ইউনিকর্ন নয়, করোনার এই ক্রাইসিসে বেছে নিন ক্যামেল মডেল!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
একজন লিডার হিসেবে, এই ক্রাইসিস মোমেন্টে আপনার কোম্পানিকে রক্ষার উপযুক্ত মডেল হিসেবে বেছে নিন- ক্যামেল, নট ইউনিকর্ণ!
মিথলজিতে ইউনিকর্ণ অত্যন্ত রহস্যময় এবং বিখ্যাত একটি প্রানী- যেটি দেখতে অনেকটা শুভ্র অশ্ব বা ঘোড়ার মতো, কিন্তু মাথায় একটি খাড়া শিং! সৌন্দর্য্য, শুদ্ধতা, তেজ, হিলিং পাওয়ার, বিদ্যুৎ বেগ এবং জাদুকরী ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে ইউনিকর্নকে দেখা হয়েছে সুপ্রাচীন কাল থেকে।
বিজনেস ওয়ার্ল্ডে আমরা ইউনিকর্ন টার্মটি ব্যবহার করি ১ বিলিয়ন ডলার ($১ B+) বা ৮৫০০ কোটি টাকার উপর ভ্যালুয়েশনের প্রাইভেট লিমিটেড স্টার্টআপ কোম্পানি বোঝাতে।
আমার জানামতে পৃথিবীতে এই মূহুর্তে ৪৭২ টি ইউনিকর্ন কোম্পানি রয়েছে (মে, ২০২০), যাদের টোটাল ভ্যালুয়েশন ~ $১৩৮২ বিলিয়ন। এদের মধ্যে Airbnb, SpaceX, Stripe, Go-Jek, Ola, Quora, Reddit, Asana, Coursera ইত্যাদি আমাদের কাছে বেশ পরিচিত।
ফাউন্ডার থেকে শুরু করে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট, এমপ্লয়িসহ অন্যান্য স্টেকহোল্ডার সবার কাছেই পরম আরাধ্য- ইউনিকর্ণ কোম্পানি। বিজনেসের শুরু থেকেই অনেক ফাউন্ডারের স্বপ্ন থাকে 'disruptive innovation' এর মাধ্যমে একটা ইউনিকর্ণে পরিণত হওয়া। শুধুমাত্র স্টার্টআপ না, করোনার ক্রাইসিসের আগে অনেক অনেক কোম্পানিই ইউনিকর্ণ স্ট্র্যাটেজি ফলো করতে চেষ্টা করতো।
অর্থাৎ হিউজ পরিমানে ক্যাশ বার্ন করে মার্কেট শেয়ার বাড়িয়ে নেয়া, প্রচুর ডিসকাউন্ট দিয়ে স্বল্পতম সময়ে বিপুল সংখ্যক কাস্টোমার একুইজিশন করা, একটার পর একটা ইনোভেটিভ ফিচার রিলিজ করা, ড্রামাটিক মার্কেটিং স্ট্যান্সের মাধ্যমে চারিদিকে আলোড়ন সৃষ্টি করা, মান্থ বাই মান্থ গ্রোথ কার্ভটাকে যে কোন মূল্যেই উপরের দিকে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা ইত্যাদি।
এবং মার্কেটও এতদিন এই ইউনিকর্ণ স্ট্রাটেজিতে বেশ পজিটিভ রেসপন্স করে আসছিল। ইনভেস্টররা চাইতো 100x থেকে 1000x রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্ট, এমপ্লয়িরা চাইতো লোভনীয় বেনিফিট প্যাকেজ, কাস্টমাররা চাইতো শাইনি নতুন ফিচার, গাদা গাদা ডিসকাউন্ট আর মাথা নষ্ট সব অফার…Who doesn’t love a Unicorn?
অপরপক্ষে ক্যামেল বা উট কখনোই ইউনিকর্নের মতো অতটা চার্মিং ছিল না। প্রাণী উটকে একনামে আমরা সবাই চিনি মরুভূমির জাহাজ হিসেবে। বালিতে ধীরে ধীরে চলাচলের উপযোগী লম্বা লম্বা পা, অস্বাভিক ভার বহনের ক্ষমতা, দিনের পর দিন পানি না খেয়ে চলতে পারা, এবং প্রতিকূল পরিবেশে মানিয়ে নেবার অবিশ্বাস্য সহ্যশক্তি রয়েছে উটের।
বিজনেস টার্মে ক্যামেল কোম্পানি বলতে আমরা বুঝি সেইসব কোম্পানি, যেগুলো স্লো অ্যান্ড স্টেডি, তেমন কোন ড্রামাটিক গ্রোথ স্ট্রাটেজি নেই, ধীরে সুস্থে প্রতিকূলতা পেরিয়ে অবিরাম এগিয়ে চলছে তো চলছেই। ইউনিকর্নের তুলনায় ক্যামেল টার্ম বোরিং শুনাচ্ছে, না? কিন্তু এই গ্লোবাল ক্রাইসিসের সময়ে ক্যামেল টার্মই সবচেয়ে উপযোগী। এই ইকোনোমিক ডাউনটাইমের সময় ফাউন্ডার, ইনভেস্টর, মার্কেটার, ব্র্যান্ড প্রাকটিশনারসহ সকল স্টকহোল্ডারকে ক্যামেল কোম্পানি হবার চেষ্টা করতে হবে।
এখন এমন একটা সিচুয়েশন, যখন কোম্পানিগুলো কাস্টমার খুঁজে পেতে ভয়াবহ স্ট্রাগল করছে; ইনভেস্টররা রিস্ক নিতে ভয় পাচ্ছে; অনেক কোম্পানি কস্ট কাটিং করে শুধুমাত্র বেসিক ফাংশনালিটিগুলো রানিং রাখছে- ইনোভেশন, গ্রোথ, স্ট্যান্টবাজির পিছনে টাকা-পয়সা খরচ করা তো অনেক দূরের কথা।
ক্যামেল থিঙ্কিং এখন আপনাকে হেল্প করবে চিন্তা করতে কীভাবে একটা গেরিলা ক্যাম্পেইন করে বেশ কিছু ক্যাশ জেনারেট করা যায়। ঠিক যেমন একটা উট ৩ মিনিটে ২০০ লিটার পর্যন্ত পানি খেয়ে নিতে পারে। তারপর কীভাবে সেই ক্যাশ রিজার্ভ করে এবং খুব কেয়ারফুলি খরচ করে এই ক্রাইসিস সিচুয়েশন আরো বেশিদিন সারভাইব করা যায়। যেভাবে উট নতুন করে পানি পান না করেও রিজার্ভ করা পানি দিয়ে টিকে থাকতে পারে তপ্ত মরূভুমিতে। যেভাবে এক টুকরো খাবার না পেলেও পিঠের কূজের ফ্যাট থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে দিনের পর দিন চলতে পারে।
আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার (ডিরেক্টর, আইবিএ, ঢাবি) স্যার সেদিন লাইভে বলছিলেন, 'কোম্পানিগুলো যেন এই মুহূর্তে কোনভাবেই মার্কেটিং ইফোর্ট পুরোপুরি বন্ধ না করে দেয়।' খেয়াল করুন এখানেই কিন্তু ইউনিকর্ণ এবং ক্যামেল এর মধ্যে পার্থক্য।
ক্যামেল কোম্পানি প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়েও অবিচলভাবে চলতে পারে। কারণ সেই কোম্পানিগুলো জানে কীভাবে ইনোভেটিভ এবং মিনিমালিস্ট হয়ে লাভজনকভাবে চলতে হয়, কীভাবে দুর্যোগ শেষ হওয়া পর্যন্ত টিকে থেকে ধারাবাহিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়।
অন্যদিকে ইউনিকর্ণ স্ট্রাটেজির ফলোয়াররা কিন্তু অধিকাংশ সময় ক্রাইসিস (স্পেশালি ক্যাশ ক্রাইসিস) এ পড়লে খেই হারিয়ে ফেলে- এবং অতঃপর 'ইরেটিক বিহেভিয়ার' দেখানো শুরু করে। একদিকে কর্মী ছাঁটাই করে, তো আরেকদিকে ইনভেস্টরের পিছনে দিকভ্রান্তের মতো দৌড়াতে থাকে। আর শেষ পর্যন্ত বিজনেস স্ট্রাটেজির ভুল বুঝতে পেরে অপ্রয়োজনীয় সার্ভিস গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়! চোখ বন্ধ করলেই বেশ কিছু জ্বলজ্যান্ত টাটকা উদাহরণ আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে, আমি এখানে নাম মেনশন করলাম না!
যারা বিলিয়ন ডলার কোম্পানির স্বপ্ন দেখছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ সম্ভবত এই লেখাটা পড়ে অখুশি হবে। তাহলে কি ইউনিকর্ণ স্ট্রাটেজি ভুল? উত্তর হচ্ছে- অবশ্যই না! যখন সব কিছু আবার স্বাভাবিক হবে, নিউ নরমাল যখন নরমাল হবে, তখন আপনি আবার ইউনিকর্ণ স্ট্রাটেজি নেবার কথা চিন্তা করবেন। কিন্তু এই প্যান্ডেমিকের সময়ে ক্যামেল স্ট্র্যাটেজিই সর্বোত্তম।
উটও কিন্তু জানে সুযোগের সদ্ব্যবহার কখন কীভাবে করতে হয়। সামনে একটা পানির সোর্স পেলে কিন্তু লিটার কি লিটার পানি খেয়ে নিতে ভুল করবে না। কিন্তু সে এটাও জানে - সার্ভাইভাল ফার্স্ট!
Being a Camel Company is all about ADAPTING. It’s about knowing when to go slow, and when to run. When to spend money, when to reserve. Knowing how to not panic. Knowing how to balance.
সারভাইভাল ইন্সটিংক্ট এবং দূরদৃষ্টি একজন লিডারের জন্য সবসময়ই অন্যতম প্রধান পুঁজি, কী সুসময় কী দুঃসময়। সুতরাং, একজন লিডার হিসেবে, এই ক্রাইসিস মোমেন্টে আপনার কোম্পানিকে রক্ষার উপযুক্ত মডেল হিসেবে বেছে নিন- ক্যামেল, নট ইউনিকর্ণ!
*
(পেশায় তিনি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার কাম বিজনেস কনসালটেন্ট, কাজ করেন মূলত টেক কোম্পানীগুলোর জন্য। বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন, তারপর এমবিএ ডিগ্রি নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে। এখন একই প্রতিষ্ঠান থেকে ডক্টর অফ বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিগ্রি নিচ্ছেন। এই তরুণের নাম মার্ক অনুপম মল্লিক, লেখালেখিটা করাটা তাঁর শখ, অবসরে ভালোবাসেন বই পড়তে, অথবা চকলেট বার হাতে নিয়ে নেটফ্লিক্সে ডুব দিতে।
লেখকের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মেইল করতে পারেন anupom.mollick@ideanconsulting.com এই ঠিকানায়, অথবা ঢুঁ মারতে পারেন তার লিঙ্কডইন প্রোফাইলে)
*
আরও পড়ুন-
_
* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে