মিথিলার স্বামী সৃজিতের সঙ্গে তাহসানের ভালো সম্পর্ক থাকে, শমী কায়সারের বিয়েতে শুভেচ্ছা জানান তার প্রাক্তন স্বামী রিঙ্গো; প্রাক্তনেরা সঙ্গীদের সম্মান জানাতে ভোলেন না, ভুলে যাই শুধু আমরা, মেতে উঠি নোংরামিতে...

ঘটনা এক

সঙ্গীতশিল্পী তাহসান এবং অভিনেত্রী মিথিলা বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন ২০০৬ সালে, এর আগে কয়েক বছর প্রেম করেছেন। ২০১৭ সালে পারস্পরিক সম্মতিতে আলাদা হয়ে গিয়েছেন এই দম্পতি। গত বছর মিথিলা বিয়ে করেছেন কলকাতার বিখ্যাত পরিচালক সৃজিত মুখার্জীকে। তিন বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও, তাহসান বা মিথিলা কেউই কখনও প্রকাশ্যে একে অন্যের সমালোচনা করেননি, শুধু বলেছেন, মতের অমিল থাকায় তারা আলাদা হয়েছেন, ব্যাস- এটুকুই। একে-তাকে জড়িয়ে অজস্র গুঞ্জন ছড়ালেও, সেই গুজবের আগুনে হাওয়া দেননি দুজনের কেউই, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধটা বজায় রেখেছেন তারা। 

মিথিলার স্বামী সৃজিতের সঙ্গে তাহসানের ভালো সম্পর্ক। সৃজিত কয়েকবারই সাক্ষাৎকারে তাহসান সম্পর্কে তার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। তাহসানও বরাবরই মিথিলার সুন্দর ভবিষ্যত কামনা করেছেন, মিথিলাকে যখন অনলাইনে হ্যারাসমেন্টের শিকার হতে হচ্ছিল, তখন তিনি পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাহসান এবং মিথিলার মেয়ে আইরার সাথেও সৃজিতের দারুণ বন্ধুত্ব, ছোট্ট এই মেয়েটাও মায়ের নতুন সঙ্গীকে আপন করে নিয়েছে, আপন করতে পারিনি শুধু আমরা। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিনিয়তই মিথিলাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন কিছু লোক, সেই গালির রাডার থেকে বাদ পড়েন না সৃজিতও। 

মিথিলা, সৃজিত এবং আইরা

মিথিলার অপরাধ, কেন তিনি একটা সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে গিয়ে আরেকটা সম্পর্কে জড়ালেন। একজন পুরুষ যখন একই কাজটি করেন, আমাদের দেশের কেউ তাকে এই প্রশ্ন করে না, মিথিলা নারী বলেই যে এই বৈষম্য এবং নোংরামির শিকার হচ্ছেন, সেটা বলে না দিলেও চলছে। ঝামেলাটা কোথায় দেখুন, মিথিলার নতুন সম্পর্ক নিয়ে তাহসানের কোন আপত্তি নেই, অথচ ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে অনলাইনে ফতোয়াবাজি করে বেড়ানো নপুংসকদের ঠিকই চামড়ায় জ্বলুনি ধরে। একারনে মিথিলাকে নিয়ে কোথাও আলোচনা হলেই এরা সদলবলে হাজির হয়, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে।

ঘটনা দুই

অভিনেত্রী শমী কায়সার বিয়ে করলেন গত শুক্রবার। বিয়ের ছবিগুলো ফেসবুকে আসামাত্রই একদল লোক উঠেপড়ে লাগলেন সমালোচনা করতে। সেই সমালোচনার মূল বক্তব্য ছিল, শমী কায়সার কেন এত ঘন ঘন (!) বিয়ে করেন? এই নিয়ে তাকে দুশ্চরিত্রা আখ্যা দিতেও ছাড়েনি অনেকে! হ্যাঁ, এটা শমী কায়সারের তৃতীয় বিয়ে। কিন্ত একটা মানুষ কয়টা বিয়ে করলেন, সেটার ওপরে কি তার চারিত্রিক সনদ নির্ভর করে? একজন পুরুষ যখন একাধিক বিয়ে করেন, তাকে তো কেউ চরিত্রহীন বলে অপবাদ দেয় না। একজন নারীর বেলায় তাহলে চিত্রটা ভিন্ন হবে কেন? নাকি নারী তার পছন্দমতো সঙ্গী বাছাই করে নিচ্ছেন- এই স্বাধীনতাটাই গোঁড়া মানসিকতার লোকজন মেনে নিতে পারছে না? 

একই দিনে অভিনেতা শ্যামল মাওলাও বিয়ে করেছেন। এটা তার দ্বিতীয় বিয়ে। শ্যামল মাওলার বিয়ে নিয়ে যত পোস্ট দেখেছি ফেসবুকে, কোথাও একজনও প্রশ্ন তোলেনি যে কেন তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করলেন। যত প্রশ্ন সব নারীর বেলায়। একজন নারী একাধিক বিয়ে করবে, বা একাধিক সম্পর্কে জড়াবে (একই সময়ে নয়)- সেটা এই অঞ্চলের মানুষ কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না। তাদের ধারণা স্বামী মারা গেলে বা ডিভোর্স হয়ে গেলে তাদের মানসিক সন্তুষ্টির জন্য সেই নারীটিকে বাকি জীবন একাই কাটাতে হবে! 

স্বামী রেজা আমিনের সঙ্গে শমী কায়সার

শমী কায়সারের প্রথম স্বামী কলকাতার পরিচালক রিঙ্গো ব্যানার্জী। ২০০১ সালে তারা আলাদা হয়ে যান। এক কমন ফ্রেন্ডের প্রোফাইলে শমীর বিয়ের ছবি দেখে তিনি প্রাক্তন সঙ্গীকে নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা জানিয়েছেন। সেই বন্ধুকে বলেও দিয়েছেন, তার শুভেচ্ছা যেন শমীর কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। শমীর বিয়েতে রিঙ্গো শুভেচ্ছা জানান, আর আমরা নোংরামিতে মত্ত হই। জাতি হিসেবে আমরা প্রচণ্ড অকর্মণ্য, মানসিকভাবেও বিকারগ্রস্ত। প্রোডাক্টিভ কোন কাজ করার চেয়ে ফেসবুকে ট্রায়াল বসিয়ে অমুক-তমুককে টার্গেট বানানোটা আমাদের প্রিয় কাজগুলোর একটি, আর সেই টার্গেট মূলত নারীরাই হন। এই মানসিকতার লোকজন পৃথিবীর সর্বত্র আছে, তবে অন্য দেশে যদি শতকরা একজন থাকে, বাংলাদেশে সংখ্যাটা দশ-পনেরোগুণ বেশি। 

খুব বাজে দুইটা পারসেপশন আছে আমাদের দেশের মানুষজনের মধ্যে। এক হচ্ছে মিডিয়াতে যারা কাজ করে, এদের চরিত্র খারাপ, এরা সম্পর্কের মূল্য বোঝে না, সারাজীবন ভাঙাগড়ার মধ্যে থাকে। আর দুই হচ্ছে- নারীরা উচ্চশিক্ষিত হলে ডিভোর্সের হার বাড়ে, খোদ প্রথম আলোর গবেষণায় এই দাবী করা হয়েছে। 

শমী কায়সারের বিয়ের ছবিতে রিঙ্গোর কমেন্ট

প্রথমটা নিয়ে কথা বলি, মিডিয়ায় যারা কাজ করে তাদের সামনে অপশন বেশি থাকে, তারা স্বাধীনচেতা মানসিকতার হয়। একটা সম্পর্কে পার্টনার যদি লয়্যাল না হয়, বা পারস্পরিক বোঝাপড়াটা ঠিকঠাক না থাকে, তাহলে সেই সম্পর্ক থেকে তারা বেরিয়ে আসেন, যেটা আমজনতার পক্ষে কঠিন। সাধারন মানুষ তো জীবন নিয়ে কোন ডিসিশানে যাওয়ার আগে একশোবার ভাবে 'লোকে কি বলবে?' মিডিয়ার মানুষেরা লোকের ভাবনাকে কম গুরুত্ব দেন, এজন্যেই সিদ্ধান্তগুলো সহজে নিতে পারেন। নইলে পঁচিশ-ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে সংসার করছেন- এমন দম্পতিও তো আমাদের নাটক বা সিনেমাপাড়ায় কম নেই। 

নারীর উচ্চশিক্ষা কখনোই ডিভোর্সের জন্য 'দায়ী' নয়। শিক্ষিত নারীমাত্রই সচেতন। তিনি নিজের অধিকার সম্পর্কে জানেন, তার আত্মসম্মানবোধ টনটনে হয়। সঙ্গী পুরুষটি যদি কারনে-অকারনে তার গায়ে হাত তোলেন, সেটা নিশ্চয়ই তিনি মেনে নেবেন না। শিক্ষায়-যোগ্যতায় তিনি তো কম কিছু নন, তাহলে কেন তিনি পড়ে পড়ে স্বামীর মার খাবেন? এই ব্যাপারটাও এদেশের অজস্র মানুষ মেনে নিতে পারে না। তাদের ধারনা সংসার মানেই 'মানিয়ে নেয়ার' জায়গা। কিন্ত একজন কেন একপাক্ষিকভাবে মানিয়ে নিতে থাকবে, এই প্রশ্নের কোন জবাব পাওয়া যায় না। মানিয়ে নেয়ার সব ঠ্যাকা এই সমাজ মেয়েদের ঘাড়েই তুলে দিয়েছে। একটা টক্সিক রিলেশন জোর করে টিকিয়ে রাখার চেয়ে যে সেই সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসাই দুজনের জন্য ভালো- সেটা এই মুর্খদের বোঝানো সম্ভব না।

এই লোকগুলোকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। এরা বড় হয়েছে নিজেদের পরিবারে ডমেস্টিক ভায়োলেন্স দেখে, পুরুষেরা সুপ্রীম পাওয়ারের অধিকারী, তারা যা খুশি করতে পারে- এই ভাবনাটা তাদের মগজে গেঁথে গেছে। ২০২০ সালে এসে এটা যে চার আনা পয়সার মতোই অচল একটা চিন্তা, সেটা তারা বোঝে না, বোঝার চেষ্টাও করে না। আর তাই দুটো মানুষ পারস্পরিক সম্মতিতে আলাদা হয়ে গেলেও এরা নারীটিকে দোষারোপ করে, তার গায়ে উচ্চারনের অযোগ্য সব বিশেষন যুক্ত করে। যেখানে সেই মানুষগুলোর প্রাক্তন সঙ্গীরাও তাদের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে, সেখানে আমরা মত্ত হই নোংরামিতে। তাহসান, রিঙ্গো সবাই মুভ অন করে যায়, মুভ অন করতে পারে না শুধু এই গালিবাজেরা...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা