একটা ব্র্যান্ড আপনাকে দিনের পর দিন ঠকিয়ে যাবে, আর আপনার কিছুই চোখে পড়বে না? ব্র্যান্ডগুলো যদি নিজেরা এতটা বোকা না হয়ে থাকে, তবে কিভাবে তারা ধারণা করে যে বাকী সবাই এররকম বোকা?
এই ছবিটার ব্যাপারে অনেকের মন্তব্য এবং মতামত দেখছিলাম। সবচেয়ে পপুলার যে দুটি ধারণা খেয়াল করলাম সেগুলো হলো-
১) "যেহেতু এই কাজ ক্যাডবেরী'র মত কোম্পানী বেশ কয়েকবছর ধরেই করে যাচ্ছে, সেহেতু এতে আসলে কোনো ক্ষতি নেই। করাই যায় ।"
২) "কনজ্যুমার খেয়াল করে না, বা মনেও রাখে না। তাই এধরণের কাজ করলে ক্ষতি নেই।"
দুটোই আমার কাছে খুব ভুল মনে হয়, বিশেষত, যারা নবীন মার্কেটিয়ার আছেন, তাঁদের মনে উপরের ধারণাদুটি গেঁথে গেলে খুব মারাত্নক ফলাফল হতে পারে! কেন? বলছি।
১) ক্যাডবেরী কিংবা এরকম অন্য কেউ কেনো এবং কিভাবে এই জিনিষ বছরের পর বছর ধরে করছে জানেন? বিজনেসে গ্রোথ আসে দুই ভাবে: ক) বেশী কনজ্যুমারকে পাবার মাধ্যমে, আর খ) একই কনজ্যুমারকে বেশী পরিমানে পণ্য কেনানোর মাধ্যমে। উন্নয়নশীল দেশে, বিশেষ করে যেসব উন্নয়নশীল দেশের জনসংখ্যা অনেক বেশী সেসব দেশে যুগের পর যুগ শুধুমাত্র বেশী কনজ্যুমারকে ধরার মাধ্যমেই বিজনেস বাড়ানো যায়।
আর চকলেট বা একটু প্রিমিয়াম ক্যাটাগরীর ক্ষেত্রে এই সময়টা আরও অনেক বেশী লম্বা হতে পারে, কারণ এঁদের বিক্রির পরিমাণ খুব কম থাকে এবং খুবই আস্তে আস্তে বাড়ে। ধরুন, একটু হাই-প্রাইসের চকলেট ক্যাটাগরীর (যেখানে ক্যাডবেরী অপারেট করে), তাদের বিক্রির হারটা বাংলাদেশে কত? খুব বেশী হলে ২%-৫%। তাও আবার এত বছর ধরে অপারেট করার পরও। তার মানে, বাৎসরিক বিক্রির হার বৃদ্ধি ০.২০% - ০.৫০% এর চাইতে বেশী নয়।
এখন যদি এই ধরণের অফার দিয়ে বিক্রির এই হারটাকে চট করে ০.৫০% - ০.৭৫% পর্যন্ত বাড়াতে পারে, সেটি কিন্তু বিজনেস গ্রোথের পার্সেন্টেইজে খুবই বিরাট, প্রায় ২০%-৪০% গ্রোথ! তার মানে, এই ধরণের ধোঁকাবাজির অফারে কিছু কনজ্যুমার বিরক্ত হয়ে ক্যাডবেরী থেকে মুখ ফিরিয়েও নিলেও, ক্যাডবেরী এই অফার দিয়ে যত নতুন কনজ্যুমার ধরতে পারছে যোগ-বিয়োগ করে তার নেট সংখ্যাটা পজিটিভ । সুতরাং, বিক্রির হার কম, এমন ক্যাটাগরীর বা ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রে এই স্ট্রাটেজিটা প্রাপ্তি হিসেবেই কাজ করে।
তবে সমস্যাটা কোথায় ?
সমস্যাটা হচ্ছে লং-টার্মে। যখন পেনিট্রেশন অনেক গভীর হয়ে যায়, তখন। কারণ, তখন আর হুট করে নতুন কনজ্যুমারকে আকর্ষণ করাটা এত সহজ থাকে না। তখন নজর দিতে হয় আপনার সাথে থাকা কনজ্যুমারদের ভেতরেই কিভাবেই আরও ব্যবহার বাড়ানো যাবে তার উপর। তখন এতদিন যে উল্টাপাল্টা চিটিং ধরণের অফার দিয়ে মানুষকে বিরক্ত করেছেন, তার ঝালটা টের পাওয়া শুরু হয়! কারণ, ততদিনে আপনি এত বেশী মানুষকে বিরক্ত করে ফেলেছেন যে, নতুন কনজ্যুমার খুঁজে পাওয়াটা আর তখন সহজ না। সুতরাং, এই ধরণের অফারের ক্ষতিটা বোঝা যায় তখন!
তাই ক্যাডবেরী বা যে ব্র্যান্ডই হোক, এধরণের ধোঁকা-দেয়া অফার যদি চালাতেই থাকে, তাতে ক্ষতি আছে । পেনিট্রেশন যখন সর্বোচ্চ হওয়া শুরু করবে, তখন ক্ষতিটা বোঝা যাবে । আপনি যদি মেলায় বসানো দোকান হোন, কিংবা আপনার উদ্দেশ্য যদি থাকে ১০-১৫ বছর ব্যবসা করে লাভ তুলে নিয়ে ছেলে-মেয়ে নিয়ে কানাডা-অস্ট্রেলিয়ার পাড়ি দিয়ে দিবেন, তবে এই বুদ্ধি দারুণ কাজের জিনিস! কিন্তু আপনার উদ্দেশ্য যদি থাকে লং-টার্মে ব্যবসা করবেন, আপনার কোম্পানী আর ব্র্যান্ড আপনার মৃত্যুর পরও শত বছর ধরে লিগ্যাসি হয়ে থাকবে, তবে এই বুদ্ধি কখনই কাজে দিবে না।
আপনার ব্যবসার উদ্দেশ্য কি- সেটি আপনার ব্যপার। সেই মত সিদ্ধান্তও আপনার।
২) দু-নম্বর পয়েন্টটি খুবই ভয়াবহ একখানা ভুল ধারণা! অন্য ফাংশনের লোকজন যাঁদের সাথে কনজ্যুমারের সরাসরি সম্পর্ক কম তাঁরা হয়ত এই ভুল ধারণায় থাকতে পারে। কিন্তু দু:খজনক হচ্ছে, এই ধারণা এমনকি আমি অনেক মার্কেটিয়ারদের ভেতরেও দেখি!
ভাই, কনজ্যুমার কে? আপনি নিজে । আপনি কি এতই বোকা যে একখানা ব্র্যান্ড আপনাকে দিনের পর দিন ঠকিয়ে যাবে আর আপনার কিছুই চোখে পরবে না, আপনি কিছু মনেও পরবে না? আমার তো মোটেও তা মনে হয় না। আপনি যদি নিজে এতটা বোকা না হয়ে থাকেন, তবে কিভাবে ধারণা করেন যে বাকী সবাই এররকম বোকা? কোন যুক্তিতে?
কনজ্যুমার সব দেখে, খেয়াল করে, মনেও রাখে। হ্যাঁ, তারপরও হয়ত কেনে। কেন কেনে? নানা কারণেই কেনে। হয়তো এই মুহুর্তে আর কোনো ভালো বিকল্প নেই বলে, বা তার পকেটে এর চেয়ে বেশী টাকা নেই বলে, বা অন্য কোনোটা আর পাওয়া যাচ্ছে না বলে কেনে। অর্থাৎ, আপনার ব্র্যান্ড আপাতত ক্রেতাকে জিম্মি করে বিক্রির সুযোগটা নিচ্ছে, ভালোবেসে, আগ্রহী হয়ে কেনার নয়। তার মানে হচ্ছে যেই মুহুর্তে মার্কেটে বিকল্প আসবে কিংবা কনজ্যুমারের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে, সেই মুহুর্তে সে আপনাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আপনার কম্পিটিটরের কাছে চলে যাবে। মানে এত কষ্ট করে, পয়সা খরচ করে তাঁকে এই ক্যাটাগরীতে নিয়ে এলেন আপনি, কিন্তু তাঁকে অবলীলায় কেড়ে নিয়ে গেল আরেকজন, আপনার কৃতকর্মের জন্যই।
সেলস নম্বর ছাড়াও তাই মার্কেটিয়ারদের আরও কিছু ইন্ডিকেটরের দিকে খেয়াল করতে হয়। ব্র্যান্ড ইকুইটি বা ব্র্যান্ডের নিরপেক্ষতা তার ভেতর একখানা খুবই গুরুত্বপূর্ন ইন্ডিকেটর। আপনি যদি লাগাতার উল্টাপাল্টা ধোঁকা দিয়ে লোক ঠকাতে থাকেন, তবে সাময়িক সেলস্ নম্বর ঠিকই পাবেন- কয়েক মাস, কয়েক কোয়ার্টার এমনকি কয়েক বছরের জন্যও; যতদিন আপনার ধোঁকায় পড়া লোকের সংখ্যা এখন পর্যন্ত আপনার ধোঁকা না খাওয়া লোকের সংখ্যার চাইতে কম থাকবে। কিন্তু এতে দিনে দিনে আপনার ব্র্যান্ডের নিরপেক্ষ মনোভাব এবং ভোক্তার কাছে এর চাহিদা কমতে থাকবে। এবং একসময় যেই মুহুর্তে আপনার ধোঁকায় পরা লোকের সংখ্যা আপনার ধোঁকা না খাওয়া লোকের সংখ্যার চাইতে বেশী হয়ে যাবে, আপনি ব্যথাটা টের পাওয়া শুরু করবেন!
তাই শুধু সেলস নম্বর নিয়ে খুশীতে বগল না বাজিয়ে দয়া করে একটু কষ্ট করে ব্র্যান্ড ইকুইটির মত ইন্ডিকেটরগুলো একটু খোঁজ খবর করে দেখুন- নিজেই বুঝে যাবেন কনজ্যুমার আপনার ধোঁকার কথা খেয়াল করছে কিনা বা মনে রাখছে কিনা বা এতে কোন ইমপ্যাক্ট পড়ছে কি না।
তবে আবারও বলবো আপনার উদ্দেশ্যের কথা। আপনার উদ্দেশ্য যদি থাকে ১০-১৫ বছর ব্যবসা করে লাভ তুলে নিয়ে ছেলে-মেয়ে নিয়ে কানাডা-অস্ট্রেলিয়ার পাড়ি দিয়ে দিবেন, তবে এই বুদ্ধি দারুণ কাজের জিনিস। কিন্তু আপনার উদ্দেশ্য যদি থাকে লং-টার্মে ব্যবসা করবেন, আপনার কোম্পানী আর ব্র্যান্ড আপনার মৃত্যুর পরও শত বছর ধরে লিগ্যাসি হয়ে থাকবে, তবে এই বুদ্ধি কখনই কাজে দিবে না। তখন ব্র্যান্ড ইকুইটির মতো ইন্ডিকেটরকে আপনার খেয়াল করতেই হবে। অন্য কোনো উপায় অন্তত আমার জানা নেই।
দিনশেষে এতটুকুই বলব- ধোঁকা দিয়ে শর্টটার্ম সেলস আনা যায়, কিন্তু ব্র্যান্ড দাঁড় করানো যায় না। আর ভুলেও কনজ্যুমারকে বোকা ভাববেন না প্লিজ। তাঁরা আপনার আমার চাইতে স্মার্ট, বুদ্ধিমান এবং জটিল। বিজনেস একা একা এই স্মার্ট, বুদ্ধিমান এবং জটিল মানুষদের কে হ্যান্ডেল করতে পারেনি বলেই মার্কেটিং নামের একখানা আলাদা ডিসিপ্লিনই তৈরী করেছে, যাতে এদের হ্যান্ডেল করা যায়। ভোক্তা বা ক্রেতা যদি এতই বুদ্ধিহীন কিংবা বোধহীন হতো, তবে আর যাই হোক মার্কেটিং ফাংশনটাই লাগত না। সবাই মিলে শুধু প্রোডাকশন আর বিক্রি করলেই হত। তাই না?