কোনো সেফটি চেক ছাড়াই, স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি আছে কিনা, তা নিশ্চিত না করেই কোম্পানিগুলো একের পর এক ফোন বাজারে ছাড়ছে। মার্কেটিংয়ের এই যুগে আমরাও প্রভাবিত হচ্ছি, ফোর জি, ফাইভ জি আমাদের ভুলিয়ে রাখছে সব কিছু। ক্যামেরার রেজুলেশন মেপে নিজের চেহারার সৌন্দর্য বাড়াতে সবাই মেতে আছি।
এই মুহুর্তে মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় বস্তু হচ্ছে মোবাইল ফোন। যেখানেই আপনি যান, সাথে আর কিছু না থাকুক, ফোনটা সাথেই থাকেই। এমনকি রাতে ঘুমানোর সময়েও ফোনটা বালিশের পাশেই থাকে। কিন্তু এই প্রিয় বস্তুটির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার যে আপনার ক্ষতির কারণ হতে পারে তা কি জানেন? ক্ষতিটা কেমন তা শুনলে চমকে উঠতে পারেন আপনি। মুঠোফোনের ব্যবহারে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে মানুষের। এইরকম তথ্যই উঠে এসেছে একটি আমেরিকান গবেষণায়।
১৯৯৩ সালের সময়টার কথা বলছি। তখন আমেরিকায় প্রতি একশজন প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের মধ্যে মাত্র ছয়জন মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন। যদিও তার এক যুগ আগে থেকেই আমেরিকার মার্কেটে মোবাইল ফোনের প্রচলন হয় এবং তখন কেউ মোবাইল ফোন বাজারে ছাড়ার আগে সেফটি চেকিং রাখার চিন্তাও করেনি। সরকারের পক্ষ থেকেও তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। কিন্তু, ১৯৯৩ সালে ড্যাভিড রেয়নার্ড নামে এক ভদ্রলোক এনইসি মোবাইল কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করে দেন। তিনি অভিযোগ করেন এই কোম্পানির ফোন ব্যবহার করার কারণে তার স্ত্রীর মারাত্মক ব্রেইন টিউমার হয়। এই অভিযোগের কথা যখন রেয়নার্ড ন্যাশনাল টেলিভিশনে বলেন তখন এটি নিয়ে চারদিকে বেশ আলোচনার শুরু হয়। সবাই নড়েচড়ে বসেন।
একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই তদন্ত কমিটি অনেকটা আইওয়াশ করার চেষ্টা নেয়। তদন্ত কমিটিতে আবার ছিলেন আমেরিকার সেলুলার কমিউনিকেশন এন্ড ইন্টারনেট এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট টম হুইলার।
এক সপ্তাহ পর হুইলার তদন্তে কি পেয়েছেন কে জানে, তিনি রিপোর্টারদের জানালেন মোবাইলে কোনো ঝুঁকি নেই। সব কিছুই নিরাপদ। কিন্তু, আরো বিষদ রিসার্চ হবে এই ব্যাপারে, যার ব্যয় তারা বহন করবেন। এই রিসার্চে কিন্তু মোবাইল ফোনের ক্ষতিকর দিক তিনি বের করে দেখাবেন না, তিনি নিজেই বলেছেন এখন যে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন, মোবাইল যে নিরাপদ সেটার স্বপক্ষেই রিসার্চ আরো জোরালো যুক্তি দাঁড় করাবে।
জনগণের মনে মোবাইল ফোন নিয়ে যে দুশ্চিন্তা ঢুকেছে, তাদের আইওয়াশ করার জন্য টম হুইলার এই রিসার্চে যুক্ত করলেন জর্জ কারলোকে। এই লোক আবার এমনিতেই বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির বিতর্কিত ইস্যু নিয়ে আগেও কাজ করেছেন। মানুষকে ম্যানিপুলেট করার কাজে তিনি বেশ দক্ষ এমনিতেই। এই রিসার্চের জন্য ২৮.৫ মিলিয়ন ডলার বাজেট রাখা হয়েছিল, যার ডিরেক্টর ছিলেন কারলো। কিন্তু কারলোর সাথে টম হুইলারের এক পর্যায়ে এইসব রিসার্চ থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়। ১৯৯৯ সালের সাত অক্টোবর কারলো ৩২ টি টপ মোবাইল কোম্পানির কাছে চিঠি পাঠান। সেই চিঠিতে তিনি রিসার্চের কিছু তথ্য জানান। সেখানে তিনি লিখেন,
“brain tumours occurring on the right side of the head and the use of the phone on the right side of the head”; এবং আরো লিখেন, “ability of radiation from a phone’s antenna to cause functional genetic damage [was] definitely positive”.
কারলো নিজেই মোবাইল ফোন ব্যবহারের ভয়াবহ এই দিকটি অনুধাবন করে কোম্পানিগুলোর সিইওদের এই বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি তাদের পরামর্শ দেন, তারা যেন কাস্টমারকে এই ব্যাপারটি সম্পর্কে জানায়, কারণ এত দিন তাদের জানিয়ে আসা হয়েছে যে মোবাইল ব্যবহার করলে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি নেই, এটি নিরাপদ। কিন্তু, এখন তাদের আসল সত্যটা জানানো উচিত।
এরপর টম হুইলার ক্ষেপে যান কারলোর উপরে। যে কারলোকে তিনি নিয়োগ দিয়েছেন ম্যানিপুলেশনের কাজে সে এখন রিসার্চ নিয়ে বড় বড় কথা বলে। বিষয়টা মেনে নেননি টম হুইলার। তিনি উলটা কারলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন, তার তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, কারলো ইচ্ছা করে এদিন এই তথ্যগুলো সেলুলার কমিউনিকেশন এন্ড ইন্টারনেট এসোসিয়েশনকে জানায়নি। তাছাড়া, তার ফাইন্ডিংসগুলো পিয়ার-রিভিউড কোনো জার্নালেও প্রকাশিত হয়নি। তাই এগুলোর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
তারপর কত কিছু হয়ে গেল। এরপর আরো অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে সেলফোনের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি নিয়ে। কারলোর তত্ত্বাবধানে হওয়া রিসার্চগুলো ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে পরবর্তী গবেষণায়। এইসব গবেষণার ফলাফল খুবই এলার্মিং। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization) ২০১১ সালে জানিয়েছে মোবাইল ফোনের র্যাডিয়েশনে ক্যান্সার হওয়ার মতো উপাদান রয়েছে। যুক্তরাজ্য, ইসরাইল, ফ্রান্স সরকার শিশুদের মোবাইল ফোন ব্যবহারে সতর্কতা দিয়েছে।
* মোবাইল ফোন কতটা নিরাপদ, কতটা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি আছে এই নিয়ে এখনো বিতর্কের শেষ নেই। বড় বড় কোম্পানিগুলো মোবাইল ফোন নিরাপদ এটা প্রমাণ করতে যেমন উঠে পড়ে লেগেছে তেমনি অনেক গবেষক প্রতিনিয়ত এলার্মিং তথ্য দিচ্ছেন, সতর্ক করছেন। সাধারণ মোবাইল ফোন ইউজাররা সেই সতর্কতা কতটা মেনে চলেন কিংবা কতটা জানেন সেল ফোন ক্যান্সার সম্পর্কে কে জানে! কিন্তু, এই মুহুর্তে মোবাইল ফোন টেকনোলজি যেভাবে উন্নত হচ্ছে তার সাথে উন্নত হচ্ছে না নিরাপত্তা ইস্যুগুলো চেকিং ব্যবস্থা। ফোর জি, ফাইভ জি প্রযুক্তির কারণে র্যাডিয়েশন মাত্রা আরো বাড়ছে। অথচ, কোনো সেফটি চেক ছাড়াই, স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি আছে কিনা, তা নিশ্চিত না করেই কোম্পানিগুলো একের পর এক ফোন বাজারে ছাড়ছে।
মার্কেটিংয়ের এই যুগে আমরাও প্রভাবিত হচ্ছি, ফোর জি, ফাইভ জি আমাদের ভুলিয়ে রাখছে সব কিছু। ক্যামেরার রেজুলেশন মেপে নিজের চেহারার সৌন্দর্য বাড়াতে সবাই মেতে আছি। কিন্তু আমরা হয়ত নিজের স্বাস্থ্যের কথাটাই সেভাবে মাথায় রাখছি না।
আতংকিত হবার কারণ নেই অতটা, তবে এখন সতর্ক হবার সময় এসেছে। আমরা একটা ম্যানিপুলেটেড দুনিয়ার মধ্যে বসবাস করছি। যে যার মতো, ব্যবসায়িক স্বার্থে বিভিন্ন রকম বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে আমাদের ম্যানিপুলেট করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণাও নির্দিষ্ট কারো স্বার্থে ব্যবহারেরও ঘটনা ঘটছে। তাই নিজের জন্য হলেও আমাদের ব্যক্তিগত জায়গা থেকে সতর্ক থাকা দরকার। কয়েকটি কাজ করতে পারেন এক্ষেত্রে।
১। মোবাইল ফোনে দীর্ঘক্ষণ কথা বলার প্রয়োজন থাকলে হেডফোন ব্যবহার করুন। কানে লাগিয়ে অনেকক্ষণ কথা বললে র্যাডিয়েশনের কারণে মস্তিষ্কে এর বাজে প্রভাব পড়তে পারে।
২। ডান কানে ফোন না রাখার চেষ্টা করবেন সবসময়। এনালাইসিসে দেখা যায়, মস্তিস্কের ডান দিকে টিউমার হওয়ার ঘটনা বেশি ঘটেছে, যারা অতিমাত্রায় ফোন ব্যবহার করেন ডান কানে।
৩। রাতে ঘুমানোর সময় ফোন নিজের শরীরের কাছ থেকে দূরে রাখবেন। মাথার কাছে মোবাইল ফোন চালু অবস্থায় রেখে ঘুমানোর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি আছে। অন্ততপক্ষে চেষ্টা করবেন ফ্লাইট মুড চালু রাখতে। সবচেয়ে ভাল এই যন্ত্রটা নিজের কাছ থেকে ঘুমের সময় দূরে রাখা।
৪। কাজ শেষে ওয়াইফাই বন্ধ রাখতে পারেন। কারণ সারাক্ষণ ওয়াইফাই চালু থাকার ফলে এটি থেকেও সারাক্ষণ র্যাডিয়েশন উৎপাদন হতেই থাকে। এটা ক্ষতিকর।
৫। আজকালকার শিশুদের বাবা মা আদর করে অল্প বয়সে মোবাইল হাতে দেন। সন্তান অল্প বয়সে মোবাইলের সব ফাংশন বুঝে এটি শুনিয়ে আনন্দও পান। কিন্তু, আপনি জেনে কষ্ট পেতে পারেন মোবাইল ফোনের র্যাডিয়েশন শিশুদের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। স্বাস্থ্যের অবনতি হবে ধীরে ধীরে। মস্তিষ্কের জটিলতায় ভোগার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।
তাই নিজের সন্তানকে নিজেই নিরাপদে রাখুন, বাস্তব জগতের সাথে পরিচয় করান। জীবনকে পাঁচ ইঞ্চির স্ক্রীনে আটকে দিয়েন না।
এই লেখা কোনোভাবেই আতংক সৃষ্টির জন্য নয়। আগেই বলেছি, আমরা ম্যানিপুলেশনের দুনিয়ায় বসবাস করছি। চকমকি দুনিয়ায় সবাই আপনাকে টার্গেট করবে ভোক্তা হিসেবে। কিন্তু, আপনি জানবেনও না এসব কিছু আপনার জন্যে কতটা মঙ্গলজনক। তাই নিজের ভালটুকু নিজেকেই খেয়াল রাখতে হবে। আজ থেকে নিজের মোবাইল ফোনটাকে একটু সতর্কতার সাথে ব্যবহার করুন, নিজের প্রিয় মানুষদেরও নিরাপদ রাখুন।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন