
এটা শুধু একটা মাইকের প্রতিষ্ঠানই নয় বরং বাঙলার জ্বলন্ত ইতিহাস। এ দেশ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ইতিহাসে কল-রেডীর অবদান অপরিসীম। আমরা কি মনে রেখেছি এই কল-রেডীর কথা?
তাদের পথচলার ৭২ বছর চলছে। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে যে মাইক্রোফোনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন- সেই মাইক্রোফোন, মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ড আজও আছে তাদের কাছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আর অন্য কেউ সেই মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেননি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আবারও সেই মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই মাইক এখনো তাদের কাছে সংরক্ষিত আছে।
বলছিলাম কল-রেডীর কথা। বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী মাইক পরিষেবা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে বিভিন্ন আন্দোলনে প্রায় সব সময় এ মাইক সার্ভিসটি ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় সভা ও সমাবেশে এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ।
বাংলাদেশি রাজনীতিবীদ ছাড়ও বাংলাদেশে বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের নিয়ে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানেও কল-রেডী ব্যবহার করা হয়েছে। যারা কল-রেডীর মাইক দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- ইন্দিরা গান্ধী, ইয়াসির আরাফাত, নেলসন ম্যান্ডেলা, বিল ক্লিনটন, প্রণব মুখার্জি ও অটল বিহারী বাজপেয়ী। ঐতিহ্যগতভাবে এদেশে এখনো বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অধিকাংশ সময় কল-রেডী ব্যবহার করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, শেখ হাসিনাসহ আরো অনেকে আছেন এই তালিকায়।

১৯৪৮ সালে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সূত্রাপুরে ‘আরজু লাইট হাউস’ নামে একটি দোকান চালু করেন হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ নামে দুই ভাই। প্রতিষ্ঠার শুরুতে তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গ্রামোফোন ভাড়া ও আলোকসজ্জার কাজ করতেন। প্রথমিদিকে ভারত থেকে কয়েকটি মাইক আমদানি করে এবং তারা নিজেরা কিছু হ্যান্ডমাইক তৈরি করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা-সমাবেশে ভাড়া দেওয়া শুরু করেন। কিন্তু চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চীন, তাইওয়ান ও জাপানসহ অন্যান্য দেশ থেকেও মাইক আমদানি করেন।
একই সময় থেকে ভাষা আন্দোলনের দাবিতে সমাবেশ ও বিক্ষোভ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এসময় মাইক সার্ভিসের জন্য ‘কল-রেডী’ নামটি ঠিক করা হয়। নামের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, ‘মাইক যারা ভাড়া করবেন তারা কল (ডাকলে) করলে যাতে তাদের প্রতিষ্ঠান রেডী (প্রস্তুত) থাকেন।’ অর্থাৎ কল করলে মাইক নিয়ে রেডী। সে ভাবনা থেকে কল-রেডী নামটি এসেছে। দুই ভাইরে প্রতিষ্ঠা করা এ মাইক সার্ভিসে ১৯৫৪ সাল নাগাদ কর্মী সংখ্যা ২০ জন অতিক্রম করে।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্সে ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক এক ভাষণ প্রদান করেন। যে ভাষণটিকে ২০১৭ সালের অক্টোবরের শেষে ইউনেস্কো "ডকুমেন্টারী হেরিটেজ" (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সেই ভাষণের সময় কল-রেডী মাইক ব্যবহার করা হয়।

৭ই মার্চের পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমান তার ধানমন্ডির বাসভবনে হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ দুজনে ডেকে রেসকোর্সে ময়দানে মাইক প্রস্তুত করতে বলেন। কাজে নেমে পড়েন হরিপদ ও দয়াল ঘোষ। তখন রেসকোর্সে মাইক লাগানো সোজা ছিল না-শাসকগোষ্ঠীর চোখ ছিল সদা সতর্ক। রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে মাইক লাগাতে লাগলেন দুই ভাই। ৭ই মার্চের বাকি আর তিন দিন। মাইক লাগিয়ে কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন হরিপদ আর দয়াল ঘোষ।
কিছু বাড়তি মাইক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মজুদ রাখেন যেন সমাবেশের দিন তাৎক্ষণিকভাবে লাগিয়ে নিতে পারেন। তিন দিন ধরে ৩০ জন কর্মী নিয়ে বাঁশ, খুঁটি গাঁথার কাজ করেন ঘোষেরা। তারপর সেই দিনটি আসে-৭ই মার্চ। কবি গিয়ে দাঁড়ান জনতার মঞ্চে। মুখের সামনে কল-রেডী। বঙ্গবন্ধু তর্জনী দেখিয়ে বলে ওঠেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।'
বঙ্গবন্ধুর ভাষণকালে যেন কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি না হয়, সে জন্য নিজে উপস্থিত থাকার পাশাপাশি একজন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দিয়েছিলেন হরিপদ ঘোষ। অতিরিক্ত তিনটি মাইক্রোফোন সঙ্গে রেখেছিলেন দয়াল ঘোষ। এতো বড় একটি সমাবেশে মাইক সার্ভিস দিয়ে কত টাকা পারিশ্রমিক নিয়েছিল কল-রেডী? জানতে চাইলে হরিপদ ঘোষের ছেলে কল-রেডীর বর্তমান পরিচালক সাগর ঘোষ জানান, সেই সময় পারিশ্রমিকের কথা চিন্তা করার সুযোগ বাবা ও জ্যাঠা মশাইয়ের ছিল না। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছেন সেটাই বড় কথা। আর তা ছাড়া দেশের পরিস্থিতি তখন সবাই কম-বেশি জানতেন। আর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাবা-কাকার ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে বাবা শুধু খরচটাই নিতেন। আরো বললেন, 'সেদিন সেই সমাবেশে আমার বাবার হাতে তৈরি অনেক হ্যান্ড মাইক ব্যবহৃত হয়েছিল।'
বঙ্গবন্ধু যে টেবিলটি (পোডিয়াম) সামনে দাঁড়িয়ে, তার ওপর চশমা রেখে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটি এখনো আছে। রাজধানীর হোসেনি দালান এলাকার হাজী চান মিয়া ডেকোরেটর সেদিন ওই টেবিল সরবরাহ করেছিল। টেবিলটি তাদের কাছে থাকার তথ্যও দিয়েছেন সাগর ঘোষ। দেশভাগের সেই ১৯৪৮ সালে থেকে শুরু করে- ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ৭ই মার্চের ভাষণ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ আজকের দিন পর্যন্ত- বর্তমানে ৩৬, এইচকে দাস রোড, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর থেকে অত্যন্ত সুনামের সাথে একনিষ্ঠ সেবা দিয়ে যাচ্ছে কল-রেডী।
এটা শুধু একটা মাইকের প্রতিষ্ঠানই নয় বরং বাঙলার জ্বলন্ত ইতিহাস। এ দেশ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ইতিহাসে কল-রেডীর অবদান অপরিসীম। শুধুমাত্র ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যেই নয় বরং এদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলেও ভূমিকা রেখেছে এই প্রতিষ্ঠান। ৭২ বছর পরে এসেও যদি তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু আমরা দিতে না পারি, সেটার দায় আমাদের ওপরেই বর্তায়। সরকারীভাবেও একটা পদক্ষেপ নিয়ে কল-রেডীর কাছে থাকা ঐতিহাসিক সরঞ্জমাদি সংরক্ষণ করা উচিত। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যদি বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হয় তবে তাদের কাছে থাকা এক একটা মাইকও সেই ঐতিহ্যের অংশ। এভাবেই বাঙলার ইতিহাসে কালজয়ী হয়ে বেঁচে থাকুক কল-রেডী।
আন্তরিক কৃতজ্ঞতাঃ উইকি, ডেইলি বাংলাদেশ, বাংলা ট্রিবিউন, কালের কন্ঠ, বিডি নিউজ২৪/ব্লগ।