সেলিব্রেটিরাও যে মানুষ, সেটা কবে বুঝতে শিখব আমরা?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
আমাদের চোখের সামনে নিজের বাবা-মাকে কেউ অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করলে আমার কেমন লাগবে? ঠিক সেরকম অনুভূতি জয়া আহসানেরো হয়, মিথিলারও হয়; তারা তো রোবট নন, ভালো লাগা খারাপ লাগা তাদেরও আছে...
ঘটনা এক
সৃজিত-মিথিলার বিয়ের দিন কলকাতার শিল্পী অনুপম রায় ফেসবুকে একটা ছবি আপলোড দিয়েছিলেন সৃজিতের সঙ্গে। সেই ছবিতে এদেশের কিছু অকালপক্ক অমানুষ গিয়ে গালিগালাজের মেলা বসিয়ে দিয়েছিল। অনুপমের মতো শান্ত স্বভাবের লোকও পাবলিক কমেন্ট অফ করে দিয়ে সবাইকে আহবান জানিয়েছিলেন, তারা যেন বাজে মন্তব্য না করেন। তাহসান-মিথিলার ডিভোর্স, মিথিলার নতুন সম্পর্কে জড়ানো, সৃজিত মুখার্জীকে বিয়ে করা- গোটা ব্যাপারটা নিয়ে এদেশের কিছু অমানুষ এত বেশি নোংরামি করেছে, যেটা বলার বাইরে। সেই নোংরামি এখনও বন্ধ হয়নি। মিথিলার বিয়ে নিয়ে তাহসানের আপত্তি নেই, তাদের মেয়ে আইরার কোন আপত্তি নেই, যত আপত্তি বাংলাদেশী ফেসবুক ইউজারদের!
ঘটনা ২
অভিনেতা অপূর্ব ও তার স্ত্রী নাজিয়া আলাদা হয়ে গেছেন কিছুদিন আগে, পারস্পরিক সম্মতিতে ঘটেছে বিবাহ বিচ্ছেদ, কিন্ত তারা বলেছেন, একে অন্যের ভালো বন্ধু হিসেবে থাকবেন তারা। দুজনের মধ্যে সম্মানটাও বজায় আছে। অথচ কিছু ভুইফোঁড় অনলাইন পোর্টাল নাজিয়াকে নিয়ে আজগুবি সব খবর প্রকাশ করেছে, রিজেন্ট শাহেদের কারণেই নাকি অপূর্ব'র ঘর ভেঙেছে! হিট খাওয়ার জন্য ক্লিকবেট হেডিং করে মনগড়া খবর অনেকেই বানায়, তাই বলে কারো ব্যক্তি জীবন নিয়ে নোংরামি? সেটা বোধহয় আমরাই সবচেয়ে ভালো পারি। অপূর্ব বাধ্য হয়ে আইনের শরণাপন্ন হয়েছেন, ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছেন এসব পোর্টালের বিরুদ্ধে।
ঘটনা তিন
আবুল হায়াত, প্রবীণ একজন অভিনেতা, বুয়েট থেকে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার, অভিনয়কে ভালোবেসে এই অঙ্গনে থিতু হয়েছেন। নাট্য জগতের উজ্জ্বল এক নক্ষত্র তিনি, এদেশের নাটকের ইতিহাস লিখতে গেলে তাকে অগ্রাহ্য করার কোন উপায় নেই। অথচ গত চার পাঁচ বছর ধরে তাকে নিয়ে অনলাইনে হেন নোংরামি নেই যা হয়নি। 'আবুল হয়ে গেলাম, হায়াতও কমে গেল' টাইপের মিমগুলো অনেককে হাসিয়েছে হয়তো, কিন্ত তাতে যে একজন কিংবদন্তীকে অপমান করা হয়েছে, সেটা অনেকের মাথায় ঢোকেনি।
ঘটনা চার
মোশাররফ করিম বলেছিলেন, ধর্ষণের পেছনে নারীর পোষাকের কোন ভূমিকা নেই, দায় যদি থাকে, সেটা কেবল ধর্ষকের নিকৃষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির। একটা রেডিও প্রোগ্রামে এসে সাফা কবির বলেছিলেন, তিনি মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস করেন না। তৌহিদি জনতা সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই দুজনের ওপর। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ থেকে শুরু করে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি- কি দেয়া হয়নি তাদের! বাধ্য হয়ে দুজনেই ক্ষমা চেয়েছেন, কোন অপরাধ না করেই! সাফা তো আইডি ডিয়্যাক্টিভ করে দিতেই বাধ্য হয়েছিলেন।
ঘটনা পাঁচ
সাইবার বুলিংয়ের শিকার এদেশের ক্রিকেটারদেরও কম হতে হয়নি। এসবের প্রথম ভুক্তভোগী সাকিব আল হাসান। তার স্ত্রীকে পর্দা করার নসিহত তো এখনক মানুষজন কমেন্টবক্সে দিয়ে আসে। সাকিব কত অহংকারী, সেটাও তাকে মনে করিয়ে দেয়া হয় প্রতিনিয়ত। রাজনীতিতে এসে একটা পক্ষের শত্রুতে পরিণত হয়েছেন মাশরাফি, গালিগালাজ চলে তার পেজেও, কিংবা তাকে নিয়ে প্রকাশিত খবরের কমেন্টবক্সে। ক্রিকেটার নাসির বা সৌম্য সরকার, কেউই রেহাই পাননি সাইবার বুলিংয়ের এই তীব্র আক্রোশ থেকে।
অতঃপর জয়া আহসান
এদেশের সেলিব্রেটিদের মধ্যে অনলাইনে সবচেয়ে বেশি প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে সম্ভবত জয়া আহসানকে। আমার চোখে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা অভিনেত্রী, দুই বাংলায় চুটিয়ে কাজ করছেন, দুই জায়গাতেই তার সীমাহীন জনপ্রিয়তা। সৃজিত-কৌশিক-অরিন্দমের মতো মেধাবী নির্মাতার তাকে ছবিতে নিচ্ছেন, ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তিনি।
যে মানুষটার ক্যারিয়ারে গেরিলা, বিসর্জন, বিজয়া, দেবী বা কণ্ঠের মতো সিনেমা আছে, তাকে কিনা নোংরামির শিকার হতে হয় রাজকাহিনী সিনেমায় অভিনয় করা একটা ইন্টিমেট দৃশ্যের জন্য! গল্পের প্রয়োজনে যে ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে অভিনয় করা লাগতে পারে, সেটা এদেশের অকালকুষ্মাণ্ড দর্শকদের কে বোঝাবে? শুরুতে জয়ার মধ্যে খারাপ লাগা কাজ করতো, অবাক হতেন। এখন তিনি সামলে নিয়েছেন নিজেকে। কে কি বললো সেসবের পরোয়া না করে নিজের কাজটা করে চলেন তিনি।
প্রথম আলোতে তারকাদের সঙ্গে হওয়া সাইবার বুলিং নিয়ে প্রকাশিত একটা লেখা পড়ছিলাম। জয়া আহসানের কিছু কথায় চোখ আটকে গেল, তিনি বলেছেন- ‘আমি তো দুই দেশেই কাজ করি। কিন্তু বাংলাদেশে যে পরিমাণ বুলিংয়ের শিকার হই, তা ভয়াবহ। এখন আর এসব গায়ে মাখাই না। তবে যখন ভারতের অনুসারীরা আমাদের দেশের মানুষকে উদ্দেশ করে বলেন, তোমরা তো তোমাদের দেশের নারীদেরই সম্মান দিতে জানো না, তোমাদের দেশের পুরুষদের মানসিকতা কেমন, মন্তব্য দেখলে বোঝা যায়, এসব দেখে খুব কষ্ট পাই।’
কথাগুলো হৃদয়ের গহীনে গিয়ে আঘাত করলো যেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহজলভ্যতা যে আমাদের কতটা অসামাজিক করে দিয়েছে, তারই যেন নমুনা এটা। এই প্ল্যাটফর্মে আমাদের যা মন চায়, যেভাবে মন চায় বলে ফেলি, কারো কাজ পছন্দ না হলেই তাকে মা-বাবা তুলে গালাগালি দিয়ে ফেলি, কারণ মনিটরিং বলে কোন বস্তু নেই, আইন-আদালতের ভয় নেই। সামনাসামনি যে লোকটা মেনি বেড়াল হয়ে থাকে, ফেসবুকে সেও বাঘ সেজে গর্জন ছাড়ে।
আমরা ভুলে যাই, এই সেলিব্রেটিরাও মানুষ। তাহসান, মিথিলা, জয়া আহসান, বা অন্য সবাই- তারা আমাদের কাছে তারকা, কিন্ত পরিবারের সদস্যদের কাছে তারা কারো ভাই, কারো বোন, কারো ছেলে, কারো কাছে বাবা। আমাদের এসব কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য যে নিজেদের পরিবারের কাছে তাদেরকে ছোট করতে পারে, তাদের পরিবারের সদস্যদের মন খারাপ হতে পারে এমন নোংরা গালিগালাজ দেখে, সেটা আমরা ভাবি না। আমার চোখের সামনে আমার বাবাকে কেউ অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করলে আমার কেমন লাগবে? ঠিক সেরকম অনুভূতি তাদেরও হয়, তারা তো রোবট নন, ভালো লাগা খারাপ লাগা তাদেরও আছে।
আমরা ভেবে নিই, এই সেলিব্রেটিদের আমরা বানিয়েছি, আমরা তাদের নাটক সিনেমা দেখি, তাদের পেজে লাইক দিয়েছি, অতএব যা খুশি বলার অধিকার আমাদের আছে। তারা চলবেন আমাদের ইচ্ছেমতো, আমাদের খেয়াল-খুশির বাইরে তারা কিছু করতে পারবেন না, এমনকি আমাদের পছন্দের বাইরে জামা-কাপড়ও পরতে পারবেন না! অদ্ভুত এক অলীক বাস্তবতার জগতে আমাদের বসবাস, আমাদের ধারণা থেকে তারা খানিকটা বিচ্যুত হলেই দাও গালি, শুরু করো নোংরামি!
এসবের কোন প্রতিকার কি আছে? না বোধহয়। আমরা এগুলোকে ঠাট্টা ফাজলামি হিসেবে দেখি, অথচ যার সঙ্গে ব্যাপারটা ঘটছে, তারা কতটা কষ্ট পাচ্ছে সেটা আমরা বোঝার চেষ্টা করি না। জয়া আহসানের কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে, বুলিংকে পাত্তা না দেয়া, ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে চলা মানুষটারও মাঝে মাঝে মন খারাপ হয় এসবের কথা ভেবে। প্রিয় জয়া আহসান, যাদের স্যরি বলার কথা, তারা তো সেটা বলবে না কখনও, আমরাই স্যরি বলছি। আপনার কাছে ক্ষমা চাওয়ার ভাষা তো আমাদের জানা নেই। যেখানে মাথায় তুলে রাখার কথা, সেখানে সম্মান পাবার পরিবর্তে বরং নোংরামি সইতে হচ্ছে আপনাকে। তবু পারলে আমাদের ক্ষমা করে দেবেন প্লিজ!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন