পরিস্কার হয়ে গেল ঝর্না আক্তারের এই ঘটনায়...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা